জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুর ও তাকে অবমাননার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন সারা দেশের ব্যবসায়ীরা।
শনিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) আয়োজনে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এ মানববন্ধন করা হয়।
এতে সভাপতিত্ব করেন এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট শেখ ফজলে ফাহিম।
দেশের ৬৪ জেলা চেম্বারও একই সময় মানববন্ধন করে। তারা ভার্চুয়ালি শাপলা চত্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত একযোগে এ মানববন্ধন হয়।
মতিঝিলের মানববন্ধনে ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বারভিডা, প্রাণ গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপসহ বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের নেতা এবং উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মানববন্ধনে এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, ‘আলেমরা সম্মানীয় ব্যক্তি। আমরা তাদেরকে সম্মান করি। কিন্তু আলেম সমাজের নামে সুযোগ সন্ধানী কিছু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মের দোহাই দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরও ভাস্কর্য ভাঙচুরের দৃষ্টতা দেখিয়েছে। তারা তাদের বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভুল শিক্ষা দিতে চায়। ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা মুছে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।’
হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ফজলে ফাহিম বলেন, ‘যারা এ ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, আজকের মানববন্ধন একটা প্রতীকী কর্মসূচি মাত্র। ব্যবসায়ীদেরকে কঠোর হতে বাধ্য করবেন না।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক। তাকে কোনোভাবেই মুছে ফেলা যাবে না। আমরা মনে করি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা মানে বাঙালির জাতীয়তাবাদ ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। এ ধরনের ধৃষ্টতা আপনারা আর দেখানোর চেষ্টা করবেন না। সেটি ভালো হবে না।’
সরকারের উদ্দেশে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘আমরা আশা করছি সরকার নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের প্রতি অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কঠোর পদক্ষেপ নেবেন।’
রিহ্যাব সভাপতি শামসুল আলামিন তার বক্তব্যে প্রশ্ন করে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক এই মৌলবাদী গোষ্ঠী স্বাধীনতার এত বছর পর কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার মতো সাহস পায়?’
ব্যবসায়ী সমাজ মৌলবাদীদের অপতৎপরতা মানবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আরেকটা লড়াই করতে চাই, যার মধ্য দিয়ে দেশে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী শক্তির সমূলে উৎপাটন করা যায়।’
এমসিসিআইয়ের সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, ‘অর্বাচীন কিছু লোক বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে হামলা করেছে। জাতির জনককে অবমাননা করেছে। এটা জাতির জন্য লজ্জা ও চরম ধৃষ্টতার।’
তিনি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রতি হুঁশিযারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘ভবিষ্যতে এ ভুল আর করবেন না। সাবধান হয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি অপনাদের এই অপতৎপরতা রুখে দিতে মুক্তিযুদ্ধের মতো আরেকবার গর্জে উঠতে প্রস্তুত।’
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘প্রগতিশীল বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির জাতিসত্তা নিয়ে এই বিভক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি ব্যাহত করবে। আমরা আশা করব, উন্নয়ন-অগ্রগতির স্বার্থে মৌলিক বিষয়ে সবাই এক কাতারে আসবেন।’
বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, সময় যখন এগিয়ে যাওয়ার, তখন এই পিছিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের দুর্বলতার কারণেই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দেয়ার সুযোগ পায়। তারা প্রায়শ ধর্মের দোহাই দিয়ে এটা-সেটা কায়েম করতে চায়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এক হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না।
ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ উন্নয়নের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতা ভুলে সবাইকে উন্নযনের কাতারে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম থেকে ভার্চুয়ালি এই মানবন্ধনে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এই অপচেষ্টা। সারা দেশের ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপচেষ্টা রুখে দেবে।
বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনই হয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর। কিন্তু স্বাধীন দেশে এখনও কিছু সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী লোকের হুংকার শোনা যায়। এ ধরনের অপতৎপরতা যারা চালাচ্ছে, তারা দেশের স্বাধীনতাকেও মেনে নিতে পারেনি, যার কারণে আজকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর এই আঘাত। দেশের ব্যবসায়ী সমাজ উগ্র মৌলবাদীদের এই কালোহাত ভেঙে দিতে প্রস্তুত।’
বাংলাদেশ ডাইড ইয়ার্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সালাউদ্দিন আলমগীর বলেন, ‘মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা রুখে দিতে দেশের চার কোটি ব্যবসায়ী আজ এফবিসিসিআইএর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। আপনারা সাবধান হন। নয় তো পরিণতি ভালো হবে না।’
বেসিস সভাপতি আলমাস কবির বলেন, দেশ যখন জ্ঞানভিত্তিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের জয়গান বিশ্বজুড়ে আলোচিত হচ্ছে, তখন মৌলবাদীদের সাম্প্রদায়িকতার ডাক ও অপতৎপরতা জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করবে।’
এ সময় দেশপ্রেমের স্বার্থেই এ হীন অপতৎপরতা থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।
কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
গত ৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর করে দুই মাদ্রাসাছাত্র। এ ঘটনায় ওই দুই ছাত্র ও দুই শিক্ষককে রিমান্ডে পায় পুলিশ।
রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে ইসলামপন্থি বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটে।
ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনার পর ৭ ডিসেম্বর হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির ফয়জুল করীমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আবেদন নেয় ঢাকার বিচারিক আদালত।
মামলার তদন্ত করতে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেয়া হয়।
ভাস্কর্য ইস্যুতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নামেও মামলার আবেদন করা হয়েছিল বিচারিক আদালতে। তবে আদালত সে আবেদন গ্রহণ করেনি।