পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর প্রস্তুতি যখন চূড়ান্ত, ঠিক সে সময়ে ২০১২ সালের জুনে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। একই পথ অনুসরণ করে প্রকল্প থেকে একে একে সরে দাঁড়ায় এডিবি, জাইকা ও আইডিবি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘দুর্নীতিচেষ্টার’ কল্পিত এক অভিযোগ এনেছিল বিশ্বব্যাংক। তবে সেই অভিযোগ প্রমাণ হয়নি কখনোই, এমনকি ২০১৭ সালে কানাডার একটি আদালতের রায়ে বলা হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন।
বিদেশি সংস্থাগুলো সরে যাওয়ার ঘোষণায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে পুরো প্রকল্প। আর সেই কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। তৈরি হয় বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর বর্ণাঢ্য অধ্যায়।
যেভাবে প্রকল্পের শুরু
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে পদ্মায় সেতু তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়। ২০০৭ সালে একনেকে অনুমোদন পায় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকার প্রকল্প। তবে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দায়িত্ব নিয়েই পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগের অনুমোদন দেয় তারা।
ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মাথায় পদ্মা সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধন করে সরকার। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা অনুমোদন দেয়া হয়। ২৮ এপ্রিল ঋণচুক্তি সই হয় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে। একই বছরের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়।
পদ্মা সেতু নির্মাণ চুক্তিতে সই করছেন বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি। ছবি: ফোকাস বাংলা
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ
সবকিছুই গুছিয়ে যখন কাজ শুরুর অপেক্ষা, তখনই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগ আনে অর্থের মূল জোগানদাতা বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের কাছে দুর্নীতির অভিযোগটি গিয়েছিল ই-মেইলে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প তদারকির জন্য প্রাক নির্বাচনি তালিকায় থাকা কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের ‘দুর্নীতি’ তদন্তে বিশ্বব্যাংক কানাডা পুলিশকে অনুরোধ করলে বিষয়টি প্রকাশ্য হয়। ২০১২ সালের জুনে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। পরে একে একে সরে দাঁড়ায় এডিবি, জাইকা, আইডিবি।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে বলা হয়েছিল, পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে এসএনসি-লাভালিনের কাছে ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন চেয়েছিলেন তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া এবং পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম। প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৭০ লাখ ডলার।
তবে এ অভিযোগ দৃঢ ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মূল সেতুর পাইলিং ও নদীশাসনের কাজ উদ্বোধন করেন।
রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে (আরসিএমপি) দুর্নীতির খবর জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (আইএনটি) বিভাগ। এ নিয়ে কানাডার আদালতে মামলা হয়। অর্থের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে এসএনসি-লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে ডুহাইমকে গ্রেপ্তার করে কানাডার পুলিশ। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয় প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তা রমেশ শাহ ও মো. ইসমাইলকে।
তবে ২০১৭ সালে কানাডার একটি আদালতের রায়ে বলা হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি। বিশ্বব্যাংকের তোলা ঘুষ লেনদেনের যড়যন্ত্রের অভিযোগ সঠিক নয়।
তবে অভিযোগটি তোলার পর প্রবল সমালোচনায় মুখর হয় দেশের প্রথম সারির কিছু সংবাদমাধ্যম। কোনো প্রমাণ ছাড়াই দিনের পর দিন কল্পিত অভিযোগের ভিত্তিতে তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ অবস্থায় মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে। হাজতবাস করতে হয়েছে সেতু বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা এবং সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা করে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে দুদকের চূড়ান্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়, দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপর সেতু সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দেন আদালত।
কানাডার আদালত যা বলেছে
২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ না পেয়ে তা খারিজ করে দেয় কানাডার টরন্টোর এক আদালত। মন্ট্রিয়লভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে নির্দোষ বলে খালাস দেয়া হয়।
কানাডার সংবাদপত্র টরেন্টো স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, রায়ের আদেশে বিচারক বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়। কানাডার সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ইয়ান নর্দেইমার এ রায় দেন।
এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পাঁচ কোটি ডলারের কাজ পেতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ২০১০ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের সেতু কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনা করেন।
টরন্টো স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক অভ্যন্তরীণ চার গোপন সংবাদদাতার খবরের ভিত্তিতে এই অভিযোগ এনেছে বলে আদালতকে জানায় রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি)। এই চার জনের মধ্যে আরসিএমপি এক জনের বক্তব্যকেই আমলে নিয়েছে। বাকি তিন জনের সঙ্গে তারা কখনও কথা বলেনি। আর ওই এক জনের সঙ্গেও তারা কথা বলেছে টেলিফোনে।
আদালতে উপস্থাপিত নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধিকাংশ তথ্যই ‘২ নম্বর তথ্যদাতা’র কাছ থেকে সংগৃহীত। কিন্তু পুলিশ কখনোই ওই তথ্যদাতাদের সঙ্গে কথা বলেনি। আবার ২ নম্বর তথ্যদাতা আসলে প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। তিনি নিজেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিয়েছিলেন এবং কাজ পাওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন।
রায়ে বিচারক ইয়ান নরডেইমার বলেন, আদালতে গুজব বা অনুমানকে সমর্থন করার মতো কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়নি। যেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তা ‘ধারণানির্ভর’।
বিচারক বলেন, যেসব আড়িপাতা তথ্য হাজির করা হয়েছে, তা হাস্যকর। এর ভিত্তিতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।