নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ কেবল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের শক্তি অর্জনের প্রমাণ নয়, পাল্টে দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরনও।
বড় বড় প্রকল্প বাংলাদেশ এখন নিজেই করে ফেলতে পারে- বিষয়টি প্রতিষ্ঠত হওয়ার পর অর্থায়নের আলোচনায় কমে এসেছে দাতাদের খবরদারি।
এই প্রকল্পে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ গালগপ্প বলে কানাডা আদালতের রায়ের পর বিশ্বব্যাংক এখানে ফিরতেও চেয়েছিল। কিন্তু সরকার ঋণের টাকায় প্রকল্প করবে না জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন একটা সময় ছিল যখন বিদেশি ঋণ ছাড়া চলত না। এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যাচ্ছে দেশ।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বছরে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ আসছে, তা জিডিপির দুই শতাংশ। জাতীয় আয় বাড়ছে, গতিশীল হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফলে আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে।’
জায়েদ বখত বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অবশ্যই ঋণ নিতে হবে। তার জন্য দরকষাকষির সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।‘
দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ এনে দেশের সবচেয়ে বড় সেতু প্রকল্প থেকে প্রথমে বিশ্বব্যাংক, পরে এডিবি, আইডিবি ও জাইকার সরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নিজ অর্থে সেতু করার কথা বলেন, তখন বাংলাদেশ এই চাপ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের কথা বলেন দেশের বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ।
সে সময়ের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, নিজ অর্থে এই সেতু নির্মাণ হলে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প থমকে যাবে।
কিন্তু শেষ স্প্যান বসানোর অপেক্ষায় থাকা এই সেতু নিয়ে সংশয় বহু আগেই কেটে গেছে। এখন অপেক্ষা শুধু সেতুর উপরে সড়ক আর নিচ তলায় রেলের কাজ শেষ করার।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরিতে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছিল সরকার। শুরুতে ২৯০ কোটি ডলারের নেয়া এই প্রকল্পে তাদের ঋণ দেয়ার কথা ছিল ১২০ কোটি ডলার।
এ ছাড়া ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি ও আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেয়ার জন্য চুক্তি করে সরকারের সঙ্গে। বাংলাদেশের দেয়ার কথা ছিল ৫৫ কোটি ডলার।
বিলম্ব, নকশা পরিবর্তনসহ নানা কারণে সেতুর ব্যয় বেড়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর এটা টাকা খরচ হচ্ছে ২০১৫ সাল থেকেই। কিন্তু এ কারণে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ কমাতে হয়েছে এমন নয়।
বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলে এই সেতুতে অর্থায়ন স্থগিতের কথা বলে, তখন বাংলাদেশ বারবার ছাড় দিয়ে সংস্থাটিকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে।
সেতু সচিবসহ ছয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রধান আসামি করে মামলাও করে। গ্রেফতারও করা হয় তাদেরকে।
পদ ছাড়েন সেই সময়ের যোগযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন।
যদিও পরে কানাডার আদালতে প্রমাণ হয়ে যায়, এই অভিযোগ ছিল বায়বীয়।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ তোলে, একই অভিযোগ জমা দেয় সে দেশের আদালতেও। কিন্তু বিচারক সে অভিযোগে বিরক্ত হয়েছেন। বলেছেন, এটা গালগপ্প।
বিশ্বব্যাংক এক পর্যায়ে সরকারকে বলেছে, এই সেতু প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার তাদের জন্য ভুল ছিল। আর যে ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল, সেই পরিমাণ অর্থ অন্য প্রকল্পে দিয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়ন সহযোগীরা যা বলবে তাই মানতে হবে, সেই অবস্থা এখন আর নেই। অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে।’
উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পদ্মা প্রকল্প থেকে অনেক কিছু শিখেছি আমরা। দরকষাকষির ক্ষেত্রে অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে চাইলে এখন যে কারও কাছে থেকে ঋণ নেয়া যাবে। তবে এক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের স্বার্থ এবং সঠিক দাম। তা হলে কোনো ঝুঁকি থাকবে না।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘দেশের উন্নয়নের চাহিদা বাড়ছে। ফলে বিদেশি ঋণের দরকার আছে। তবে উন্নয়ন সহযোগীদের খবরদারি করা উচিত নয়। তাদের চাপিয়ে দেয়া শর্ত মানা ঠিক হবে না। আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে।’
তবে উন্নয়ন সহযোগীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং গুণগতমান নিশ্চিত করতে সম্পৃক্ততাও জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
পদ্মা সেতু নির্মাণ চুক্তিতে সই করছেন বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি
যে যে শঙ্কার কথা উঠেছিল
বিশ্বব্যাংক অর্থ প্রত্যাহারের পর, অনেকেই ধারণা করেছিল সেতু আর হবে না।
নিজস্ব অর্থায়নে সেতু হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন ঘোষণার পর অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সামর্থ্য সরকারের নেই।
তখন যেসব শঙ্কার কথা বলাবলি হচ্ছিল, তার মধ্যে একটি হলো, সেতু তৈরিতে যে অর্থ ব্যয় হবে, তা পরিশোধ করতে হবে ডলারে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মুজদে টান পড়বে।
তবে এই শঙ্কা একেবারেই ভুল প্রমাণ হয়েছে। সেতু তৈরির কাজ শুরুর বছর ২০১৫ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার। সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলার।
আরও বলা হচ্ছিল নিজের টাকায় সেতু বানালে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। ফলে সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য খাতে বাজেটে বরাদ্দ কমবে। মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে এ শঙ্কাও।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশের উন্নয়ন বাজেট ছিল ৯৭ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছর পর বাজেটের আকার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট ধরা হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
গত ১০ বছরে দেশে মেগা প্রকল্প হাতে নেয়ায় বৈদেশিক ঋণ অবশ্য বেড়েছে। যদিও দেশের সার্বিক সম্পদের তুলনায় তা খুব একটা বেশি না।
বাংলাদেশের যে সক্ষমতা বেড়েছে বাজেটের দিকে তাকালে তার প্রমাণ মিলে। ৯০ দশকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বিদেশি ঋণের অংশ ছিল ৬৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২৯ শতাংশ।
অর্থাৎ বিদেশি ঋণ নির্ভরতা কমছে। বাড়ছে নিজস্ব সম্পদ আহরণ।
আর এর সঙ্গে সঙ্গেই কমে আসছে দাতাদের হম্বিতম্বি। এক সময়ে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হতেন। এখন গণমাধ্যমেও গুরুত্ব কমেছে এসব প্রতিষ্ঠানের।