সার্বক্ষণিক মাছ কেটে জীবিকা নির্বাহকারীদের একজন মো. স্বপন। তিনি রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারে মাছ কেটে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করেন।
সারা মাসে তার আয় ১৫ থেকে ২১ হাজার টাকা। তবে টানাটানির সংসারে এ স্বল্প আয়েও তিনি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন আরেকটি বাড়তি আয়ের কারণে। এ জন্য তাকে আলাদা শ্রম কিংবা অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় না।
স্বপন জানান, মাছ কাটার পর শুধু মাছের উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য হিসেবে পরিচিত আঁশকে তিনি সংগ্রহ করে রাখেন। প্রতিদিন গড়ে ১০ কেজি আঁশ সংগ্রহ করতে পারেন তিনি, যা দিনশেষে পরিচিত এক জনের হাতে তুলে দেন। এতেই মাস শেষে তার বাড়তি আয় যোগ হয় আরও সাত থেকে আট হাজার টাকা। এর মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহের পথটিকে সহজ করে নিয়েছেন।
বাজার পর্যায়ে স্বপনের মতো একই কাজ নিয়মিতভাবে করছেন আরও অনেকেই। সেটি শুধু রামপুরাতেই সীমাবদ্ধ নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাজধানীর বড় ২২টি বাজারসহ অন্তত অর্ধশতাধিক কাঁচাবাজারে এখন মাছের আঁশ সংগ্রহ হচ্ছে। সারা দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়ের সহস্রাধিক বাজারেও মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হয়।
মাছ কাটায় নিয়োজিতরাই শুধু এই আঁশ সংগ্রহ করছেন না। বাড়তি আয়ের আশায় বাজার পর্যায়ে অনেক মাছ বিক্রেতাও একই পথ ধরেছেন।
তারা নিজের মাছ ক্রেতার কাছে বিক্রির পর তা কেটে দিয়ে মাছের আঁশ জোগাড় করছেন। এতে সংশ্লিষ্টদের পরিবারেও বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে সহজ হচ্ছে।
মাছের আঁশ হচ্ছে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত এক ধরনের বর্জ্য পণ্য। তবে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে অর্থকরী পণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মাছের আঁশকে।
আরও বলা হয়েছে, পণ্যটি রফতানি হতে শুরু করায় দেশজুড়ে এ অর্থকরী পণ্যটি মাঠপর্যায় থেকে হাত বদলের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। রফতানিকারক পর্যায়ে মাছের আঁশ পৌঁছাতে মাঠপর্যায়ের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত, বাজারজাতকারীদের মধ্যে একটি নিবিড় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেছে। এর পাশাপাশি এই আঁশ থেকে রূপান্তরিত পণ্য উৎপাদনের প্রবণতাও বাড়ছে। ফলে দেশে মাছের আঁশের চাহিদা ও দাম দুটোই বাড়ছে।
শুরুর দিকে বাজার থেকে এই আঁশ প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। বর্তমানে প্রতি কেজি ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা ধরে ক্রয় করতে হচ্ছে। এটা ক্রমশ বাড়ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য (বাণিজ্যনীতি বিভাগ) শাহ মো. আবু রায়হান আল বেরুনী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাছের আঁশকে এখন আর বর্জ্য ভাববার কোনো সুযোগ নেই। দিনদিন এটি একটি অর্থকরী পণ্য হয়ে উঠছে। স্থানীয়ভাবে পাওয়া মাছের এই আঁশকে আমরা যত বেশি সংগ্রহ-সংরক্ষণের আওতায় আনতে পারব, তত বেশি অর্থমূল্য যোগ হবে অর্থনীতিতে।
‘সময়ের বিবেচনায় আমরা এই বর্জ্য পণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে সংগ্রহ পর্যায়ে সারা দেশে এর নেটওয়ার্ক আরও সম্প্রসারণে পরামর্শ রেখেছি। পাশাপাশি রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে এ পণ্য রফতানিতে ১৫ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব করেছি।’
যেভাবে সংগ্রহ করা হয়: স্থানীয়ভাবে মাছের আঁশ সংগ্রহ, সংরক্ষণ করা হয়। পরে প্রক্রিয়াজাতকরণের অংশ হিসেবে এসব আঁশ শুকানো হয়। এরপর চালুনিকরণ, অন্যান্য বস্তু অপসারণ, অবমুক্তকরণ, শ্রেণীবিন্যাসকরণ করা হয়। চুন বা ক্যালসিয়াম জাতীয় পদার্থও অপসারণ করা হয়। এরপর আমদানিকারকের চাহিদা অনুযায়ী প্যাকেটজাতকরণ করা হয়। সর্বশেষ রফতানিকারক কর্তৃক পণ্য রফতানি করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে প্রথম ধাপটি শুরু হয় মাছ কাঁটার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক স্বউদ্যোগ থেকে। সংগ্রহের পর এসব আঁশ সংরক্ষণকারীর কাছে করে বিক্রয় করা হয়। সংরক্ষণকারী হাত বদল করে বাজারজাতকারী ব্যবসায়ী বা রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মনোনীত এজেন্টের কাছে। এই এজেন্ট বা ব্যবসায়ীই মূলত রফতানিকারকের গুদামে মাছের আঁশ সরাসরি সরবরাহ করে।
বড় হচ্ছে রফতানির বাজার: মাছের আঁশ সাধারণত চীনে রফতানি করা হয়। প্রক্রিয়াজাতকালে ৫০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে প্রতি কেজি মাছের আঁশ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ১.৯ থেকে ২ ডলারে রফতানি হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছের আঁশের রফতানি মূল্য ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দুই কোটি ৯৩ লাখ ২৫ হাজার ডলার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২ হাজার ডলার বা চার কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি আয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ ৯০ হাজার ডলার বা ২৬ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে ৩০ কোটিতে উন্নীত হয়।
রফতানিতে মিলে যেসব সুবিধা: অপ্রচলিত পণ্য হওয়ার কারণে মাছের আঁশ রফতানিতে বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে আয়কর ও উৎসে আয়কর সুবিধা, বন্ডেড ওয়্যারহাউস, ডিউ্যটি ড্র ব্যাক, ব্যাক টু ব্যাক এলসি, ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি ও স্বল্প সুদ সুবিধা এবং রফতানি ঋণ গ্যারান্টি স্কীম সুবিধা।
কী হয় মাছের আঁশে: বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, মাছের আঁশে আছে কোলাজেন ফাইবার, অ্যামাইনো এসিড, গুয়ানিনি ও বায়ো অ্যাভসরবেন্স ক্যাপাসিটি ও-এর মতো কয়েকটি বিশেষ গুণ। ফলে এই আঁশ ও আঁশ দিয়ে তৈরি পাউডার ওষুধ শিল্প, প্রসাধনী শিল্প ও খাদ্যশিল্পসহ পরিবেশ সুরক্ষার রক্ষাকবচ পণ্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রশাসন শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল হচ্ছে মাছের আঁশ।
এর গুয়ানিনি উপাদানের কারণে লিপস্টিক ও নেইল পলিশের উজ্জ্বল্যভাব ধরে রাখা এবং মেকআপ ও ব্রাশ তৈরিতেও এটি কাজে লাগে। এ ছাড়া মাছের আঁশে ‘ও বায়ো অ্যাভসরবেন্স ক্যাপাসিটি ও’-এর উপস্থিতির কারণে আঁশ দ্বারা তৈরি পাউডার কপার ও সিসার মতো হ্যাভি মেটাল জাতীয় পদার্থের দূষণ রোধে খুবই কার্যকরী। কোলাজেন ফাইবার উপাদান শক্তি উৎপন্ন করে। রিচার্জেবল ব্যাটারিতে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্নে চীন ও জাপান এ আঁশ ব্যবহার করে।
মাছের আঁশে কোলাজেন থাকায় কৃত্রিম কর্ণিয়া ও কৃত্রিম হাড় তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। অ্যামাইনো অ্যাসিডের উপস্থিতির কারণে মাছের আঁশের পাউডার বিভিন্ন দেশে স্যুপের সঙ্গে পুষ্টি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সংগ্রহের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ: বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন তাদের সমীক্ষায় দেখিয়েছে, প্রতিদিন ২৫ টন মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বর্তমানে রফতানিকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন বিভিন্ন বাজার থেকে ১০ টন করে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে থাকে। এতে প্রতি মাসে ৩০০ টন মাছের আঁশ রফতানির জন্য প্রস্তুত করা হয়।
তবে স্থানীয় বাজারে পাওয়া মাছের আঁশ সম্পূর্ণরূপে রফতানি উপযোগী করা গেলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রতি মাসে ৭৫০ টন। স্থানীয়ভাবে এর মূল্যসংযোজনের হার ৯৩. ৫০ শতাংশ।
চ্যালেঞ্জ কী: কৃষি শুমারি ২০০৮ এর হিসাব বলছে, দেশে পরিবারের সংখ্যা দুই কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৩টি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে এ পরিমাণ পরিবারের মাছের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন ৩৮ লাখ টন মাছের। এসব মাছের অন্তত ৪০ শতাংশের বহিরাবরণই আবৃত থাকে রুপালি আঁশে।
কাঁটার সময় এ আঁশ ছাড়ানো হয়। তবে কেনার পর খুব কমসংখ্যক বাজার থেকে মাছ কেটে বাসায় আনে।
সাধারণত বেশিরভাগ পরিবার পর্যায়ে মাছের এই আঁশ উচ্ছিষ্টাংশ বা বর্জ্য হিসেবে বাগাড়ে ডাম্পিং করে থাকে। ফলে এর অর্থমূল্য মিলে না। এভাবে প্রতি বছর কী পরিমাণ মাছের আঁশ বর্জ্য হিসেবে ডাম্পিং হচ্ছে। তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান এখনও মিলেনি।