আলোচনার শুরু পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের এক বক্তব্যে। জানালেন, কানাডায় অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে সরকার। আর এই পাচারে এগিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা। তবে কারা তারা? মন্ত্রী না বলার পর নাম চেয়েছে হাইকোর্ট।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, তদন্ত হবে; নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছে, ব্যবস্থা নেবে তারা; শুরু হচ্ছে অনুসন্ধান।
কিন্তু সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, তারা কারা, তার কোনো জবাবই মিলছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিউজবাংলাকে বলেন, নাম তারা জানাবেন না। দুদকের এক কর্মকর্তা বলছেন, আগেভাগে জানালে এটা হবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
কানাডার ‘বেগমপাড়ায়’ অর্থপাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে কয়েক বছর ধরেই। সেখানে কয়েকজন বাংলাদেশি এ নিয়ে আন্দোলনও করেছেন। তবে কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাস এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কাজ করেনি।
বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনার শুরু গত ১৮ নভেম্বর। সেদিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জানান, কানাডায় অর্থপাচারের প্রমাণ পেয়েছেন তারাও।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে। আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চার জন।’
এই ২৮ জন কারা? সচিবালয়ে যাওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখে নিউজবাংলা। মন্ত্রী কথা বলেন বড় জোড় ১৫ সেকেন্ড।
গত ২২ নভেম্বর তিনি বলেন, ‘কী করা যায়, তা আমরা দেখছি। এর বেশি কিছু এই মুহূর্তে বলার নেই।’
আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে মোমেন ধরেন লিফট।
তবে চুপ থাকার সুযোগ নেই। কারণ, হাইকোর্ট জানিয়েছে, আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দিতে হবে নাম, ঠিকানা। আদেশ এসেছে ২২ নভেম্বর। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, আদালতের এই আদেশ সহায়ক হবে দুর্নীতি রোধে।
দুই দিন পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান। বলেন, দুদক ব্যবস্থা নেবে, এই নির্দেশনা দিয়েছেন সরকারপ্রধান।
ঘটনাস্থল কানাডা। কী করবে দুদক?
যোগাযোগ করা হলে দুর্নীতি রোধে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান বলেন, এখনও বলা যাবে না বেশি কিছু।
দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, এখনও কোনো অনুসন্ধান কমিটি হয়নি। তবে অর্থপাচারে জড়িতদের তালিকা চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছে তাদের মানিলন্ডারিং ইউনিট।
ওই চিঠিতে বিনিয়োগকারী হিসেবে যারা কানাডায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাদেরও তথ্য চাওয়া হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী নিউজবাংলাকে বলেন, বিদেশে অর্থপাচারকারীদের তালিকা চেয়ে কোনো চিঠি দেয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা দুদক।
তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় এসব নিয়ে কাজ করি। পত্রপত্রিকায় খবর এলে বা কোনো সংস্থা থেকে তথ্য চাওয়া হলে আমরা তখন সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে থাকি।’
বিষয়টি নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘নো কমেন্ট ইজ মাই কমেন্ট।’
পরে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তো সকল ব্যাপারেই বলে থাকেন বা বলেছেন। এটা জেনারেল অর্ডার বা ইনস্ট্রাকশন ফ্রম দ্য অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার।’
তদন্ত কাজের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে এই কমিশনার বলেন, ‘আমরা কাজ করছি।
‘দেশের মধ্যেই একটা তথ্য নিতে কত সময় লাগে, কত এজেন্সি, কত দফতরের সংশ্লিষ্টতা আছে। আর বিদেশে হলে বৈদেশিক আইন, আমাদের আইন এগুলো অনেক জটিল বিষয়। কাজেই এটা চলমান আছে। এটুকু বলা যাবে। এর বেশি বলা যাবে না।’
তদন্ত শেষ হতে কত সময় লাগতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা দিতে পারেননি মোজাম্মেল হক খান। বলেন, ‘এগুলো যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব, সেই চেষ্টা আমরা করব।’
অর্থপাচারে জড়িতদের পরিচয় জানতে চাইলে মোজাম্মেল বলেন, ‘এখনই নাম বলা সম্ভব নয়। কারণ তাতে মানবাধিকার লংঘন হবে।’
কেন মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে?
জবাব আসে, ‘কোনোভাবে এটাকে জাস্টিফাই না করে বলা হলে, তা হলে এটা তার জন্য অবমাননাকর হবে। আমি বলব যে, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এটা হিউম্যান রাইটসের বরখেলাপ হবে।’
অর্থপাচারে যাদের নাম এসেছে, দুদকের বিবেচনায় যতক্ষণ তারা অভিযুক্ত বিবেচিত না হবে, ততক্ষণ তাদের নাম প্রকাশ করা হবে না বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিবেচনায় যে অভিযুক্ত হতে পারে, এই ধরনের তথ্যাদি আমাদের কাছে পুরোপুরি আসতে হবে। এর আগে আমরা কারো নাম বলতে পারব না।’
তবে তাড়াহুড়ো করেছেন দুদকের এই কর্মকর্তা। ফলে দেশের বাইরের তদন্ত কীভাবে হবে, কানাডা সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, সে দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস কিছু করবে কি না, এই প্রশ্নগুলো তাকে করা যায়নি।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের কাছ থেকেও কারও নাম জানা গেল না। তবে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের নাম আসায় হতাশ। বলেন, ‘স্বভাবগত কারণ আর দেশপ্রেমের অভাবেই এমন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা।’
প্রতিমন্ত্রী জানালেন, মন্ত্রণালয়ের ‘ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং’ শাখা আছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে সেখানে শুনানি করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে মামলা করা হয় বা দুদককে জানানো হয়।
তবে কানাডায় যারা অর্থপাচার করেছেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রমাণ পেয়েছেন, তাদের বিষয়ে কোনো শুনানি হয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং’ শাখা।
নামের তালিকা প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কালো তালিকা প্রকাশের দায়িত্ব সংসদের।
‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যদি নামগুলো চায়, তাহলে তারা করতে পারবে। কিন্তু কালো তালিকা প্রকাশের বিধান মন্ত্রণালয়ের নেই।’
কানাডায় অর্থপাচার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরব হন বাংলাদেশিরা। তাদের একজন শওগাত আলী সাগর বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে এ নিয়ে আন্দোলন করছি। অনেক চেষ্টা করেছি। এটা করতে গিয়ে দূতাবাস আমাদের সাহায্য দূরের কথা, উল্টো আমাদের নিরুৎসাহিত করেছে।’