বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৪০২ কোটি ডলার বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
অর্থাৎ সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মাথা পিছু ঋণ দাঁড়ায় ২৬৬ দশমিক ৮ ডলার। টাকার অংকে যা ২২ হাজার ৬৭৮ টাকা।
সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে বৈদেশিক সহায়তা সম্পর্কে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। পরে গণমাধ্যমে বিষয়টি জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ছয় গুণেরও বেশি। আর এক বছরে বেড়েছে ছয় হাজার টাকার মতো।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার বছরে বিদেশি ঋণ ছিল ৭১২ কোটি ডলার।
গত বছর মাথাপিছু এই ঋণ ছিল ১৭ হাজার ১৩৬ টাকা।
অবশ্য ঋণ আকারে বাড়লেও মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় বাড়েনি খুব একটা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট বিদেশি ঋণ ছিল জিডিপির ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বর্তমানে তা ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বাড়ার কারণে এটি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সচিব। বলেন, ‘তার মানে আমাদের ডোমেস্টিক ইনভেস্টমেন্ট অনেক বেড়ে গেছে।’
সচিব জানান, ৯৭-৯৮ অর্থ বছরে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ কোটি ডলার। বর্তমানের তুলনায় ৬০ ভাগের এক ভাগ ঋণ হলেও তখনকার জিডিপির তুলনায় ঋণ ছিল ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
ইআরডির সঙ্গে বৈঠকের পর বৈদেশিক ঋণ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ব্রিফ করছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম
ঋণ বাড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় তা কোনো ঝুঁকি তৈরি করবে না বলেও মনে করেন সচিব।
তিনি বলেন, ‘ঝুঁকি সীমা হলো যখন আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ যখন জিডিপির ৪০ শতাংশ বা তার ওপরে চলে যায় তখন। কিন্তু ২০২০-এ আমাদের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ হলো ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর বৈদিশিক ঋণ পরিশোধ করছি জিডিপির ৫ দশমিক ৫ ভাগ।’
সচিব বলেন, “২০ শতাংশ পর্যন্ত ‘সেফটি রেঞ্জ’ থাকে। আমরা অনেক নিচে আছি। সুতরাং আমাদের ঝুঁকি নাই।”
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, বাংলাদেশ কখনও বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। তিনি বলেন, ‘এটা একটা বড় সাকসেস।’
যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ, সেটাতে কোনো সমস্যা দেখছেন না বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরই) এর নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনুসরও।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মাথাপিছু জাতীয় আয়ও বাড়ছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ বাড়লে অসুবিধার কিছু নেই। তবে এখন যেহেতু সরকারের রাজস্ব আয় তুলনামূলক কম, সেহেতু ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সরকাকে কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হতে পারে।’
আগে অনুদান আসত বেশি, এখন কম
সচিব জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বিদেশি অনুদান এসেছে বেশি, ঋণ এসেছে কম। তখন বিদেশি অর্থায়নের ৮৫ শতাংশ এসেছে অনুদান হিসেবে। ঋণ ছিল ৮ শতাংশ। তবে বাকি ৭ শতাংশ কোন হিসেবে এসেছে, তার ব্যাখ্যা দেননি তিনি।
সেই অবস্থাও এখন ঘুরে গেছে। এখন অনুদান আসে ঋণের অনেক কম।
আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় দফা ক্ষমতা গ্রহণের বছরে ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদেশি অর্থায়নের ৩০ শতাংশ এসেছে অনুদান হিসেবে। আর ঋণ হিসেবে এসেছিল ৭০ শতাংশ।
১০ বছরে অনুদানের পরিমাণ আরও কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে অনুদানের পরিমাণ গিয়ে ঠেকে মাত্র ৫ শতাংশে। আর ঋণের পরিমাণ ৯৫ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে অনুদান আরও কমে দাঁড়ায় তিন শতাংশে। আর ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৭ শতাংশে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এর অর্থ হলো আমরা ত্রাণের ওপর অত নির্ভরশীল নই। নিজস্ব দক্ষতার ওপর নির্ভর করছি।’
কার কাছ থেকে কত ঋণ
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, যত বৈদেশিক ঋণ তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিশ্বব্যাংকের। আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থা থেকেই মোট ঋণের ৩৭ শতাংশ নিয়েছে বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। মোট বিদেশি ঋণের ২৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ নেয়া হয়েছে এই সংস্থা থেকে।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা জাপানি উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংস্থা জাইকার অবদান ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপকভাবে অর্থায়ন করা চীনের অবস্থান জাইকার তিন ভাগের এক ভাগের কিছু বেশি। মোট বিদেশি ঋণের ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ নেয়া হয়েছে এই দেশটি থেকে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়নের কারণে রাশিয়ার অবস্থান পঞ্চমে উঠে এসেছে। এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রকল্পে অর্থায়ন করা দেশটি থেকে বাংলাদেশ মোট বিদেশি ঋণের ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ নেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে থাকা দেশটির কাছ থেকে।
মোট বিদেশি ঋণের ১ দশমিক ৩ শতাংশ নেয়া হয়েছে প্রতিবেশি ভারত থেকে। অন্যান্য সব দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।