ব্যবসা করার অনুমতি দেয় এক সংস্থা। আমদানি করার অনুমতি আরেক সংস্থার। আর আমদানি করা দ্রব্য গুদামজাত করার অনুমোদন দেয় ভিন্ন সংস্থা। তিনটি সংস্থাই বলছে, তারা অনুমতি দেয়া বন্ধ রেখেছে।
তবু দেশে রাসায়নিক বিস্ফোরক দ্রব্যের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে। আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের ব্যবসা, সংরক্ষণ বা গুদামজাতকরণের তৎপরতাও দমিয়ে রাখা যায়নি; বরং ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসার বিস্তার গুদাম থেকে ঠাঁই মিলেছে অনেক বাসাবাড়িতেও। এর বিস্তার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ঘটেছে।
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর থেকে এই ব্যবসার আর লাইসেন্স দেয়া হয়নি। এমনকি পুরোনো লাইসেন্সের নবায়নও সেই থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ।
২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অপর এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় ব্যবসার নতুন ট্রেড লাইসেন্স দেয়া বন্ধ করা হয়। একইভাবে রাসায়নিক ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় দাহ্য পদার্থ আবাসিক এলাকায় সংরক্ষণ বা গুদামজাতকরণের অনুমতি না দেয়ার এবং এসব ব্যবসার আগের লাইসেন্স বাতিলেরও সিদ্ধান্ত হয়।
নিমতলীর পর চুড়িহাট্টাতেও ঘটে বড় দুর্ঘটনা।
দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্যের বাণিজ্য দেখভালে দায়িত্বশীল কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। কোন প্রতিষ্ঠান বা কারা এই ব্যবসা চালানোর লাইসেন্স দিচ্ছে, তার দায়ও কেউ নিচ্ছে না।
এর সমাধান খুঁজতে গত ৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার অনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে ১৫টি মন্ত্রণালয়, সংস্থা, বিভাগ, অধিদফতরের একটি বৈঠক হয়। সংস্থাগুলোর কাছ থেকে রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ ব্যবসার এই নিয়ন্ত্রণহীন চিত্র উঠে আসে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন এসেছে নিউজবাংলার হাতে। এতে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দায় এড়াতে শুধু পারস্পরিক দোষারোপের চেষ্টা করেছেন।
অন্য মৌসুমের তুলনায় শীতকালে কেমিক্যাল বা বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি থাকায় আগাম সতর্কতার অংশ হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই সভার আয়োজন করে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সভায় অংশ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন বলেন, বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে নির্ধারিত সামান্য ফি দিয়ে আবেদন করলেই সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এসব পণ্য কোথায় মজুদ করা হবে, কী কাজে ব্যবহার করা হবে, তা মোটেই খতিয়ে দেখা হয় না। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে তিনি ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে ব্যবসা করতে না পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। তবে প্রয়োজন হলে ইস্যুকৃত আগের সব ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করে সংশ্লিষ্ট সব নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করে নতুনভাবে লাইসেন্স দেয়ার পক্ষে মত দেন জননিরাপত্তা সচিব।
এর জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী সভায় জানান, ২০১০ সালে নিমতলী দুর্ঘটনার পর থেকে সিটি করপোরেশন কোনো লাইসেন্স নবায়ন করছে না। নতুন লাইসেন্সও দিচ্ছে না। আগের লাইসেন্সধারীরাই এখনও ব্যবসা করে যাচ্ছে।
সভায় বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, কেমিক্যাল বা বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্যের লাইসেন্স দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর ব্যবসা পরিচালনা করার ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে থাকে সিটি করপোরেশন। আবার তা সংরক্ষণের জন্য গুদামে ধারণক্ষমতা সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেয় জেলা প্রশাসক।
তবে আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ অনুযায়ী, এসব দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। তবে কী পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য আমদানি করা যাবে, তা অনুমোদন করা হয় জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে।
মন্ত্রিপরিষদের সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব মো. কামাল হোসেন বলেন, দেশে আবাসিক এলাকা নির্দিষ্ট করা নেই। এখন বাণিজ্যিক এলাকাতেও মানুষ বাস করছে। আবাসিক এলাকায় নতুন ট্রেড লাইসেন্স প্রদান বন্ধ এবং রাসায়নিক ও পেট্টোলিয়াম জাতীয় দ্রাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ বা গুদামজাতকরণে বিধিনিষেধ থাকলেও তা প্রতিপালনে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালাতে বিস্ফেরক জাতীয় দ্রব্যের গুদামজাতকরণের বিষয়টি উল্লেখ নেই বলে এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের কোনো এখতিয়ার নেই।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান জানান, বিস্ফোরক পরিদফতর থেকে শুধু একটি অনাপত্তি নিলেই গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ করা যাচ্ছে। কিন্তু যত্রতত্র এ সিলিন্ডার মজুদ রাখা হচ্ছে। এর থেকে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
পুরান ঢাকায় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা রয়েছে জানিয়ে সভায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, নিয়মমাফিক দাহ্য বা বিস্ফোরক জাতীয় দব্যের ব্যবসা পরিচালনা হচ্ছে না বলেই এখানে প্রায়শ দুর্ঘটনা ঘটছে।