সারাক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকা কটূ গন্ধ নেই বললেই চলে। এক সময় হাজারও শ্রমিকের কোলাহলে মুখর থাকত যে এলাকা, সেটি এখন শান্ত। প্রধান-অপ্রধান সড়ক ও নালাগুলো আগের তুলনায় অনেকটা পরিচ্ছন্ন।
পথে পথে কাঁচা চামড়া পরিবহনের ঠেলাগাড়ি, চামড়াজাত পণ্য ও রাসায়নিক পরিবহনের ট্রাক অথবা পিকআপ ভ্যানের দেখা নেই। চা ও খাবারের দোকানগুলোও ভিড়শূন্য। কেবল ট্যানারি ভবনগুলোর ভেতরে রাখা দু-একটা পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতির আবছা ঝিলিক।
রাজধানীর হাজারীবাগের চামড়া শিল্প সাড়ে তিন বছর হলো সরে গেছে সাভারের হেমায়েতপুরে। এর আগে দীর্ঘ ৬৬ বছর ধরে এখানকার চামড়া প্রকিয়াজাতকরণ কারখানাগুলো এলাকার পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছিল।
পড়ে থাকা ট্যানারিভবনের অনেকগুলো এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গুদাম হিসেবে। হাতে গোনা দুই-একটা ভবনে সীমিত আকারে প্রক্রিয়াজাত চামড়া থেকে পণ্য উৎপাদন চলছে। বাকিগুলোতে কোনো কার্যক্রম নেই।
এই সময়ের মধ্যে ট্যানারি এলাকার শেরেবাংলা রোডের দুই পাশে নতুন করে গড়ে উঠেছে এক শর মতো চামড়াজাত পণ্যের ছোট-বড় দোকান। এসব ভবনের বেশিরভাগ আগে ব্যবহৃত হতো রাসায়নিক উপকরণের গুদাম ও বিক্রয়কেন্দ্র হিসেবে।
গত মঙ্গলবার হাজারীবাগের লেদার কেমিক্যাল ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেডের অফিস সচিব এস এম খালেদ জানান, ট্যানারি বন্ধ হওয়ার আগে এই এলাকায় পাঁচ শর মতো রাসায়নিকের দোকান ছিল। এখন টিকে আছে ৪০টা। কিছু দোকান সাভারে স্থানান্তরিত হয়েছে। বাকিরা ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।
দেশে সংগ্রহ করা পশুর চামড়ার সিংহভাগ প্রক্রিয়া করা হতো হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতে। ঊনিশ শ চল্লিশের দশকে নারায়ণগঞ্জে দেশের প্রথম ট্যানারি শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে। অল্প দিনেই এ শিল্পের পরিসর বাড়তে থাকায় পঞ্চাশের দশকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকার এ শিল্পকে হাজারীবাগে সরিয়ে নেয়।
এখানে প্রায় ৬০ একর জমিতে ২০৫টি ট্যানারি ছিল। এসব ট্যানারির একটিতেও বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ত। যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থা পিওর আর্থ ২০১৩ সালে বিশ্বের যে ১০টি এলাকাকে সর্বোচ্চ দূষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে, তার মধ্যে হাজারীবাগের নামও ছিল।
ট্যানারির বিরুদ্ধে পরিবেশদূষণের বিষয়টি প্রথমে আলোচনায় আসে ১৯৮৬ সালে। ওই বছর তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি দূষণকারী শিল্পখাত হিসাবে হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলোকে ‘লাল’ ক্যাটাগরিভুক্ত করে। দূষণ বন্ধে নানা সরকারি উদ্যোগের মধ্যে ২০০১ সালে নির্দেশনা আসে উচ্চ আদালত থেকেও। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাভারে চামড়া শিল্পনগরী করে সেখানে ট্যানারিগুলো সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার।
তবে ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট একনেক সভায় চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের অনুমোদন হলেও তার কাজ শেষ হতে এক যুগ পেরিয়ে যায়। এই দীর্ঘ সময়ে ট্যানারি সরাতে কারখানা মালিকদের তাগিদ দেওয়া হয় বহুবার। তাতেও কাজ না হওয়ায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৬ মার্চ উচ্চ আদালত ট্যানারিগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে আদেশ দেন। সে অনুসারে ওই বছরের ৮ এপ্রিল পরিবেশ অধিদপ্তর এসব চামড়া প্রক্রিয়াকরন কারখানার সেবা সংযোগ বন্ধ করে দিলে মালিকেরা সাভারে কারখানা সরিয়ে নিতে বাধ্য হন।
সম্প্রতি হাজারীবাগের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনেক দিন এখানকার কারখানাগুলোতে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়া করার কাজ বন্ধ থাকার কারণে এই এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। তবে এ বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা অথবা সমীক্ষার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
জিগাতলা থেকে গ্লাস ফ্যাক্টরি মোড় হয়ে ট্যানারি এলাকায় ঢোকার মুখে কোনো বদ গন্ধ এসে নাকে লাগেনি। ঢাকা ট্যানারি মোড়, শেরেবাংলা রোড, সনাতনগড়, গজমহল ও শিকারিটোলার মতো এলাকার পথঘাট ও নালাগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন।
তবে ট্যানারি এলাকার পশ্চিমপ্রান্তের হাজারীবাগ খাল দূষণের সেই স্মৃতি এখনও ধরে রেখেছে। খালপাড়ে কিছু ছোট ট্যানারি এখনও প্রক্রিয়াজাত চামড়া দিয়ে কাজ করছে। রাসায়নিক উপকরণের কিছু অংশ খালের ভেতরে পড়ছে। এছাড়া এই এলাকার গৃহস্থালি বর্জ্যের বেশিরভাগ এই খালের ভেতরেই ফেলা হচ্ছে। ফলে খালটির অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির বিপরীত পাশের একটি ভবনে বসবাসরত ব্যবসায়ী আজমল হক বলেন, ‘আগে আমরা এই এলাকায় কী অবস্থায় ছিলাম, তা এখন বুঝতে পারি। বাড়িতে কোনো আত্মীয়–স্বজন আসতে চাইত না। তীব্র দুর্গন্ধের কারণে পেটের অসুখসহ শ্বাস–প্রশ্বাসের সমস্যা লেগেই থাকত। এখন সেই পরিস্থিতি নেই বললেই চলে।’
গজমহল এলাকার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন আগের অবস্থার স্মৃতিচারণা করে বলেন, চারপাশে ঘনবসতি। মাঝখানে ছিল কারখানাগুলো। বিশেষ করে কোরবানির মৌসুমে চামড়ার গন্ধ অনেকদূর ছড়িয়ে পড়ত। বাতাস ভারি হয়ে থাকত সব সময়। এই এলাকা দিয়ে চলাচল করাটাই ছিল কঠিন একটা ব্যাপার। ফলে ট্যানারি শ্রমিক ছাড়াও এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মূল্য দিতে হতো আশপাশের সবাইকে।
পশ্চিমপ্রান্তে বেড়িবাঁধ পার হয়ে বুড়িগঙ্গার কাছে গিয়ে দেখা গেল, সেখানকার পরিবেশ অনেকটাই নির্মল। এই অংশে নদীতে তেমন কোনো বর্জ্য নেই। বর্ষা মৌসুমের কারণে পানির অবস্থাও ভালো। অথচ বুড়িগঙ্গা দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ট্যানারির বর্জ্য।
বদলায়নি শ্রমিকদের ভাগ্য
হাজারীবাগের ট্যানারি মোড় এলাকায় এখনও আছে এই খাতের শ্রমিক সংগঠন ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের কার্যালয়টি। সেখানে কথা হয় ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তার মতে, ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এই খাতের শ্রমিকেরা। কেউ চাকরি হারিয়েছেন। অনেক স্থায়ী শ্রমিক এখনও তাদের পাওনা টাকা বুঝে পাননি। আবার সাভারে যারা কাজ করছেন, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা সেখানে নেই। ফলে প্রতিদিন হাজারীবাগ থেকেই বেশিরভাগ শ্রমিকদের যাতায়াত করতে হচ্ছে। তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে পথ খরচে।
এ ছাড়া ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে আরেকটি বড় প্রভাব পড়েছে এখানকার ঠেলাগাড়ি চালকদের পেশায়। হাজারীবাগ ঠেলাগাড়ি বহুমুখী সমবায় সমিতির সদস্য গোলাম রসুল জানান, এই পেশায় প্রায় তিন হাজারের মতো শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। ট্যানারি সরে যাওয়ার পর এদের বেশিরভাগই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।