ঢাকার হাজারীবাগের শেরে বাংলা রোডের দুই ধারে সাড়ে তিন বছর আগে চামড়া কারখানাগুলো যখন গমগম করত, তখন সেখানে চামড়ার জুতা-জ্যাকেটের দোকান ছিল না বললেই চলে। এখন চামড়ার কারখানা সরে গেছে। কিন্তু সেখানে গড়ে উঠেছে চামড়াজাত পণ্যের ছোট-বড় ৭০টির বেশি দোকান। কেন?
চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও স্থানীয় বাসিন্দারা এ রহস্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জানান, হাজারীবাগে দীর্ঘ ৬৬ বছর ধরে চালু চামড়া বা ট্যানারির কারখানাগুলো যখন ২০১৭ সালে সরিয়ে নেওয়া হয় সাভারে, তখন এই স্থানান্তরের টানাপড়েনে অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাতে বেকার হয়ে পড়ে ট্যানারি শ্রমিকসহ কারখানাগুলোর বিভিন্ন বিভাগে কাজ করা বহু লোক। এরাই আস্তে আস্তে স্বল্প ভাড়ায় পরিত্যক্ত কারখানা ভবনের একটা দুটো করে কক্ষ ভাড়া নিয়ে শুরু করে চামড়াজাত পণ্য বিক্রির ব্যবসা।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ট্যানারি সরে যাওয়ার পর জায়গাগুলো অনেক দিন খালিই পড়ে ছিল। নতুন করে যারা এখানে দোকান দিয়েছেন, ব্যবসা খুলে বসেছেন, তাদের অনেকেই বিভিন্নভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কেউ শ্রমিক, কেউ ব্যবস্থাপক, কেউ টেকনিশিয়ান অথবা প্রকৌশলী।
এ ছাড়া হাজারীবাগে প্রক্রিয়া করা চামড়ার জোগানের ওপর ভিত্তি করে চকবাজার ও কেরানীগঞ্জের যে চামড়াজাত পণ্য তৈরির কারখানাগুলো চলত, সেখান থেকেও অনেকে চলে এসেছেন এখানে। ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় যারা চাকরি হারিয়েছিলেন, যারা সাভারে কাজ করতে যাননি, তাদের অনেকে এখানে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। ফলে দোকানের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন আবুল কালাম আজাদ।
গত বৃহস্পতিবার শেরে বাংলা রোডে চামড়াজাত পণ্যের কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা যায়, সেখানে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে পাকা চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা, চপ্পল, জ্যাকেট, অফিস ব্যাগ, ওয়ালেট, পার্স, বেল্ট, স্কুলের ব্যাগ ও মেয়েদের হাতব্যাগসহ বাহারি সব পণ্য। এ ছাড়া চামড়ার তৈরি মোবাইল ও ল্যাপটপ কাভার, চাবির রিং, খাবারের বাক্স বহনের ব্যাগ, টিস্যু বক্স, পাসপোর্ট হোল্ডার, ফটোফ্রেম এমনকি সোফার কুশন কাভারও। চলতি ফ্যাশনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পণ্যের রঙ ও বৈচিত্র্যে রয়েছে আধুনিকতার ছাপ। দামও তুলনামূলক কম।
‘ক্ল্যাসিক লেদার গুডস’ নামে এরকমই একটি দোকানের স্বত্বাধিকারী মামুনুর রশীদ আগে এখানকার কারখানাগুলোতে কাঁচা চামড়া সরবরাহ করতেন। তিনি বলেন, ‘কারখানাগুলোর কাছে আমার অনেক পাওনা টাকা ছিল। সবটা এখন পর্যন্ত আদায় হয়নি। সেই পাওনা টাকার বদলে এখন আমি কারখানা থেকে পছন্দের পণ্য নিয়ে আসি দোকানের জন্য।’
আবার কেরানীগঞ্জে চামড়ার ব্যাগ তৈরির কারখানার শ্রমিক থেকে এখন দোকানের মালিক বনে যাওয়া আলী হোসেন বলেন, ‘জায়গাটা আমার পরিচিত। ভাড়া কম। হাতে অল্প কিছু পুঁজিও ছিল। তাই রিস্কটা (ঝুঁকি) নিয়ে ফেললাম। এখন আমি নিজে ডিজাইন (নকশা) দিয়ে বিভিন্ন কারখানা থেকে মাল (পণ্য) বানিয়ে নেই।’
তবে ব্যবসায়ীদের আফসোস, অল্প কিছু পাইকারের বাইরে খুচরা ক্রেতাদের কাছে জায়গাটা এখনও পরিচিত হয়ে ওঠেনি। মাঝে বিক্রি কিছু বাড়লেও করোনার কারণে আবার ভাটা পড়েছে। তবে ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাঁরা খুবই আশাবাদী।
এসপি লেদার নামে আরেকটি দোকানের স্বত্বাধিকারী মো. সুমন বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে অল্প দামে পণ্য কিনে ঢাকার নামি-দামী মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি দামে বিক্রি করে। প্রচার না থাকায় জায়গাটা পরিচিত না হওয়ার কারণে খুচরা পর্যায়ে সেই পরিমাণ বিক্রি নেই। কিন্তু আমরা জানি এই দিন থাকবে না।’
‘নূর লেদার ক্র্যাফটস’ নামের একটি দোকানে পছন্দের হাতব্যাগ বাছাই করতে দেখা গেল ধানমন্ডি থেকে আসা সাব্বির হোসেনকে। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ এই শিক্ষক বলেন, ‘বছরখানেক আগে এক বন্ধুর কাছ থেকে জায়গাটির খোঁজ পাই। পরে এখান থেকে কয়েক দফায় অপেক্ষাকৃত কম দামে নিজের জন্য, পরিবারের সদস্যদের জন্য জুতা-স্যান্ডেলসহ বেশ কিছু জিনিস কিনেছি। এখানকার পণ্য সুন্দর, টেকসই। এখন পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতা ভালো।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ থেকে ট্যানারিজাত হয়ে জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ তৈরি পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই খাতে যুক্ত। আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের। এর মধ্যে চামড়াজাত পণ্য ২২ কোটি ৫ লাখ ডলারের।