করোনার প্রভাব কাটিয়ে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়েছে তৈরি পোশাক খাত। রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ প্রণোদনার ঋণের অর্থ দ্রুত ফেরত দিতে নারাজ পোশাক মালিকেরা। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ দুই বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করার দাবি তুলেছেন তারা।
শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য সরকারের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেয়েছেন পোশাক মালিকেরা। ঋণ পরিশোধের ১৮ কিস্তিকে পুনর্গঠন করে একই ঋণ ৬০ কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ চান তারা।
তাদের এই বাড়তি সময়ের প্রস্তাব মেনে নিতে সরকারের সংশ্লিষ্টমন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছে। বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন জানিয়েছেন, তারা ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে লিখিত সুপারিশ করবেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মোহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, পোশাক মালিকদের আবদারের শেষ নেই। তারা যা চাইবে, তাই হবে। আবার পায় বলেই বারবার চায়। যোগাযোগের ভিত্তিতেই এটা হয়। কারণ পোশাকখাতে সরকার-মালিক-রাজনীতি সব কিছুই একাকার হয়ে গেছে। সরকার তাদের আবদার পূরণ করতে পছন্দ করেন।
করোনা পরিস্থিতির সংকট মোকাবেলায় রফতানিমুখী পোশাকখাতকে সহায়তা দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এ প্রণোদনায় পোশাক শিল্প মালিকেরা সন্তুষ্ট থাকেননি। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ছাড় করা এই ঋণ তহবিল তারা চলতি বছরের এপ্রিল-মে দুই মাসেই শেষ করে ফেলেন।
এতে জুনের বেতন পরিশোধে সংকট তৈরি হয়। তখন পোশাক মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওই তহবিলে আরও ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দেয়া হয়। এরপর শিল্পমালিকেরা জুলাইতেও আবদার করেন আরও তিন হাজার কোটি টাকার। এভাবে মাত্র চার মাসের (এপ্রিল-জুলাই) ব্যবধানে পোশাক শিল্প মালিকেরা প্রণোদনার নামে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ নেন শ্রমিকদের বেতন ভাতার জন্য।
এই টাকাও প্রথম দফায় পোশাক মালিকেরা নেন সুদমুক্ত সুবিধায়, মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে। দ্বিতীয় দফায় ৯ শতাংশ সুদের মধ্যে ৭ শতাংশই সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। তৃতীয় দফার ঋণেও সাড়ে চার শতাংশ ভর্তুকি যাচ্ছে সরকারের। এভাবে একের পর এক নীতিসহায়তা পেলেও পোশাক মালিকদের দাবি থামছে না। এ পর্যন্ত নেওয়া ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণের প্রথম দফার কিস্তি আগামী নভেম্বর থেকে শোধ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে এ ঋণকে পরিকল্পিতভাবে দীর্ঘমেয়াদে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেনদরবার শুরু হয়েছে।
দফায় দফায় সুবিধা ভোগের পরও পোশাক শিল্প মালিকদের নতুন দাবি নিয়ে ওয়াকিবহাল মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকে ঋণখেলাপী হওয়ার তালিকায় পোশাক শিল্প মালিকরাই শীর্ষে। তাদের আশঙ্কা এই প্রণোদনা ঋণও একটা সময়ে খেলাপির কাতারে চলে যেতে পারে। দেখা যাবে এক সময় এটা মন্দ বা কু-ঋণে পরিণত হয়ে গেছে এবং ব্যাংকের ব্যালান্সশিট থেকেই মুছে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে মোট ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়, যার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাকখাতে। ২০১৬ সাল শেষে পোশাক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা, যা ২০১৭ সালে বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) তথ্যমতে, শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির ২৬ প্রতিষ্ঠানই পোশাক খাতের।
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘পোশাক শিল্প মালিকরা ভাল আছেন, এমন কথা আপনি কখনও শুনবেন না। তারা সব সময় সংকটের কথা বলেন। দুর্দিনে তারা সমস্যার কথা বলবেন, প্রতিকার বা নীতি সহায়তা চাইবেন এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃসময় কাটিয়ে উঠলেও তারা এই চাওয়ার মনোভাব পরিবর্তন করেন না।’
তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে পোশাকখাতে মার্চ-মে পর্যন্ত সময়ে একটা সংকট ছিল। এখন সেই সংকট নেই। ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবির) পরিসংখ্যানও বলছে, জুলাই-আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে রপ্তানিতে তারা উপর্যুপরি প্রবৃদ্ধি করছেন। সব কিছু স্বাভাবিক চলছে। এখন কেন তারা ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় চাইবেন?’
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ শতাংশের কাছাকাছি (শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ)। এখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি (২ দশমিক ৯ শতাংশ)। জুলাই-সেপ্টেম্বর তিনমাসে ৮০৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে পোশাক রফতানি হয়েছে ৮১২ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের।
গত বছরের একই সময়ে পোশাকের রফতানি ছিল ৭৯৬ কোটি ডলার। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম তিন মাসের মোট রফতানি আয়ের ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ এসেছে তৈরি পোশাকখাত থেকে।
সক্ষমতা থাকা সত্বেও কেন বাড়তি সময় চাইতে হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র সভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘টাকা কেউ না দিয়ে থাকবে না। তার সুযোগও নেই। সবাই টাকা পরিশোধ করবেন। শুধু তা পরিশোধের সময় বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। যারা এটা ভিন্নভাবে দেখছেন বা দেখার চেষ্টা করছেন, তাদের মনে রাখতে হবে দেশের অর্থনীতি এ খাতটির উপর দাঁড়িয়ে। এখানে ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান রয়েছে। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতেও এ খাত মুখ্য ভূমিকা রাখছে। সরকারকে বড় অংকের রাজস্ব দিচ্ছে। পিছিয়ে নেই সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর) খাতেও। তাই এ খাতকে কারও অবহেলার সুযোগ নেই।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাস্ক ও পিপিইর নতুন সংযোজনের ওপর ভর করে রফতানি কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি এখনও তলানিতে। সার্বিক পোশাক রফতানি এখনও সন্তোষজনক নয়। কারণ রফতানির বৈশ্বিক গতিপ্রকৃতি এখনও স্থিতিশীল হয়নি। আমরা এখনও অস্থির সময় পার করছি। তাছাড়া সামনে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার আশঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে ক্রেতারা উদ্বিগ্ন। তারা পরিস্থিতি দেখে ক্রয়াদেশ দেবেন।’
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নেতৃবৃন্দ খাতসংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বিবেচনায় ঋণের কিস্তি পরিশোধে ৬ মাসের গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা বাড়িয়ে এক বছর এবং ১৮ কিস্তির পরিবর্তে ৫ বছর মেয়াদী ৬০ কিস্তিতে পরিশোধের সুবিধা চাওয়া হয়েছে, যা তারা লিখিতভাবেও উপস্থাপন করেছেন। বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিনের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে অংশ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
অন্যদিকে খাতসংশ্লিষ্টদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফোডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রি (এফবিসিসিআই) এবং রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ প্রতিনিধিরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সোমবার রাতে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগামী নভেম্বর থেকে ঋণের প্রথম কিস্তি শুরু হচ্ছে। তার মানে হচ্ছে, এপ্রিল-জুলাই পর্যন্ত প্রতি মাসে যে উদ্যোক্তা গড়ে এক কোটি টাকা হারে মোট চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করেছেন, তাকে ১৮ কিস্তির হিসাবে প্রতিমাসে ২২ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। বড়দের হিসাবে এই পোর্টফোলিওটা আরও বড়। বিশ্বব্যাপী একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এতো বড় একটা ইনস্টলমেন্ট যে কোনো উদ্যোক্তার পক্ষে নিয়মিত শোধ অসম্ভব। তাই প্রস্তাব অনুযায়ী এটা ৬০ কিস্তি করা হলে তা ২২ লাখ টাকার পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৫-৭ লাখ টাকায় নেমে আসবে। এটা সবাই পরিশোধ করতে পারবেন। এতে বহুমুখী সুফল আসবে। উদ্যোক্তারা খেলাপী হবে না। ব্যাংকগুলোর তহবিলেনিয়মিত টাকা জমা হবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন এই ঋণ পরিশোধে অক্ষম। কারণ এখন যে রফতানি হচ্ছে, তার বিল পাওয়া যাবে আগামী ছয় মাস বা ১৮০-১৯০ দিন পর। আবার করোনার আগের তুলনায় এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের দাম ১০ শতাংশ কমে গেছে। এ অবস্থায় প্রণোদনার আওতায় নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি মূল্য আগের তুলনায় ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হবে। সেক্ষেত্রে এখনকার তুলনায় তৈরি পোশাকের রফতানি মূল্য ১৫ শতাংশ বাড়তে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মূল্য উল্টো কমানো হচ্ছে।’