করোনাকালে অনেকটাই গতিহীন অর্থনীতি। ঋণ বিতরণ কম, আদায়েও নেই আশানুরূপ অগ্রগতি। ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগের আয় কমেছে বছরের প্রথম ছয় মাসে।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনার কারণে ব্যাংকপাড়ায় রয়েছে অস্বস্তি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এক বছর ঋণের কিস্তি অনাদায়ী থাকলেও গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। এতে চলতি বছর মুনাফা কমে যায় কি না, সে শঙ্কায় ব্যাংকারা।
অবশ্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলছে, ব্যাংকগুলোকে এ বছর এমন কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা থেকে তারা অল্প খরচে ঋণ দিয়ে ভালো মুনাফা করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, সংগৃহীত আমানতের ওপর আগের মতো নগদ জমা ও বিধিবদ্ধ জমা রাখতে হচ্ছে না ব্যাংকগুলোকে। এই টাকা বন্ডে বিনিয়োগ করে ব্যাংক মুনাফা করছে।
তিনি আরও বলেন, বেশ কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে মাত্র এক শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এটা না করলে তো ব্যাংক এখন ঋণই দিতে পারত না। প্রণোদনা ছাড়া এখন কি কেউ ঋণ নিত? তাহলে তো ব্যাংকের মুনাফা আরও কমে যেত।
তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আমানতের ওপর সুদ ঠিকই দিতে হচ্ছে। কিন্তু খেলাপি না করার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় অনেক গ্রাহক ঠিকমতো কিস্তি দিচ্ছে না।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সাময়িকভাবে ব্যাংকের ব্যবসা কিছুটা কমে যাবে। ব্যবসায়ীরা ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। এটা একটা বাস্তবতা।’
‘ঋণ শুধু শুধু খেলাপি করলেই বা ব্যাংকের কী লাভ? বরং যদি সময় বাড়িয়ে দিয়ে ঋণটা আদায় করা যায়, তাহলে বাড়তি সুদ পাবে ব্যাংক।’
করোনা মহামারির প্রভাবে দেশের অর্থনতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার লক্ষ্যে গত ১৯ মার্চ প্রথম দফায় ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ছাড় দেয় সরকার। এতে কোনো গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি না দিলেও তাকে খেলাপি বলা যাবে না।
এই ছাড় ছিল চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত। করোনা ভাইরাসের এই প্রভাব বিদ্যমান থাকায় দ্বিতীয় দফায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং তৃতীয় দফায় ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে।
খেলাপি করার নির্দেশনা না থাকার পরও গত জুন ত্রৈমাসিকে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা হয়।
ছয় মাসে আয় কমেছে
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর ঘোষিত অর্ধবার্ষিকী বিবরণী অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে বেশিরভাগ ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের কমেছে ৫৪ শতাংশ।
প্রাইম ব্যাংকের ৩৮ শতাংশ, ইউসিবির ৩৪ শতাংশ, পূবালীর ৩৩ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংকের আয় কমেছে ২৭ শতাংশ।
মুনাফা কমার তালিকায় রয়েছে ইসলামী, এনসিসি, সিটি, মার্কেন্টাইল, আইএফআইসি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম মনে করেন, তাদের নির্দেশনা ব্যাংকগুলোর জন্য সুফল বয়ে আনবে। কারণ খেলাপি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা না থাকলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়ত। তখন ওই খেলাপি ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে একটি অর্থ জমা করে রাখতে হতো। এতে মুনাফা আরও কমত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে আটটি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ৮৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো বাংলাদেশ ব্যাংকই জোগান দিচ্ছে পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে। এক শতাংশ সুদে এই ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলো বিতরণ করছে। এই ঋণগুলো কেবল ভালো গ্রাহকরাই পাচ্ছে।
ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ফারুক মঈনউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ বছর খেলাপি বাড়বে না, কিন্তু আগামী বছর তো বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতারা কি এত অল্প সময়ে সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে?’