এত নায়িকার ভিড়েও নায়িকা সংকট! তবে বিষয়টাকে নায়িকা সংকট না বলে অস্তিত্ব সংকটও বলা যায়। মূলত নানা কারণে ঢাকাই ছবির নায়িকারা পড়ে ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে রয়েছেন। কিছুদিন আগেও যারা দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারাও এখন নানা কারণে আস্থা হারাচ্ছেন প্রযোজক-পরিচালক এমনকি দর্শকের কাছে। লগ্নিকারকরা খুঁজছেন পাশের দেশের নায়িকাদের। আর এসব ভিনদেশি নায়িকাদের আগমনের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন কিছুদিন আগের চাহিদাসম্পন্ন অভিনেত্রীরা। গত কয়েক বছর আগের জনপ্রিয় দেশি নায়িকারা তুমুল ব্যস্ত থাকলেও এখন তাদের বেশির ভাগই অভিনয় থেকে দূরে। কেউ বা আবার নায়ক সংকটের কারণে সিনেমায় কাজ করছেন খুব ঢিমে-তালে। আবার নতুনরা অভিষেকেই আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের নিয়ে কাজ করতে সাহস দেখাতে পারছেন প্রযোজক-পরিচালকরা। মৌসুমী, পূর্ণিমা, শাবনূর, পপির পর দর্শকের মনমতো হতে পারছেন না তার পরের প্রজন্মের নায়িকারা। গত কয়েক বছরে আলোচনা-সমালোচনায় কয়েকজন নায়িকার নাম উঠে এলেও তাদের হাতে রয়েছে নতুন ছবির সংকট। অন্যদিকে চলচ্চিত্রে নায়িকা সংকট। অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহি, ববি, বর্ষা, আইরিন সুলতানা, নূসরাত ফারিয়া ও পরীমনি দর্শকদের কাছে পরিচিত থাকলেও সুবিধা করতে পারছেন না। তাদের নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ ও সংশয়। চাহিদার চেয়েও বেশি সম্মানি হাঁকা, সিডিউল ফাঁসানোসহ নানা কারণে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে নির্মাতাদের কাছে।
আবার অনেকেই ইমেজ সংকটে পড়ে শখের চলচ্চিত্র ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশের মাটিতে। কেউ কেউ অঅবার বিয়ে করে রীতিমতো সংসারে মনোযোগী হয়েছেন। এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, দুবাইসহ অনেকেই স্থায়ী হয়েছেন। ব্যক্তিগত গুজব-গুঞ্জন, বিয়ে-বিচ্ছেদসহ আরও অনেক কারণে প্রতিষ্ঠিত এসব নায়িকারা নিজেদের ইমেজ হারাচ্ছেন। ফলে ভুগছেন অস্তিত্ব সংকটে। তাদের কারও কারও নাম শুনলেই দর্শকের মধ্যে যেন আতঙ্ক ভর করে। সিনেমা সংশ্লিষ্টদের মতে, গুটিকয়েক নায়িকা বর্তমানে সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। বাকিদের কোনো কাজ নেই। আলোচনায় থাকতে ব্যক্তিগত নানাবিধ বিতর্কিত ইস্যু সামনে নিয়ে আসছেন। এবারের ঈদুল-ফিতরেই মুক্তি পেয়েছিল দুই বাংলার নায়িকা নুসরাত ফারিয়ার একটি সিনেমা। আব্দুন নূর সজলের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছিলেন ‘জ্বীন-৩’ সিনেমায়। মুক্তির এক সপ্তাহ পরই সিনেমাটি সিনেপ্লেক্স থেকে নামিয়ে ফেলা হয়। ঈদের ব্যর্থ তিন নায়িকার তালিকায়ও রয়েছে এ নায়িকার নাম।
ঢালিউড কুইন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এক সময়ের ব্যস্ততম নায়িকা ছিলেন অপু বিশ্বাস। শাকিব খানের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি একাধারে ৭০টিরও অধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যেগুলোর অধিকাংশই ছিল ব্যবসাসফল। শাকিব খানের সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে, অপু বিশ্বাস তার সেই দর্শকপ্রিয়তা আর ধরে রাখতে পারেননি। বর্তমানে সিনেমায় খুব একটা দেখা যায় না তাকে। তবে বসে নেই তিনি, নতুন পরিচয়ে ইউটিউবার হয়ে অনলাইন কনটেন্টে মনোযোগী হয়েছেন। বলা যায়, অপু বিশ্বাস এখন ইউটিউবার। সিনেমা ছেড়ে সেদিকেই এখন বেশি ব্যস্ত তিনি। এ অভিনেত্রীকে সর্বশেষ ‘ট্র্যাপ : দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ ও ‘ছায়াবৃক্ষ’ নামে দুটি সিনেমায় দেখা গিয়েছিল। অপুর পরেই শাকিব খানের কাঁধে ভর করে ক্যারিয়ার শুরু করেন চিত্রনায়িকা শবনম ইয়াসমিন বুবলী। কিন্তু শাকিবের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ধুঁকে সংবাদ পাঠিকা থেকে নায়িকা হওয়ার বুবলীর ক্যারিয়ার। বলা চলে, নায়ক সংকটে পড়েছেন এই অভিনেত্রী। জুনিয়র নায়কদের সঙ্গে কাজ করলেও আগের মতো সুবিধা করতে পারছেন না বুবলী।
‘অগ্নি’খ্যাত নায়িকা মাহিয়া মাহি ক্যারিয়ারে ৩০টির অধিক সিনেমায় অভিনয় করলেও ববর্তমানে পুরোপরি বেকার সময় পার করছেন। হঠাৎ করেই সিনেমা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন তিনি। আওয়ামী লীগের হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নৌকার টিকিট না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। পরাজয় নিয়েই রাজনীতির মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। যদিও আবার সিনেমায় ফেরার চেষ্টা করছেন এ নায়িকা। কিন্তু আগের মতো আর তার তারকা ইমেজ নেই। দর্শকচাহিদা কমায় পাচ্ছেন না সিনেমার কাজ। তাকে সবশেষ ২০২৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শাকিবের ‘রাজকুমার’ সিনেমায় ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়েছেন অপরূপা সুন্দরী পরীমনি। আলোচনার চেয়ে সমালোচনা বেশি হয় তাকে নিয়ে। অভিনয়ের চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন ব্যক্তিজীবন নিয়ে। প্রেম-বিয়ে মামলা-হামলাসহ একাধিক কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত এ নায়িকা। সিনেমায় এখন তার ব্যস্ততা নেই বললেই চলে। কারণ, সিনেমায় দেখার চাইতে, দর্শক এখন তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে বেশি অভ্যস্ত। সম্প্রতি তরুণ এক গায়কের সঙ্গে প্রেমকাণ্ডে আলোচনায় রয়েছেন তিনি। এরকম নানা ইস্যুতে বিতর্কের জন্ম দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন এ নায়িকা। তাকে নিয়ে সিনেমা করাটাকেও একধরনের ‘রিস্ক’ মনে করছেন প্রযোজক পরিচালকরা। সর্বশেষ তাকে ‘মা’ নামে একটি সিনেমায় দেখা যায়।
পরীর মতো একই অবস্থা বিদ্যা সিনহা মিমের। কলকাতার নায়কের বিপরীতে অভিনয় করলেও নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারছেন না এই নায়িকা। এ ছাড়া আইরিন সুলতানা, অধরা খান, শিরিন শিলা, মিষ্টি জান্নাত, পিয়া জান্নাতসহ আরও অনেক নায়িকার কয়েক বছর আগে অভিষেক হলেও আস্থা অর্জন করতে পারেননি। তবে নিজেকে নায়িকা হিসেবে প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন পূজা চেরি। এই তালিকায় রয়েছেন তরুণ নায়িকা প্রার্থনা ফারদিন দীঘি। যদিও এখন পর্যন্ত নায়িকা হিসেবে কোনো ছবিই আলোচনায় আসেনি তার। এ ছাড়া জাহারা মিতু নামে এক মেয়ে নায়িকা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই ঝরে গেছেন অযাচিত কর্মকাণ্ডের কারণে। তালিকায় আরও অনেকেই রয়েছেন। নায়িকা নিপুণও রয়েছেন অস্তিত্ব সংকটে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন পরবর্তী তার সামাজিক অবস্থান এখন বলা যায় শূন্যের কোটায়।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে আগের নায়িকাদের মধ্যে যেমন চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা, অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রমপ্রিয়তা, ধৈর্য, সুশৃঙ্খলতা ছিল এখন তা নেই। এখনকার শিল্পীরা শিল্পী না হয়ে তারকা খ্যাতির পেছনে ছোটেন। যোগ্যতার চেয়ে সম্মানী বেশি দাবি করে বসেন বলেই গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন।