বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এত বাধার মুখে সিনেমা টিকবে কীভাবে?

  •    
  • ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৯:১৮

সিনেমা নির্মাণ থেকে শুরু করে দর্শকের কাছে সেটি পৌঁছানো পর্যন্ত পরিচালক ও প্রযোজককে যা করতে হয়, তা রীতিমতো যুদ্ধপরিস্থিতি। সিনেমা স্ক্রিনিং, টিকিট বিক্রির সঠিক হিসাবও পান না প্রযোজকেরা।

দেশে সিনেমা বানিয়ে তা দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পরিচালক-প্রযোজকের রীতিমতো দিশেহারা অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।

প্রি-প্রোডাকশন নিজেদের মতো করে কিছুটা করা গেলেও দৃশ্যধারণ, সিনেমা পরিবেশনা, বুকিং এজেন্ট এবং টিকিট থেকে প্রযোজকের প্রাপ্তি নিয়ে সিনেমার প্রযোজক ও নির্মাতাদের অনেকেই হতাশ।

সিনেমা স্ক্রিনিং, টিকিট বিক্রির সঠিক হিসাবও পান না প্রযোজকেরা। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন সমিতির সদস্য হতে খরচ, সিনেমা সেন্সর করাতে খরচের ধাক্কা।

বাংলাদেশে সিনেমা ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমকে ধোঁয়াশা বলেছেন হাওয়া সিনেমার নির্বাহী প্রযোজক শিমুল বিশ্বাস।

সম্প্রতি ক্রিয়েটিভ সামিট ফ্যাব ফেস্টে তিনি বলেন, ‘বিদেশে সিনেমা গেলে কোথায়, কতগুলো শো এবং কত জন দর্শক সিনেমাটি দেখেছে, সেগুলো সহজেই জানা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের সিঙ্গেলস্ক্রিনে এমন কোনো হিসাব আমরা পাই না। শুধু সিনেপ্লেক্সে থেকে পাওয়া যায়।’

শিমুল জানান, বাংলাদেশের ৮২টা সিনেমা হলে হাওয়া প্রদর্শিত হয়েছে, অথচ কতগুলো শো চলেছে সেটি জানা নেই নির্বাহী প্রযোজকের। অন্যদিকে বিদেশের হিসাব পুরোপুরি পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

শিমুল বলেন, ‘এক্স্যাক্ট হিসেবটা আছে আমার কাছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সিনেমাটা দেশের বাইরের ৩৯ হাজার ৫ হাজার ৪ জন দর্শক দেখেছেন। স্ক্রিনিং হয়েছে ১৪৭টা, ৫৪ অথবা ৫৬ থিয়েটারে।’

অনুষ্ঠানে নির্মাতা অমিতাভ রেজা বলেন, ‘সিনেপ্লেক্স ধরনের প্রেক্ষাগৃহ থেকে আমরা যে কাগজ পাই বা রিটার্ন পাই, সেটা আর কোনো হল থেকে কখনই পাই না।’

অমিতাভ বলেন, ‘বিনিয়োগগুলো সিকিউর করতে আমাদের এখানে ই-টিকেটিং ও সেন্ট্রাল সার্ভার প্রয়োজন। তা না হলে এগুলো সবসময় ধোঁয়াশাতেই রয়ে যাবে।’

টিকিটের দাম থেকে প্রযোজক যে টাকা পান, সেটাও অনেক কম বলে উল্লেখ করেন পরাণ সিনেমার পরিচালক রায়হান রাফি। দামাল সিনেমার পরিবেশনাতে তিনি যুক্ত ছিলেন।

ফ্যাব ফেস্টে রাফি বলেন, ‘আমি মূলত ৫০ লাখ টাকা দিয়ে পরাণ সিনেমা বানিয়েছি। প্রমোশন-মার্কেটিং খরচসহ সিনেমার বাজেট ৮৩ লাখ টাকা। সিনেমার গ্রস সেল ১৬ কোটি। এখান থেকে অন্তত ৮ কোটি টাকা প্রযোজকের পাওয়া উচিত, কিন্তু প্রযোজক পেয়েছেন ৩ কোটি টাকা।’

সিনেমা হলের টিকিটের দাম কত হবে, তা নিয়ে সরকারি কোনো নিয়ম এখনও নেই।

স্টার সিনেপ্লেক্সের বাংলাদেশের একটি সিনেমার টিকিটের দাম যদি হয় ৩৫০ টাকা, তার মধ্যে ভ্যাট ২৭ দশমিক ৬৬, হোল্ডিং ট্যাক্স ২১ দশমিক ৬৬, মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স ২১ দশমিক ৬৬, এসি মেইনটেনেন্স ১৩৪ দশমিক ৩৭ এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ম্যানেজমেন্ট বাবদ রাখা হয় ১৪৪ দশমিক ৪৩ টাকা।

এখান থেকে প্রযোজক পান ৩৫ টাকার মতো। ক্ষেত্রবিশেষে এ পরিমাণ অল্প কিছু কমে বা বাড়ে।

শ্যামলি সিনেমা হলে আবার নেই হোল্ডিং ট্যাক্স। সেখানে ৩০০ টাকার একটি টিকিটে ভ্যাট ৩৭ দশমিক ০১ টাকা, মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স ১৬ দশমিক ৩৫ টাকা, এসি, ই মেইনটেনেন্স ১৩৭ দশমিক ৬৪ এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ম্যানেজমেন্ট বাবদ রাখা হয় ১০৯ টাকা।

অমিতাভ জানান, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর কাছে তারা টিকিটের মূল্য থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স বাদ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। মন্ত্রীও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। তিনি আশা করছেন সিনেপ্লেক্সের টিকিটে যে হোল্ডিং ট্যাক্সটি রয়েছে সেটি উঠে যাবে। তবে সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে এখনও কিছু জানেনা বলে নিশ্চিত করেছে নিউজবাংলাকে।

ভারতে ১০০ রুপির বেশি দামের টিকিট থেকে সরকার জিএসটি বাবদ কাটে ১৮ শতাংশ। বাকি টাকার মধ্যে থেকে সিনেমা হল তার খরচ বাবদ রাখে একাংশ, আরেক অংশ দিয়ে দেয় পরিবেশক বা প্রযোজককে।

অমিতাভের দাবি, ‘প্রেক্ষাগৃহের টিকিট থেকে প্রযোজক যে টাকা পান, সেই শেয়ারটা বাড়াতে হবে এবং ডিজিটাল সিস্টেম চালু করতে হবে, যেন আমরা রিটার্নটা বুঝতে পারি।’

তিনি আরও বলেন, ‘হল মালিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম। তারা বলেন, সিনেমা তো নাই। যে সিনেমা হিট হচ্ছে, সেই সিনেমা থেকে টাকা না রাখলে আমরা পুরো বছর চলব কীভাবে।’

সিনেপ্লেক্সে মেইনটেনেন্স বাবদ এত টাকা ধার্য করার কারণ জানিয়ে এর চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান রুহেল বলেন, ‘আমাদের রিয়েল এস্টেট খরচ অর্থাৎ ফ্লোর ভাড়া অনেক বেশি। তাছাড়া কোয়ালিটি মেইনটেইন করতে আমাদের অনেক খরচ হয়ে যায়।’

একই অনুষ্ঠানে আয়নাবাজি সিনেমার নির্বাহী প্রযোজক এশা ইউসুফ জানান, গ্যারিসন সিনেমা হলের টিকিটের দাম থেকে ৬ টাকা পান প্রযোজক।

এশা বলেন, ‘যখন আয়নাবাজি মুক্তি পায়, তখন আমরা প্রেক্ষাগৃহে রিপ্রেজেন্টেটিভ পাঠাতাম। এটা দেখতে যে, টিকিট বিক্রির তথ্য ভুল দিচ্ছে কি না। তিন জন পাঠাতাম আমরা। যদি কোনো কারণে তারা জোট বাঁধত, তাহলে তো আর ঠিক তথ্য পেতাম না। অথচ তাদের পেছনে আমাদের খরচ করতে হয়। যে টাকা ইনকাম হয়, সেই টাকা তাদের দিতে হয়। সঙ্গে পোস্টার, ব্যানার সব আমাদের খরচেই পাঠাতে হয়। এগুলো মাথা নষ্ট করা অবস্থা।’

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘টিকিট থেকে পাওয়া অর্থ তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। হল মালিক, সরকার ও পরিবেশক/প্রযোজক। তাহলে হয়তো কিছু টাকা প্রযোজক পেতে পারেন। কিন্তু এর মধ্যে যদি আরও কয়েক পক্ষ চলে আসে, তাহলে সেটা আর সম্ভব নয়।’

এখনও রিপ্রেজেনটেটিভ সিস্টেম চালু আছে। হাওয়া সিনেমা যখন দেশের সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোতে প্রদর্শনের জন্য দেয়া হয়েছে, তখন রিপ্রেজেনটেটিভ পাঠাতে হয়েছে বলে জানান সিনেমার নির্বাহী প্রযোজক শিমুল বিশ্বাস।

রায়হান রাফি বলেন, ‘একজন নতুন পরিচালক পরিবেশকের কাছে গেলে দিশেহারা হয়ে যায়। এত নিয়ম, ওর কাছে যাও, তার কাছে যাও, ওকে টাকা দাও, তাকে টাকা দাও। নতুন পরিচালক এক মাস পাগল থাকে।’

এসব সমস্যার সঙ্গে আছে পরিচালক সমিতির সদস্য হওয়া, প্রযোজক সমিতির সদস্য হওয়ার ব্যাপার। প্রযোজক সমিতির সদস্য না হলে একজন পরিচালক-প্রযোজক তার সিনেমার সেন্সর ছাড়পত্র করাতে পারে না।

চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন থেকে সেন্সরের জন্য নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিতে চাইলে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার ক্ষেত্রে খরচ করতে হয় ১৫ হাজার টাকা। এর আগে সেই প্রযোজকের ১ লাখ ৩ হাজার টাকা দিয়ে হতে হয় প্রযোজক সমিতির সদস্য।

এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চলচ্চিত্র, সোশ্যাল ও নিউ মিডিয়া) ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সমিতির সদস্য হওয়ার কোনো দরকার নেই। তবে এক সময়ে প্রযোজকদের অনেকেই এফডিসিতে টাকা বাকি রেখে কাজ করেছেন। তারাই আবার এফডিসির বাইরে সিনেমা বানিয়ে সেন্সর করাচ্ছেন কি না সেটা ধরতেই এ পদ্ধতি।’

সিনেমার সেন্সর করাতেও রয়েছে খরচ। দৈর্ঘ্যের বিচারে হয় এসব খরচ। আদিম সিনেমার পরিচালক যুবরাজ শামীম জানান, তার সিনেমা সেন্সর করাতে লেগেছে ১৭ হাজার টাকা।

সব মিলিয়ে সিনেমা নির্মাণ থেকে শুরু করে দর্শকের কাছে সেটি পৌঁছানো পর্যন্ত পরিচালক ও প্রযোজককে যা করতে হয়, তা রীতিমতো যুদ্ধপরিস্থিতি।

অমিতাভ জানান, আয়নাবাজি সিনেমা মুক্তির পর তারা সিনেমা হল থেকে ৬৫ লাখ টাকা ফেরত পাননি। কারণ সেই টাকা অমিতাভকে না দিয়ে হল মালিকদের অনেকে বকেয়া বিদ্যুৎবিল দিয়েছেন। পরের সিনেমায় অমিতাভকে টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন অনেক হল মালিক।

সিনেপ্লেক্সগুলোতে নিজস্ব প্রজেকশন সিস্টেম থাকায় জটিলতা কিছু কম। তবে সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোতে সিনেমা প্রদর্শন করতে গেলে প্রযোজককেই দিতে হয় প্রজেক্টরের ভাড়া। হল মালিকের নিজস্ব কোনো প্রক্ষেপণ যন্ত্র নেই। সেটাও একটা বড় সমস্যা প্রযোজকদের জন্য।

অধিকাংশ সিঙ্গেল স্ক্রিনে জাজ মাল্টিমিডিয়া তাদের প্রজেক্টর বসিয়ে রেখেছে। সেই ভাড়ার টাকা তারাই পায়। এ নিয়ে অনেক প্রযোজক নেতারাই অনেক দিন ধরে কথা বলে আসছেন।

এ বিভাগের আরো খবর