বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তৌকীরের আলোচনায় অভিনয়াঙ্গন নষ্টের বর্ণনা, খুঁজছেন সমাধান

  •    
  • ৬ নভেম্বর, ২০২২ ১৮:৪৬

তৌকীরের মতে, ভবিষ্যতে যদি সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বাড়ে, চলচ্চিত্র ব্যবসা লাভজনক হয়ে ওঠে, তাহলে তরুণ নির্মাতাদের নতুন ধারার চলচ্চিত্রও হয়তো হতে পারে অভিনয়শিল্পীদের পেশার জায়গা। বর্তমানে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর আগমন শিল্পীদের আশাবাদী করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

দেশের টিভি নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন অভিনয়শিল্পী সংঘের আয়োজনে শনিবার জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাম্প্রতিক কাহিনিচিত্র ও অভিনয় বাস্তবতা’ শীর্ষক সেমিনার।

সেখানে অভিনয়াঙ্গনের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন দেশের বরেণ্য, গুণী ও জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীরা। সেমিনারে আলোচনার শুরু করেন অভিনেতা-পরিচালক তৌকীর আহমেদ।

তৌকীর তার আলোচনায় নাটক, ওটিটি, সিনেমার নানা সংকট এবং তাতে অভিনয়শিল্পীদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

তৌকীরের লেখা ৬ পৃষ্ঠার আলোচনায় প্রথম পৃষ্ঠায় তিনি কিছু ইতিহাস টেনে কথা বলেন। সমস্যার কথা তিনি উল্লেখ করেন দ্বিতীয় পৃষ্ঠা থেকে।

তৌকীর বলেন, ‘১৯৯৪ সালে বেসরকারি খাতে নাটক ও অনুষ্ঠান নির্মাণ এর সিদ্ধান্ত আমাদের আকাশ সংস্কৃতির দ্বারে নিয়ে যায়। আড়াই তিন লাখ টাকার প্রডাকশন নিয়ে পাল্লা দিতে হয় কোটি কোটি টাকার প্রডাকশনের সঙ্গে। প্রতিযোগিতার মধ্যেও অনেক প্রশংসনীয় নির্মাণ ও অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করে। কারণ, মানুষ তার নিজের ভাষায়, নিজের সংস্কৃতির গল্প দেখতে সব সময়ই পছন্দ করে। চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা, সাধারণ মধ্যবিত্তকে হলবিমুখ করেছে ইতিমধ্যে, বেসরকারি টেলিভিশনগুলো খুঁজে চলেছে মুনাফার রাস্তা। মূল্যবোধ আর নীতিবোধ তখন নির্বাসনে।’

তৌকীরের মতে, এরপর নাটকে নতুন একদল নির্মাতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যারা থিয়েটার বা বিটিভির উত্তরসূরি নন। এতে ভালো-খারাপ দুটিই হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তৌকীর।

তৌকীর বলেন, ‘বিষয়বস্তু বা প্রযোজনায় কিছু নতুনত্ব হাজির হলেও, অনেক সস্তা বিনোদন, অরুচিকর বিষয়বস্তু, ভাষার বিকৃতি, অশ্লীল ইংগিতময় দৃশ্যের আগমন ঘটে।’

যখন দর্শকের কথা বিবেচনা করে হাস্যরসাত্মক বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেতে শুরু করে, তখন পরিমিত কমেডির পাশাপাশি ভাঁড়ামোর অনুপ্রবেশ ঘটে বলে উল্লেখ করেছেন তৌকীর।

সেমিনারে উপস্থিত অতিথিরা। ছবি: সংগৃহীত

এই অভিনেতা-পরিচালক বলেন, ‘বেসরকারি টেলিভিশনগুলো টিআরপি নামের একটি প্রহসন হাজির করে। চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্ব ক্রমাগত অনুষ্ঠান বিভাগের হাত গলে বিপণন বিভাগের সিদ্ধান্তের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অভিনেতা-অভিনেত্রীর নিয়োগও তারা করতে শুরু করে। মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিলুপ্ত হতে থাকে, সঙ্গে আবার হাজির হয় এজেন্সির পুঁজি।

‘একসময় নাটকে কমতে থাকে চরিত্র, মূল চরিত্রের পর বাবা-মা বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অদৃশ্য হতে থাকে, কাহিনিচিত্রের পারিবারিক চেহারাটি হারাতে থাকে, গুটিকয় অভিনেতা বাদে বাদবাকি চরিত্রাভিনেতারা বেকার হতে থাকেন।’

বেসরকারি চ্যানেলগুলোর সংখ্যা, অনিয়ম, দুর্বলতা, দুর্নীতি চ্যানেলগুলোর সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করে বলে মনে করেন তৌকীর। তিনি আরও জানান, মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন বিরতি দর্শকদের টেলিভিশনবিমুখ করে। বাস্তবতা হলো টেলিভিশন নাটক তার দশর্ক হারিয়েছে, চ্যানেলগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। টেলিভিশন কাহিনিচিত্র এখন আর অভিনয়শিল্পীদের জন্য আকর্ষণীয় পেশা নয়। শুধু টিকে থাকা।

চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করে তৌকীর বলেন, ‘এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র দর্শকদের আস্থা হারিয়েছে আগেই। '৭০, '৮০-এর দশকের সিনেমা হলগুলোর অবস্থা সঙ্গিন, হয়নি কোনো রেনোভেশন, হাতে গোনা কয়েকটি সিনেপ্লেক্সে সিনেমার লগ্নীকৃত টাকা ওঠাতেই হিমশিম খাচ্ছেন প্রযোজক-নির্মাতারা। আমাদের টেলিভিশন ও মঞ্চের শিল্পীরা কখনোই এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রে পেশা তৈরি করতে পারেননি বা করতে চাননি। মূলত রুচি, শিক্ষা বা বিশ্বাসের যোজন যোজন পার্থক্যের কারণে।

‘গোলাম মুস্তাফা, শর্মিলী আহমেদ, ডলি জহুর, আবুল হায়াত, হুমায়ুন ফরিদী বা রাইসুল ইসলাম আসাদ কিছু নাম যারা বাণিজ্যিক ধারায় ব্যস্ত ও সফল হয়েছিলেন। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে সেটা তাদের শৈল্পিক বিশ্বাসের সঙ্গে আপস করেই।’

স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয়শিল্পীরা নিঃস্বার্থভাবে, কখনও বিনা পারিশ্রমিক বা নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন বলে জানান তৌকীর। বলেন, ‘সেটা শিল্পীদের কখনও কখনও তৃপ্তি দিয়েছে। স্বল্প বাজেটের এই সিনেমাগুলো শিল্পীরা কখনোই পেশা হিসেবে নিতে পারেননি।’

তৌকীরের মতে, ভবিষ্যতে যদি সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বাড়ে, চলচ্চিত্র ব্যবসা লাভজনক হয়ে ওঠে, তাহলে তরুণ নির্মাতাদের নতুন ধারার চলচ্চিত্রও হয়তো হতে পারে অভিনয়শিল্পীদের পেশার জায়গা। বর্তমানে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর আগমন শিল্পীদের আশাবাদী করেছে বলে উল্লেখ করেন তৌকীর।

তৌকীর বলেন, ‘ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো বাণিজ্যের লক্ষ্যে তাদের কনটেন্ট বানাচ্ছে। সামাজিক, রাষ্টীয়, জনতার জীবনমান বা চিন্তা-চেতনা নিয়ে তারা ভাববে না, তাদের সেই দায় নেই। তাদের আছে বিভিন্ন হিসাব, সাবস্ক্রিপশনের হিসাব, ভিউয়ের হিসাব, লাইকের হিসাব, আয়, ব্যয় লাভের হিসাব। ফলে কী দেখা যাচ্ছে। ওটিটির বেশির ভাগ কাহিনিচিত্রের বিষয়বস্তু ক্রাইম বা ডিটেকটিভ অ্যাকশন। ফলে অভিনয়ের সুযোগও কমে আসছে অভিনেতার।’

কতজন দেখছে এই পেইড প্ল্যাটফর্মগুলো? এর সঠিক পরিসংখ্যান এখনও নেই বলে মন্তব্য তৌকীরের। সচ্ছল ব্যক্তিরা নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই, চরকি দেখলেও নিম্নবিত্তের ভরসা ফ্রি ইউটিউব। সেখানে অনেক কিছুই পেয়ে যাচ্ছেন দর্শক।

তৌকীর বলেন, ‘ইউটিউব যেহেতু ভিউয়ের সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল সুতরাং ভিউ হতে পারে এমন কিছুই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কুরুচিপূর্ণ, স্কিড, নাটক, চলচ্চিত্র এখানে জনপ্রিয়। একই সঙ্গে আবির্ভাব হচ্ছে কিছু নির্মাতার, যাদের কাছে অর্থ উপার্জনই প্রধান, জনরুচি বা সামাজিক দায়বদ্ধতার কোনো বিষয় তাদের নেই। অশ্লীল ভাষা, কুরুচিপূর্ণ বিষয়বস্তু উপস্থাপন এখানে সবচেয়ে সফল।’

তৌকীর তার আলোচনায় বলেন, ‘কোয়ালিটি সিটিজেন তৈরি করার দায় কার, রাষ্ট্রের তথা সমাজের। আমরা সবাই তার অংশ। ক্রমাগত করপোরেট কালচারের অংশ হতে হতে শিল্পীরাও হয়তো হয়ে উঠবেন ওই করপোরেট মেশিনের নাট-বল্টু।’

আলোচনার শেষে তৌকীর বলেন, ‘অভিনেতার কাজটি তো সৃষ্টির, সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া তো সহজ নয়, কখনোই সহজ ছিল না। সৃষ্টির এই কঠিন পথে তার শক্তি তো সত্য, জীবনের সেই সত্যকেই তো তিনি পুনর্নির্মাণ করেন প্রতিনিয়ত, ফুটিয়ে তোলেন প্রতিটি চরিত্রের অন্তর আত্মা। সমাজ ও মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতাই তো তার শক্তি। সেই প্রকৃত শিল্পীদের পদচারণে মুখর হোক আমাদের অভিনয়াঙ্গন।’

সেমিনারে উপস্থিত অতিথিরা। ছবি: সংগৃহীত

সেমিনারের এ আলোচনা মূলত একটি ধারণাপত্র বলে নিউজবাংলাকে জানান অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান। তিনি বলেন, ‘আলোচনা শুরু করা হলো। এরপর সবার মতামত, সবার বক্তব্য নিয়ে আমরা মূল প্রবন্ধ তৈরি করব। যা হয়তো আমাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই আলোচনা শুধু অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে নয় বরং অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক, টিভি ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম নিয়ে।’

রওনক উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমরা ৫ বছর আগে অভিনয়কে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেছিলাম, সেটা হয়তো শিগগিরই বাস্তবায়ন হবে। সেমিনারের আলোচনাও একটা উদ্যোগ, যেটার ফল হয়তো আমরা অনেক দেরিতে পাব, কিন্তু এর উদ্যোগটা তো নিতে হবে। সুন্দর একটি সাংস্কৃতিক আবহ তৈরির লক্ষ্যেই আমাদের এই কর্মসূচি।’

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন মামুনুর রশিদ, জাহিদ হাসান, তারিন, জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, বৃন্দাবন দাস, সালাউদ্দিন লাভলু, অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবীব নাসিমসহ অনেকে।

এ বিভাগের আরো খবর