‘সাঁতাও একটি রংপুরি শব্দ। রংপুরি হলো একটি ভাষা, যার আইএসও কোড পাবেন উইকিপিডিয়ায়। অর্থাৎ এই ভাষাটি নিবন্ধিত। এই ভাষায় যারা কথা বলেন তাদের বসবাস বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারতে রয়েছে।’ প্রসঙ্গটি দিয়ে কথা শুরু হয় সাঁতাও সিনেমার পরিচালক খন্দকার সুমনের সঙ্গে।
নিউজবাংলাকে তিনি আরও জানান, ভাষার সঙ্গে সঙ্গে এদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস, পরিধান ও সংগীতে তারা তাদের নিজস্বতা বজায় রেখেছে।
লালমনিরহাটের তিস্তা বাজার, যেখানে বেড়ে ওঠা সুমনের। সেখানে তিনি রংপুরি ভাষাভাষী মানুষদের দেখেছেন। সুমন অবশ্য ‘দেখেছেন’ শব্দে সন্তুষ্ট নন। তার মতে, “আমার বেড়ে ওঠা তাদের সঙ্গে। আর আমি ‘তাদের’, ‘আমাদের’ বলে কিছু আলাদা করতে চাই না। আমি সেই অঞ্চলের মানুষ।”
এবার সুমনের কাছে জানতে চাওয়া হলো সাঁতাও শব্দের অর্থ। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সুমন বললেন, “সাঁতাও শব্দটির সঙ্গে সংখ্যা সাতের যোগসূত্র রয়েছে। সাত দিন ধরে চলমান কোনো ইভেন্টকে সাঁতাও বলা যায়। ধরেন, সাত দিন ধরে গান, সাত দিন ধরে ওষুধ খাওয়া। তবে সাঁতাওয়ের প্রচলিত অর্থ হলো ‘সাত দিন ধরে বৃষ্টি’।”
সাঁতাও সিনেমার দৃশ্য। ছবি: পরিচালকের সৌজন্যে
সাত দিন ধরে বৃষ্টির কথা শুনতেই কল্পনায় অনেক রকম দৃশ্য চলে আসতে পারে। যেমন, মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, একটা শব্দ হয়েই চলেছে কিন্তু যন্ত্রণা দিচ্ছে না, চারদিক ধূসররঙা, রাস্তায় কেউ নেই, সবাই যার যার ঘরে। এভাবে ভাবতে ভাবতে একটু একটু ঠান্ডা অনুভূত হতে পারে, যেন সত্যিই বৃষ্টির মধ্যে ঘরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন আর ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগছে।
সিনেমাতেও এমন অনুভূতির প্রকাশ আছে কি না, তা সিনেমা দেখলে বোঝা যাবে। তবে পরিচালক জানালেন, কীভাবে সাঁতাও নামটি সিনেমার ঢং ও বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলেছে।
সুমন বলেন, ‘সিনেমায় সাঁতাও নেই, অর্থাৎ সাত দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে এমন দৃশ্য নেই। কিন্তু অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে আপনার ঘরে থাকতে হচ্ছে, সেই অনুভূতি আছে।’
আরেকটি মজার তথ্য দিলেন সুমন। দাবি করলেন, সিরাজগঞ্জ থেকে পঞ্চগড় অঞ্চলের যে বুননশিল্প অর্থাৎ নকশীকাঁথা বা জাল, এগুলো প্রসিদ্ধ হয়েছে সাঁতাওকে কেন্দ্র করে।
সাঁতাও সিনেমার দৃশ্য। ছবি: পরিচালকের সৌজন্যে
সুমন বলেন, অবিরাম বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে টানা কয়েক দিন থাকার কারণে নারীরা কিছু সময় পেতেন এবং বুননের কাজগুলো করতেন। আরও মজার বিষয় হলো, সাঁতাওয়ের কিছু পরেই শীত চলে আসে। তখন কাঁথাগুলো প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। সাঁতাও সিনেমায় এ বিষয়গুলোর দৃশ্যকাব্য থাকবে বলে জানান সুমন।
সিনেমাটিকে পরিচালক ইংরেজিতে ডাকেন ‘মেমোরিজ অব গ্লুমি মুনসুন’ নামে। যে স্মৃতিগুলো ছবি হয়ে তার কাছে রয়ে গেছে, যেগুলোকে তিনি ক্যামেরায় বন্দি না করে থাকতে পারছিলেন না, সেগুলো নিয়েই নির্মিত হয়েছে সাঁতাও সিনেমাটি। এর মাধ্যমে কিছুটা জীবন, কিছুটা যাপন, কিছুটা সংস্কৃতি উঠে আসবে ঠিকই, কিন্তু কোনো দর্শন আছে কি না, তা জানা নেই পরিচালকের। বলেন, ‘যদি কিছু থাকে সেটা দর্শকরাই ডিকোড করুক।’
সাঁতাও সিনেমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ২০১৮ সালে। তবে চিত্রনাট্যের কাজ আরও আগে থেকে। যাত্রা শুরু হওয়ার পর পরিচালক খুব স্বাভাবিকভাবেই বুঝলেন, তিনি যে কাজ করতে চান সেটা পুঁজিবাজারকে আকৃষ্ট করবে না। তাই তার প্রয়োজন হলো ভিন্ন পদ্ধতিতে যাওয়ার। প্রযোজক হিসেবে শরিফ উল আনোয়ার সজ্জনকে পেলেও সিনেমাটি গণ-অর্থায়নে করার পরিকল্পনা করেন সুমন।
তিনি বলেন, ‘একজন প্রযোজকের কাছে যেভাবে প্রজেক্ট পিচ করতে হয়, আমি সেটাই করেছি পাবলিকলি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অসংখ্য মানুষ আমাকে অ্যালাও করে এবং আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।’
সাঁতাও সিনেমার দৃশ্য। ছবি: পরিচালকের সৌজন্যে
যারা সাঁতাও সিনেমাকে অর্থায়ন করেছেন, সবাই কিন্তু সিনেমার প্রযোজক নন। পরিচালক তাদের বলছেন সমর্থক। ফেরত দেয়া বা মুনাফা দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে তাদের অর্থ নেয়া হয়নি বলে জানান সুমন।
বলেন, ‘আমরা টাকার পরিমাণ এবং সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার জন্য সমর্থক কী সুবিধা পাবেন সেটা জানিয়েছিলাম। তাতে সায় দিয়ে ১ হাজার ৫৫৯ জন আমাকে সমর্থন করেছেন। এদের মধ্যে ৩৩৯ জন তাদের নাম প্রকাশ করার অনুমতি দিয়েছেন। বাকিরা দেননি।’
সাঁতাও কি তবে স্বাধীন চলচ্চিত্র? পরিচালক বললেন, ‘আমি আমার মানিসিক জায়গা থেকে স্বাধীন। কিন্তু আমার মধ্যে থাকা কলোনিয়াল এডুকেশন, আমার চারপাশের সামাজিক অবস্থা আমাকে স্বাধীন থাকতে দেয় না। আমি সেটা ভেঙে বের হয়ে আসার চেষ্টা করি। সেই চেষ্টা থেকে আমি অনেক কিছু দেখাতে চাই, আবার থেমে যেতে হয়। আমাকে ভাবতে হয় সেন্সর বোর্ডের কথা। তো, এ রকম অবস্থায় আমার সিনেমাটাকে আমি স্বাধীন বলতে পারি না। তবে আমি স্বাধীনচেতা।’
শুটিংয়ে পরিচালক (সামনে) ও এলাকাবাসী। ছবি: সংগৃহীত
সিনেমাটি পেয়ে গেছে সেন্সর সার্টিফিকেট। সিনেমায় অভিনয় করেছেন আইনুন পুতুল, ফজলুল হক, জুলফিকার চঞ্চল, মো. সালাউদ্দিন, সাবেরা ইয়াসমিন, স্বাক্ষ্য শাহীদ, শ্রাবণী দাস রিমি, তাসমিতা শিমু, মিতু সরকার, ফারুক শিয়ার চিনু, আফরিনা বুলবুল, রুবল লোদী, কামরুজ্জামান রাব্বী, আব্দুল আজিজ মণ্ডল, বিধান রায়, বিনয় প্রসাদ গুপ্ত, সুপিন বর্মণ। সাউন্ড ডিজাইন-সাউন্ড মিক্সিং করেছেন সুজন মাহমুদ। শব্দ গ্রহণে ছিলেন নাহিদ মাসুদ। সজল হোসেন, ইহতেশাম আহমদ টিংকু ও খন্দকার সুমন করেছেন চিত্রগ্রহণ।
অভিনয়শিল্পী চূড়ান্তের সময় সুমন চেয়েছিলেন পেশাদার শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে। কারণ, পেশাদার অভিনয়শিল্পীদের দিয়ে কাজ করলে, কাজ দ্রুত হয় এবং এতে করে কিছুটা হলেও খরচ কমে। অপেশাদার শিল্পী পরিচালকের অপছন্দ নয়, তবে কাজের পরিস্থিতি বিচারে পেশাদারদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্তটাই তার কাছে ভালো মনে হয়েছে।
সাঁতাও সিনেমার দৃশ্য। ছবি: পরিচালকের সৌজন্যে
সিনেমার সব কাজ শেষ। তবু অনেক কলাকুশলীর সম্মানী দেয়া বাকি আছে সুমনের। এ কথা অকপটেই জানালেন। বললেন, ‘অনেককেই টাকা দিতে পারিনি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তারা অনেক বড় মনের মানুষ। তারা চায় সিনেমাটি রিলিজ হোক। আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের টাকাটা পরিশোধ করে দিতে।’
এ কথা বলে আরেকটি গল্প বললেন সুমন। বললেন, ‘আমি যেদিন সাঁতাও সিনেমার প্রথম দিনের শুটিংয়ে যাই, সেদিন আমার কাছে ছিল ১৭ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়ে এক দিনের শুটিং করা সম্ভব না। কিন্তু আমরা করেছি। আমার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, যেখানে শুটিং করেছি সেখানকার মানুষদের সহযোগিতায় এটি সম্ভব হয়েছে।’
সিনেমার অধিকাংশ শুটিং হয়েছে লালমনিরহাটে, ঢাকাতেও হয়েছে কিছু। এখন সিনেমাটি পরিবেশনা ও মুক্তির পালা। সিনেমাটি জানুয়ারিতে মুক্তির পরিকল্পনা করছেন পরিচালক।