দেশের বাইরে কনসার্ট শেষ করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্ট আরমীন মুসা। নিজেকে ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্ট বলেন তিনি।
দেশের বাইরে আরমীন যে কনসার্ট করেন বা করে আসলেন, সেগুলো অ্যারেঞ্জ করা, অংশ নেয়ার যে প্রক্রিয়া সেগুলো আরও অনেক শিল্পীর মতো না। অনেক শিল্পী আছেন, যাদের বিভিন্ন ইভেন্টে বা কনসার্টে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু আরমীনের ক্ষেত্রে বা ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্টের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন না।
নিউজবাংলাকে আরমীন বললেন, ‘যারা কমার্শিয়াল আর্টিস্ট, তাদের অনেক আমন্ত্রণ থাকে, ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্টদের সাধারণত এত আমন্ত্রণ থাকে না। আমাদের যেটা করতে হয়, আমরা সিভি পাঠাই, গান পাঠাই; আমরা যাচাই করে দেখি যে কোথায় আমাদের টাইপের মিউজিক শুনতে আগ্রহী, সেসব ভেন্যুতে আমরা যোগাযোগ করি।
‘ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্টের চরিত্র হলো, আমরা নিজেরটা নিজে করি। আমাদের ম্যানেজার নাই, বুকিং এজেন্ট নাই। কমার্শিয়াল আর্টিস্টদের যেমন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, এজেন্সি শো অ্যারেঞ্জ করে দেয়, আমাদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না।
‘আমি ওয়ার্ল্ড মিউজিক করি, কিন্তু ইনডিপেনডেন্ট শিল্পী হওয়ায় আমার জন্য আসলে জায়গা অনেক কম। তো আমাকে ছোট ছোট জায়গা খুঁজে বের করে নিতে হয়।’
সংগীতশিল্পী আরমীন মুসা। ছবি: শিল্পীর পক্ষ থেকে
তবে কেউ যদি আরমীনকে বাণিজ্যিক শোয়ে আমন্ত্রণ জানান, তিনি অবশ্যই করবেন এবং করেনও।
সম্প্রতি তিনি মাল্টায় কনসার্ট করে এসেছেন। ওপরের কথাগুলো আরও যৌক্তিক করার জন্য আয়োজনটির উদাহরণ টানেন তিনি। বলেন, ‘মহামারির আগে আমার একটু ওয়ার্ল্ড ট্যুর করার পরিকল্পনা ছিল। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ হয়ে আমেরিকা যাব। পরে তো সেটা আর হয় নাই। ওই সময় আমি যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তাদের মধ্য থেকে মাল্টার ভেন্যু থেকে আমাকে জানাল, ওয়েলকাম করল কনসার্ট করার জন্য, তাই সেখানে গিয়ে কনসার্ট করেছি।’
সেখানে আরমীনের দুটি শো ছিল। যাওয়ার সপ্তাহে এবং আসার সপ্তাহে কনসার্ট করেছেন, মাঝখানের সময়টা ঘুরেছেন। এক মাসের মতো ছিলেন বলে জানান আরমীন।
সম্প্রতি আরমীনের ক্যারিয়ারে বা আরমীনের সঙ্গে যা হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় ঘটনা। আগামীতে এই ঘটনা অনুপ্রেরণা দেবে দেশের সংগীতশিল্পীদের। বিদেশেও এগিয়ে যাবে বাংলা ভাষার গান ও সুর।
আরমীন তার ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়েছেন বার্কলি কলেজ অব মিউজিক থেকে। সেখানকার প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অংশগ্রহণে তৈরি হয়েছে একটি অ্যালবাম। সেখানে রয়েছেন ওস্তাদ জাকির হোসেন, শ্রেয়া ঘোষাল, শঙ্কর মহাদেবন, বিজয় প্রকাশসহ আরও অনেক গুণী শিল্পীর অংশগ্রহণ। তাদের সঙ্গে আছেন বাংলাদেশের আরমীনও।
আরমীন জানান, ইন্ডিয়ান মিউজিক নিয়ে এটা একটা আমেরিকান অ্যালবাম। এতে দশটা গান রয়েছে এবং ডিজিটালি প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে ১০ নম্বর ট্র্যাকটি আরমীনের; গানের নাম ‘জাগো পিয়া’।
সংগীতশিল্পী আরমীন মুসা। ছবি: শিল্পীর পক্ষ থেকে
না, এটা কোনো রোমান্টিক গান নয়। আবার সুরেও রয়েছে বাংলা ও ওয়েস্টার্নের মিশ্রণ। আরমীন বলেন, ‘গানটা রোমান্টিক না। এই গানটা মূলত ফিলসফিক্যাল, আমার মা ড. নাশিদ কামালের লেখা। গানে নিজেকে নিজে বলা হচ্ছে যে সামনে তাকাও, এগিয়ে যাও।’
গানটির সুর করেছেন আরমীন। সুর নিয়ে তার ভাষ্য, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে যে এটা ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন মিলিয়ে। এটা যেহেতু বাংলা গান, আমি সেই ঢঙেই সুর করেছি, তবে ট্রাডিশনাল বাংলা সুর হয় নাই, সেখানে আমার নিজস্ব কিছু ছোঁয়া আছে।’
ভারতীয় পণ্ডিত সংগীতজ্ঞদের সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পীদের গান গাওয়া বা একই অ্যালবামে থাকার ঘটনা প্রথম নয়। তবে আরমীন যে প্রক্রিয়ায় এ অ্যালবামে স্থান করে নিয়েছেন, সেটি প্রথম।
আরমীনের মতে, ‘বার্কলি স্কুল অফ মিউজিকে আমি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পড়তে গিয়েছি। আমার পরে আরও তিনজন পড়ছে এখন। তাদের নিয়েও আশা করছি অনেক ভালো ভালো কাজ হবে। তবে হ্যাঁ, বার্কলিতে প্রথম বাংলা গান গাওয়া হয়েছে আমার মাধ্যমে।’
কথাটি যখন বলছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, প্রথম কোন বাংলা গানটি গেয়েছিলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনে করলেন আরমীন। বললেন, ‘সম্ভবত মিলন হবে কত দিনে। লালনগীতি করেছিলাম। মনে হয় এটাই করেছিলাম।’
বার্কলিতে ওয়েস্টার্ন মিউজিকে পড়াশোনা করেছেন আরমীন। সে জন্য শুধু যে ইংলিশ গান করতে চান তিনি এমন না। আবার শুধু বাংলা গানও করতে চান না। তিনি চান ভার্সেটাইল হয়ে এগিয়ে যেতে।
ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্ট আরমীন মুসা। ছবি: শিল্পীর পক্ষ থেকে
আরমীন বার্কলিতে ছিলেন বলে হয়তো এখন দেশের অনেকেই সেখানে পড়তে আগ্রহী হন। তেমন ভারতীয় অ্যালবামে তার গান গাওয়া কি পারবে বাংলা ভাষার গান ও সুরকে একটু হলেও এগিয়ে নিতে বিশ্ব সংগীত মঞ্চে?
আরমীন বলেন, ‘আমি আশা করি, আমি যখন বাংলা গান গাইব তখন মানুষ সেটাকে গ্লোবাল পারসপেকটিভে দেখবে, যখন ইংলিশ গান গাইব তখনও যেন সেটা গ্লোবাল পারসপেকটিভে দেখে। অন্য শ্রোতারা বাংলা গান শুনেছে এটাকে আমি অনেক বড় কোনো ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই না। আবার এটাকে ছোট করেও দেখছি না। কিন্তু এটা যেন সাধারণ বিষয় হয়, আমরা যেন বলতে পারি- এটা তো হতেই পারে।’
৭ বছর আগে বার্কলি শেষ করেছেন আরমীন। এখন সংগীত নিয়ে নানা রকম কাজ করছেন। ‘ঘাসফড়িং কয়্যার’ নামে ১৭ জনের একটি গানের দল রয়েছে আরমীনের। ইউটিউবে গানের পাশাপাশি নিজের লেখা কবিতাও পড়েন। তিনি অবশ্য জানান কবিতা নিয়ে তার কোনো পরিকল্পনা নাই। কবিতা তিনি নিজের জন্য লেখেন। আরমীন নিজের লেখা কবিতাকে আহামরি কিছু মনে করেন না। তবে কোনো পাবলিকেশন চাইলে পাবলিশ করার ইচ্ছা আছে তার।
বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে ‘মাশরুম এন্টারটেইনমেন্ট’ নামের একটি অনলাইন অডিও ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যাটফর্ম চালু করেছিলেন আরমীন। এখন আর প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে নেই তিনি। কারণ, ‘ব্যবসা করতে গেলে একটা মেন্টালিটির মধ্যে থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন শেষ হওয়ার পর মনে হয়েছে আর্টিস্টদের ব্যবসা করা ঠিক না। আমার ব্যবসা করতে চাইলে শুধু ব্যবসায়ীই হতে হবে। তাই যারা ব্যবসা করতে চায় তারা করুক, আমি আর্টিস্ট হতে চাই। মাশরুম এন্টারটেইনমেন্ট এখনও চলছে।’
পুরোনো খবর রেখে নতুন খবরও দিলেন আরমীন। বললেন, অডিওর জনপ্রিয় সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তার নতুন এক্সটেন্ডেট প্লে (ইপি) প্রকাশ পেয়েছে।
ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্ট আরমীন মুসা। ছবি: সংগৃহীত
ইপি টার্মটা বোঝানোর জন্য আরমীন বলেন, ‘যখন একটা গান প্রকাশ হয় তখন সেটা সিঙ্গেল। যখন ৯-১০টা গান প্রকাশ পায় সেটার নাম অ্যালবাম। আর যখন সিঙ্গেলের বেশি ও অ্যালবামের কম সময় এবং পরিমাণের গান প্রকাশ করা হয় সেটা ইপি বা এক্সটেন্ডেট প্লে।’
নিজের নতুন ইপি নিয়ে আরমীন বলেন, ‘২৬ আগস্ট জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক অডিও প্ল্যাটফর্মে একটা ইপি প্রকাশ পেয়েছে আমার। অস্ট্রেলিয়ায় কিছু গান গেয়েছিলাম। সেই গানগুলো আমি ইপি আকারে ছেড়েছি এবং সেখানে ৪টা কবিতাও আছে।’
মহামারির সময়ে লেখা বেশ কিছু বাংলা ও ইংরেজি গান লেখা হয়েছে আরমীনের। তার দাবি সেগুলো নাকি দুঃখের, কারণ সময়টাই ছিল সে রকম। ওই কাজগুলো প্রকাশ পেলে তার ধারণা আরমীনের একটা নতুন সাইড পাবেন শ্রোতারা।