হাওয়া সিনেমায় খাঁচায় বন্দি একটি শালিক দেখানোয় মামলা ঠুকেছে বণ্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। এতে চাওয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ।
এই প্রথম দেশের কোনো সিনেমায় বন্যপ্রাণী ব্যবহারের ঘটনায় এ ধরনের মামলা হলো। এর আগে অনন্য ইমন পরিচালিত শেষ গল্পটা তুমিই নাটকে খাঁচাবন্দি টিয়া পাখি দেখানোয় ১৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মামলা হয়।
হাওয়া সিনেমার পরিচালকের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ লঙ্ঘনের অভিযোগে মেজবাউর রহমান সুমনের বিরুদ্ধে মামলাটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রশ্ন উঠেছে এ ধরনের কোনো দৃশ্যায়ন নাটক বা চলচ্চিত্রে কীভাবে করা যাবে। ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ২০ কোটি টাকা কীভাবে হলো তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
এসব বিষয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস। তিনি জানান, বন্যপ্রাণী খাঁচায় বন্দি রাখা, দখলে রাখা, পরিবহন করা, হত্যা করা আইন পরিপন্থি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নেয়া হচ্ছে।
আইনিভাবে ‘বন্যপ্রাণী’র সংজ্ঞা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে প্রাণী তার জীবনচক্রের কোনো অংশে মানুষের ওপর নির্ভরশীল না এমন সব প্রাণী বন্যপ্রাণী। যেমন অনেকের বাসায় টিকটিকি বা মাকড়শা থাকে। মানুষের ঘরে থাকলেও তারা কিন্তু নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করে নেয়। মানুষের ঘরে থাকার মানে কিন্তু মানুষের ওপর নির্ভরতা নয়। এটা তার জীবনচক্রের অংশ। আজ এ বাসায় তো কাল অন্যখানে। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার বিষয়ও আছে এখানে।’
রথীন্দ্র কুমার জানান, গৃহপালিত পশু যেমন গরু, মুরগি, হাঁস বন্যপ্রাণী নয়। এগুলো নিয়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ আইনে কোনো কিছু বলাও নেই। এগুলো দেখে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মাছও বন্যপ্রাণীর আওতায় পড়ে না।
তবে মাছ নিয়েও আইন রয়েছে বলে জানান তিনি। রথীন্দ্র কুমার বলেন, ‘কোন মাছ ধরা যাবে, কোনগুলো ধরা যাবে না, কোন মাছ ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে, কোনগুলো করা যাবে না, সে বিষয়েও আইনকানুন আছে।’
সে ক্ষেত্রে নির্মাতারা তাদের সিনেমা-নাটকে কীভাবে বন্যপ্রাণী দেখাবেন- এমন প্রশ্নে রথীন্দ্র কুমারের জবাব, ‘নাটক-সিনেমায় যদি বন্যপ্রাণী দেখাতেই হয়, সে ক্ষেত্রে অ্যানিমেশনের সাহায্যে দেখানো যাবে। সঙ্গে ওই দৃশ্যের ডিসক্লেইমার দিতে হবে।
‘কিছু ক্ষেত্রে সিনেমার প্রয়োজনে যদি আসল বন্যপ্রাণীকে দেখাতেই হয়, সে ক্ষেত্রে বন বিভাগ বরাবর আবেদন করতে হবে। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দেবে সেটা দেখানো যাবে কি না।’
হাওয়া সিনেমায় শালিক পাখিকে খাঁচায় বন্দি, এক পর্যায়ে ছেড়ে দেয়া এবং শেষের দিকে খাওয়ার দৃশ্যে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে বলে মন্তব্য করেন রথীন্দ্র কুমার।
তিনি বলেন, ‘হাওয়া সিনেমার পরিচালকের সাক্ষাৎকারে এমন শুনলাম যে, তারা কোথাও থেকে শালিক পাখিটি নিয়ে এসে সিনেমার জন্য অনেকদিন বন্দি করে রেখেছিলেন এবং পরে কাজ শেষে ছেড়ে দিয়েছেন। এ বিষয়টাই আমাদের আইনে দণ্ডনীয়।
‘তাছাড়া কোনো বন্যপ্রাণীকে এক জায়গা থেকে ধরে নিয়ে অন্য জায়গায় ছেড়ে দেয়াটাও দণ্ডনীয়। সবারই বসবাসের উপযোগী জায়গা থাকে। যেখানে সেখানে বন্যপ্রাণীকে ছেড়ে দিলে তো হবে না। বন্যপ্রাণীটি কোথায় মানিয়ে নিতে পারছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘হাওয়া সিনেমায় প্রায় শুরু থেকেই পাখিটি বন্দি ছিল। তাহলে পুরো সিনেমার শুটিংয়ের জন্য তো অনেক দিন পাখিটিকে বন্দি করে রাখতে হয়েছে। আমাদের আইনের আছে বন্যপ্রাণীকে দখলে রেখে কিছু করা যাবে না। সেটা এখানে লঙ্ঘিত হয়েছে।’
হাওয়া সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন তার একটি স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, তিনি সিনেমাটিতে বিষয়টি নিয়ে ডিসক্লেইমার দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে রথীন্দ্র কুমার বলেন, ‘আমি যতটুকু দেখেছি, একদম শুরুর দিকে একটা লেখা আছে এমন যে, কোনো প্রাণীর ক্ষতি করা হয়নি। তবে ওই ডিসক্লেইমার অনেক কিছুই পরিষ্কার করে না।’
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন বিষয়ে নির্মাতাদের সচেতন করতে রথীন্দ্রের সঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি যোগাযোগ করেছে। বিষয়টি নিয়ে কর্মশালা আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে সমিতি।
ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ২০ কোটি টাকা কেন, তার ব্যাখাও দেন রথীন্দ্র কুমার। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেকে এটাকে ক্ষতিপূরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিষয়টি পরিষ্কার করে বলতে চাই, মামলা হয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু আমরা ক্ষতিপূরণ মামলা বা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করিনি। এই ২০ কোটি টাকা নির্ণয় করা হয়েছে পরিবেশের আনুমানিক ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণের মাধ্যমে।
‘সিনেমাটি যে পরিমাণ মানুষ দেখেছেন, দেখার পর তাদের ওপর যে প্রভাব ও বন্যপ্রাণী খাঁচায় বন্দি করার জন্য প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা এবং এতে করে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়তে পারে, সব কিছুর আর্থিক বিবেচনা করে আমরা এ অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করেছি।’
হাওয়ার বিরুদ্ধে মামলার পর অনেকে রাজধানীর কাটাবনের কিছু দোকানে খাঁচায় বন্দি প্রাণীর উদাহরণ টেনেছেন।
এ ব্যাপারে রথীন্দ্র বলেন, ‘আমাদের যে পোল্ট্রি মুরগি, সেগুলোকে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিলে কিন্তু বাঁচতে পারবে না। তেমনি কিছু পাখি আছে যেমন লাভ বার্ড, কেইজ বার্ড। সেগুলো খাঁচায় রাখা যাবে, সেটা আইনসম্মত।’