নির্মাতা রায়হান রাফির সিনেমা দামাল-এর ট্রেইলার প্রকাশ হয় ১৬ আগস্ট। এর পরই সিনেমার একটি দৃশ্যে রাজাকারের মুখে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ স্লোগান নিয়ে ফেসবুকে প্রশ্ন তোলেন ফ্রান্স প্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য।
পিনাকীর দাবি, রাজাকারের মুখে এ ধরনের স্লোগানের মাধ্যমে ইসলামকে হেয় করা হয়েছে। এই স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘হিন্দু মুক্তিযোদ্ধারা’ও দিয়েছেন।
এরপর ১৮ আগস্ট নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আরেকটি পোস্টে পিনাকী ভট্টাচার্য দাবি করেন, দৃশ্যটি সিনেমা থেকে বাদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাফি।
স্ট্যাটাসে পিনাকী লেখেন, ‘দামাল সিনেমার পরিচালক রায়হান রাফি ইনবক্সে যোগাযোগ করে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। সে রাজাকারের মুখে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর স্লোগান দেয়াটাকে অনিচ্ছাকৃত ভুল বলে মূল সিনেমা থেকে তা বাদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শুধু তা-ই না, সে স্লোগান বাদ দিয়ে সিনেমার ট্রেলারটাও পাল্টে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে ইউটিউবেও একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন পিনাকী ভট্টাচার্য। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে ভাটি অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার সালেহ চৌধুরীর ‘ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, জগতজ্যোতি দাসের মতো হিন্দু ধর্মাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধারাও ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিতেন।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে ফেসবুকে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় জড়িতরা বলছেন, পিনাকী ভট্টাচার্য সুকৌশলে বিকৃত ইতিহাস প্রচার করছেন। অন্যদিকে দামাল-এর পরিচালক রায়হান রাফি বলেছেন, পিনাকীর কথায় তিনি সিনেমায় কোনো পরিবর্তন আনছেন না। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক সত্য তিনি চলচ্চিত্রে তুলে ধরতে চান।
পিনাকী ভট্টাচার্যের বক্তব্যের সমালোচনা করে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাসান মুর্শেদ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন (বাক্য-বানান অপরিবর্তিত), ‘পিনাকী ভট্টাচার্য্য এখানে যা করেছেন তাহলো অতি নিম্নমানের চতুরতা। তিনি একটি অনিয়মিত ঘটনাকে উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে ব্যবহার করেছেন। সালেহ চৌধুরীর লেখার পরের অংশ থেকেই বুঝা যায়, জগতজ্যোতির মধ্যে এসব চমকে দেয়ার কিছু ব্যাপার ছিলো। তিনি মাথায় লাল গামছা বেঁধে দিনের বেলা অপারেশনে বের হয়ে যেতেন- এগুলো গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম বিরোধী। এই নিয়মগুলো না মানার খেসারত তাঁকে দিতে হয়েছে জীবন দিয়ে।
“নারায়ে তকবীর আল্লাহু আকবর’ যদি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচলিত শ্লোগান হতো তাহলে কমান্ডার সালেহ চৌধুরী কেনো ‘আঁতকে’ উঠলেন? কেনো গুলীভর্তি স্টেনগান নিয় তিনি দৌড়ে বের হলেন? এটা যদি স্বাভাবিক হতো তাহলে তো কমান্ডারের এই প্রতিক্রিয়া হবার কথা না। বইয়েই আছে জগতজ্যোতি সহ অন্য মুক্তিযোদ্ধা দলগুলোর ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয় ক্যাম্পে ফেরার ঘটনা। তখন তো কমান্ডার আঁতকে উঠেননি, স্টেনগান হাত নিয়ে দৌড়ে বের হননি। তাহলে যুদ্ধকালীন সময় ‘নারায়ে তকবীর আল্লাহু আকবর’ শুনে কেনো আঁতকে উঠে স্টেনগান হাতে বের হয়েছিলেন কমান্ডার? কাদের দ্বারা আক্রান্ত হবার আশংকায় আঁতকে উঠেছিলেন- সেটা বুঝতে কি বিশাল জ্ঞানী হতে হয়?”
আইনজীবী ও গবেষক নিঝুম মজুমদার ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর সৈয়দপুরে জেনারেল নিয়াজির এক বক্তৃতার পেপার কাটিং যুক্ত করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন (বাক্য-বানান অপরিবর্তিত), ‘মুক্তিযুদ্ধে আমরা ধর্মের জন্য জড়াই নি। জড়িয়েছি আমাদের অধিকারের জন্য এবং আমাদের উপর অত্যাচারের প্রেক্ষিতে।
‘কিন্তু যারা স্বাধীনতা বিরোধী ছিলো, বিশেষ করে এই দেশের পাকিস্তানী সহযোগী তারা এই মুক্তির যুদ্ধকে দেখেছে ধর্মীয় দিক থেকে। তারা বার বার বলেছে যারা যুদ্ধ করছে তারা ভারতের চর এবং তারা বাংলাদেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এই ছিলো তাদের ভাষ্য। ফলে তারা নারায়ে তাকবীর বলেছে সাম্প্রদায়িক মাইন্ড সেট থেকে।
‘আমাদের ধর্ম পালন কিংবা আল্লাহর নাম নেবার উদ্দেশ্য আর সেই স্বাধীনতা বিরোধীদের আল্লাহর নাম নেবার ভেতর স্পস্ট পার্থক্য রয়েছে এবং উদ্দেশ্যও আলাদা। আমরা এইসব ইতিহাস জানি এবং খুব ভালো করেই বুঝি।’
নিঝুম লিখেছেন, ‘পিনাকী ভট্টাচার্য পরিচালককে ভয় দেখিয়েছে এবং হুমকি দিয়েছে চলচ্চিত্র বয়কটের।
‘আমি রায়হান ভাইকে টেলিফোনে স্পস্ট বলেছি, আপনি কেন ভয় পাবেন? যা ইতিহাস, যা সত্য আপনি তাই দেখাবেন। উনি জানিয়েছেন যে, তিনি ভয় পান নাই এবং পাবেনও না।’
দামাল-এ কোনো পরিবর্তন আসছে না
বিষয়টি নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে পরিচালক রায়হান রাফির সঙ্গে। আলোচিত স্লোগানটি সরাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি এ বিষয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছি, যেটা আমার অফিশিয়াল বিবৃতি।’
স্ট্যাটাসটি পড়ে শোনান রাফি। এতে তিনি লিখেছেন, ‘একটা বিষয়ে আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা আমার উপর এতদিন বিশ্বাস রেখে এসেছেন, এখনও রাখুন। দামাল সিনেমায় আমরা এমন কোনো কিছুই করব না যা ধর্ম এবং ইতিহাসকে বিকৃত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যা সত্য, তাই আমরা দামাল সিনেমাতে দেখাব।’
তিনি বলেন, ‘এখানে আমার নিজের থেকে দেখানোর কিছু নাই, আপনারও দেখানোর কিছু নাই। দামাল তো আমার ফিকশন করা গল্প নয়, যে মন চেয়েছে বলে একটা কিছু দেখিয়ে দেব।’
পিনাকী ভট্টাচার্যকে কোনো ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নে রাফি বলেন, ‘ওটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না প্লিজ। বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমার কথা একদম স্পষ্ট, আমি সিনেমা সাধারণ মানুষের জন্য বানাই। সেখানে একজন মানুষের সমালোচনার উত্তর দিলে সবারটার উত্তর দিতে হবে, আমি সবার সমালোচনাকে সম্মান করি।
‘উনি কিন্তু প্রতিদিন প্রচুর বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে কথা বলেন প্রতিটা স্ট্যাটাসে। উনি বলতে পারবেন কেন আমার নাম উল্লেখ করেছেন, সেটা উনি জানেন। ওটা তো আমার স্টেটমেন্ট না, আমি তো আমার এখানে দেব।’
আলোচিত দৃশ্যটির বিষয়ে রাফি বলেন, ‘উনি (পিনাকী) কী লিখেছেন আমি জানিও না, দেখিও নাই। উনি কী লিখেছেন সেটা জরুরি না, আপনি নিজেও দেখবেন সরেছে কি সরে নাই। ওটা ইউটিউবে আছে, আমার আইডিতে আছে। একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, কোনো কিছুই পরিবর্তন হবে না।’
তিনি বলেন, ‘একটা বিষয় বলতে চাই কোনো একটা গোষ্ঠী ধর্মকে ছোট করে এ ধরনের গসিপ ছড়াতে চায়। এখন একজন খুনি যদি খুন করার সময় বলে ইনশাল্লাহ আমি খুনটা করব, তাহলে কী ইনশাআল্লাহ্ ছোট হচ্ছে, নাকি খুনিটা ছোট হচ্ছে? অবশ্যই খুনি ছোট হচ্ছে।
‘তো ওই সময় (মুক্তিযুদ্ধ) কিছু মানুষ ধর্মকে বিক্রি করে এই কাজ করেছে, আমরা তাদেরকে দেখিয়েছি। আমরা ধর্মকে ছোট করিনি। কিছু মানুষ এটাকে নিয়ে- যাদেরকে আপনারা চেনেন জানেন, যারা ধর্মকে নিয়ে উসকানিমূলক কাহিনি করেন তারা এটাকে বড় করার চিন্তা করছেন। যারা আমাদের সাধারণ মানুষ, তাদেরকে তারা বোঝানোর চেষ্টা করছে দেখছ- আল্লাহ্ আকবারকে ছোট করছে।’
রাফি বলেন, ‘আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করি, যে দৃশ্যটা নিয়ে কথা উঠেছে- নারীকে ধরে নেয়ার সময়। বিষয়টা কিন্তু নারীকে ধরে নেয়ার সময় না, আমাদের দৃশ্যটা ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধাকে জবাই করছে রাজাকার। এটা আমার সিনেমার আগে গেরিলা সিনেমাতে দেখানো হয়েছে। ইতিহাসে এটা আছে। বিষয়টা নারীকে তুলে নেয়ার সময় আল্লাহ্ আকবর নয়।’
রাফি বলেন, ‘ইতিহাসকে বিকৃত করার ক্ষমতা আমার-আপনার কারও নাই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের সবচেয়ে বড় ও গৌরবের ইতিহাস, সেই ইতিহাস চাইলেই তো কেউ চেঞ্জ করতে পারবে না। তো আমার স্টেটমেন্টটাই হচ্ছে ট্রেইলার। আমার ট্রেইলার দেখলেই বোঝা যাবে আমি চেঞ্জ করেছি কী করি নাই। আমি বললেও চেঞ্জ হবে না, উনি (পিনাকী) বললেও চেঞ্জ হবে না, পৃথিবীর কেউ বললেও চেঞ্জ হবে না।’
সিনেমায় পরিবর্তন না আনার সিদ্ধান্তের প্রশংসা
দামাল সিনেমা অপরিবর্তিত রাখতে রায়হান রাফির অনমনীয় অবস্থানের প্রশংসা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট অমি রহমান পিয়াল।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাফির উচিতই হয়নি পিনাকীর সঙ্গে এ বিষয়ে বাতচিতে যাওয়া। পিনাকী এর সুযোগ নিয়ে সেটা এক্সপ্লয়েট করেছে, আর মিথ্যা ঘোষণা দিয়েছে যে, তার কথায় পরিচালক এডিট করে দৃশ্য বাদ দিচ্ছেন। আমাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছে এ কারণেই।’
পিনাকী ভট্টাচার্যের ‘অসাধু ও চতুর’ আচরণ নতুন নয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘তার হাজার হাজার ফেক আইডির সাজানো কথায় একটা মুক্তিযুদ্ধের ছবি বদলে যাবে, এটা নৈতিক পরাজয় মনে হচ্ছিল। তবে রাফির প্রকাশ্য বিবৃতিতে আমরা স্বস্তি পেয়েছি।’
দামাল-এর জন্য শুভকামনা জানিয়ে পিয়াল বলেন, ‘পরাজিত শক্তির প্রতিনিধিদের কাছে কোনো নতজানুতা নয়, এই স্বভাব সবাই জারি রাখুক।’