বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘এমন তো কথা ছিল না’

  •    
  • ১৫ আগস্ট, ২০২২ ০৮:২১

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর গীতিকার ফজল-এ-খোদার যে চাপা কষ্ট, সেই কষ্ট থেকে ‘এমন তো কথা ছিল না’ গানটির জন্ম এবং ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সৃষ্টি হওয়া এটি প্রথম গান বলে দাবি ফজল-এ-খোদার স্ত্রী মাহমুদা সুলতানার।

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি বাংলাদেশের কে না শুনেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানিয়ে গানটি লিখেছেন ফজল-এ-খোদা, গেয়েছেন ও সুর করেছেন আব্দুল জব্বার। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় সেরা ২০ গানের মধ্যে ১২তম স্থান পেয়েছিল।

তবে আজকের গল্পটি ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি নিয়ে নয়। আজকের গল্পটি ‘এমন তো কথা ছিল না’ গানের। যার রচয়িতা ফজল-এ-খোদা, গেয়েছেন আব্দুল জব্বার ও সুর করেছেন বশির আহমেদ।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর গীতিকার ফজল-এ-খোদার যে চাপা কষ্ট, সেই কষ্ট থেকে গানটির জন্ম এবং ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সৃষ্টি হওয়া এটি প্রথম গান বলে দাবি ফজল-এ-খোদার স্ত্রী মাহমুদা সুলতানার।

মাহমুদা সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, “এমন তো কথা ছিল না’ গানটি ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে লেখা ও রেকর্ড করা। এটি ফেব্রুয়ারিতে রেডিওতে বাজানো হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে এটিই প্রথম গান।’

তিনি জানান, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর তার নাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা। তাই কাব্য আর রূপকের আশ্রয় নিয়ে ফজল-এ-খোদা গানটি রচনা করেন। বশির আহমেদের সুরে গানটিতে কণ্ঠ দেন আব্দুল জব্বার।

মাহমুদা সুলতানা বলেন, ‘ব্যাপারটি তখন শুধু তারা তিনজন জানতেন। আমিও জেনেছি কিছু পরে।’

গানটি তৈরি হওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে মাহমুদা সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার। আমি ফজল-এ-খোদাকে ডেকে তুলি। মনে হচ্ছিল শব্দগুলো গোলাগুলির। ফজল-এ-খোদা আমাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, সে জন্য হয়তো শব্দ হচ্ছে। তিনি ধারণা করেছিলেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা হয়তো পটকা ফাটাচ্ছে।’

ফজল-এ-খোদা তখন রেডিওতে চাকরি করেন। রেডিওর পক্ষ থেকে তারও যাওয়ার কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটু পরে আবার উঠতে হবে এ জন্য তাকে শুয়ে পড়তে বলেন ফজল, জানান মাহমুদা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, এ খবরটি শোনার বর্ণনা দিয়ে মাহমুদা বলেন, ‘বেলা বাড়লে, রেডিওর এক পিয়ন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বাসায় আসে। তখন আমাদের বাসা ছিল শের-ই-বাংলা নগরের সরকারি কোয়ার্টারে। সেই পিয়ন এসে আমাকে বলে, ম্যাডাম বঙ্গবন্ধুকে তো মাইরা ফালাইসে। রেডিও ছাড়েন। আমি খবরটি ফজল-এ-খোদাকে জানাই। সে শুনে উদভ্রান্তের মতো হয়ে যায়। দৌঁড় দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে আবার বাসায় নিয়ে এসে রেডিওর সামনে বসানো হয়।’

রেডিও অফিসও ছিল আর্মিদের দখলে। ফজল-এ-খোদার কাছ থেকে শোনা গল্পই মাহমুদা জানান নিউজবাংলাকে। বলেন, ‘তার কয়েক দিন পর স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিক ছিলেন, তার নাম আশরাফুল আলম, রেডিও অফিসে তাকে নির্যাতন করছিল আর্মির লোকজন। কারণ আশরাফুল আলম তার কক্ষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজাচ্ছিলেন। আর্মির লোকজন মনে করেছিল, তার অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে।’

মাহমুদা জানান, ফজল-এ-খোদা, শহীদুল ইসলাম এবং আশরাফুল আলম- বেতারের এই তিন কর্মকর্তাকে এক আত্মা মনে করা হতো।

মাহমুদা আবার বলতে শুরু করেন, ‘এর মধ্যে কীভাবে যেন রটে গেল, মানে এটা রটানো হয়েছে যে এই তিনজন একটা নতুন বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে। ১৯৭৫ সালের ৩ অক্টোবর ভোররাতে মেজর শাহরীয়ার আর্মির জিপ নিয়ে আমাদের শের-ই-বাংলা নগরের সরকারি বাসায় আসেন এবং ফজল-এ-খোদাকে ধরে নিয়ে যান। শহীদুল ইসলামকে আগেই ধরেছিল আর্মিরা।’

‘‘ফজল-এ-খোদা এক সময় ছাড়া পান। কিন্তু তার মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ, কষ্ট, দুঃখ বা হতাশা তৈরি হয়, যেটা জানাচ্ছিল না। শিল্পী আব্দুল জব্বার বিষয়টি লক্ষ করেন এবং পরামর্শ দিয়ে ফজল-এ-খোদাকে বলেন, ‘তোর তো কষ্ট যাচ্ছে না। তুই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা গান লেখ।’ মাহমুদা জানান, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াই নিষেধ ছিল। সেই সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লেখা হবে কীভাবে।’’

মাহমুদা বলেন, ‘তখন ফজল-এ-খোদা খুব তীক্ষ্ণতার সঙ্গে, কাব্যের সাহায্যে রূপকের আশ্রয়ে লিখলেন সেই গান-

‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো

পথের ধুলোয় লুটোবে

সাতরঙে রাঙা স্বপ্নবিহঙ্গ

সহসা পাখনা গুটোবে

এমন তো কথা ছিল না…

আলোর কামনাগুলি সূর্য্য শিখা হয়ে আনন্দ ফুলঝুরি ছড়াতো

গানের বাঁশরি হয়ে সুরের আকাশখানি তারার জোছনায় ভরাতো

বৈশাখি মেঘে মেঘে চন্দ্র সূর্য্য ঢেকে

আচমকা আঁধার জুটোবে

এমন তো কথা ছিল না

মনের বাসনাগুলি গন্ধ গোলাপ হয়ে

অন্ধ মাতাল করে দিতো

সবুজ পাতারা ওগো অবুঝ প্রথম প্রেমে আদরে কাছে ডেকে নিতো

বাওরি উদাসী বায়ে

গোলাপেরা ঝরে গিয়ে

এ হৃদয়ে কাঁটা ফুটোবে

এমন তো কথা ছিল না।’

মাহমুদা বলেন, ‘এমনিতে দেখতে এটাকে একটা প্রেম-ভালোবাসার গান মনে হবে। কিন্তু গানটি মূলত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা।’

মাহমুদা আরও বলতে থাকেন, ‘আব্দুল জব্বার কবি বলে ডাকতেন ফজল-এ-খোদাকে। গানের কথা দেখার পর জব্বার বাহবা দেন ফজলকে। কিন্তু সুর করবে কে গানটি? তখন দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেন বশির আহমেদকে দিয়ে গানটির সুর করানোর। কয়েক দিনের মধ্যে বশির আহমেদ গানটির সুর করে দেন। আব্দুল জব্বার খুব খুশি হয়েছিলেন গানটির এমন সুর পেয়ে।’

মাহমুদার এখন ৭৫ বছর বয়স। স্বামী ফজল-এ-খোদাকে হারিয়েছেন গত বছরেই। তিন ছেলের মধ্যে এখন তিনি থাকেন মেজো ছেলের সঙ্গে।

‘এমন তো কথা ছিল না’ গানের গীতিকার, শিল্পী, সুরকার কেউই নেই। শুধু রয়ে গেছে ইতিহাস। যে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশ, যে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গর্ব।

এ বিভাগের আরো খবর