কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন মেজবাউর রহমান সুমন। এই নীরবতা বিস্ময়ের। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না হাশিম মাহমুদকে। অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এটা কোনো কথা হতে পারে, যে মানুষটি হাজার তরুণের মননে নাড়া দিয়ে গেছে, তার খোঁজ নেই!
এই হাশিম মাহমুদের সঙ্গে কত স্মৃতি, কত স্মৃতি সুমনের। কত বিকেল, কত গান, কত মুগ্ধতা হাশিম মাহমুদকে নিয়ে। শুধু সুমন কেন, চারুকলা অনুষদের যত শিক্ষার্থী, সবার কাছে পরিচিত হাশিম মাহমুদ।
অথচ সেই হাশিম মাহমুদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তিন থেকে চার মাস খোঁজার পর হাশিম মাহমুদকে পাওয়া গেল। যেন সব মুগ্ধতা ফিরে এলো, সুমনের মনে হতে থাকল সেইসব দিন-রাত্রির কথা।
সুমনের সঙ্গে দেখা হলে হাশিমের মন্তব্য, ‘কী অবস্থা মেজবাউর রহমান সুমন?’ আবারও বিস্মিত সুমন। পুরো নাম মনে আছে তার!
সুমনের মনে হতে থাকে আরও অনেক অনেক কথা। ১৯৯৯ সাল, চারুকলার নতুন শিক্ষার্থী সুমন। ছবি আঁকেন, কাঁধে তার গিটারও থাকে। দেখলেন এক জায়গায় গান হচ্ছে, গেলেন সেখানে, দেখা হলো হাশিম মাহমুদের সঙ্গে।
‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের গীতিকার ও সুরকার হাশিম মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
সুমন ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে থাকলেন হাশিম মাহমুদকে। হাশিম গানের মানুষ। গান লেখেন, গান করেন, সুর করেন, প্রচুর আড্ডা দেন। চাকরি করতেন না। স্ত্রী-সন্তানও নেই।
শিক্ষার্থীদের মতো হাশিম মাহমুদ প্রতিদিন সকালে চলে আসতেন চারুকলায়, সারা দিন থেকে রাতে ফিরতেন। হাশিমসহ আরও কয়েকজন মিলে একটি ব্যান্ডও করার চেষ্টা করেছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন ‘বৈরাগী’।
শুধু গানের মুগ্ধতাই না, হাশিমের কথার মুগ্ধতায় পড়েছিলেন সুমনসহ অনেকে। এত মুগ্ধতা যাকে নিয়ে তার বাসা যে নারায়ণগঞ্জ, এ কথাটাই জানতেন না কেউ।
যখন সুমনের দেখা হলো, হাশিম তখন অসুস্থ। তিনি সিজোফ্রেনিক রোগী। সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল মানসিক রোগ। এ রোগের লক্ষণ হচ্ছে– চিন্তাধারা এবং অনুভূতি প্রকাশের মধ্যে সংগতি না থাকা।
চারুকলায় যখন হাশিম নিয়মিত ছিলেন, তখনও এই রোগটি ছিল তার। সুমনরা এর ইঙ্গিত পেয়েছেন, কিন্তু তখন বুঝতে পারেননি। রোগটি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারুকলায় অনিয়মিত হয়েছেন তিনি। পরিবারে তার ভাইসহ আরও কিছু আত্মীয়স্বজন রয়েছেন, তারাই এখন হাশিমের দেখাশোনা করেন।
আরও পড়ুন: কলসি, ড্রাম, পাটাতন বাজিয়ে গানটি করেছি: ইমন চৌধুরী
হাওয়া সিনেমার ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের গীতিকার ও সুরকার হাশিম মাহমুদের এসব তথ্য নিউজবাংলাকে দিয়েছেন হাওয়া সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন। তিনি জানান, অনেক কিছু মনে নেই হাশিম মাহমুদের। আগের মতো শক্তিও নেই। তরুণ জীবনে প্রভাব রাখা মানুষটিকে এভাবে দেখে কষ্টই পেয়েছেন সুমন।
সুমন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাশিম ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখার কথা মনে আছে এখনও। যারা গান করত, তাদের সঙ্গে এমনিতেই মিল হয়ে যেত হাশিম ভাইয়ের।
‘চারুকলার সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল, সেটার নিচে বসতেন হাশিম ভাই। তখন মাঝে মাঝেই দেখা হতো। অনেক সময় দূর থেকে দেখতাম, তিনি কোনো ছেঁড়া কাগজে গান লিখছেন।’
সুমন আরও বলেন, ‘তার তো ইনকাম বলতে তেমন কিছু ছিল না। তাকে খেতেও দেখতাম না। মাঝে মাঝে আমরা যারা তার কাছের বা হাশিম ভাই যাদের পছন্দ করতেন, তারা টাকা দিলে নিতেন। কিন্তু এমনিতে যদি কেউ টাকা দিতে চাইত তিনি খুবই রিঅ্যাক্ট করতেন।’
সুমন অনেক আগে স্টুডিওতে হাশিমের কিছু গান রেকর্ড করিয়েছিলেন। হার্ডডিস্ক নষ্ট হওয়ায় সেই গানও হারিয়ে যায় বলে জানান সুমন। তিনি এও জানান যে নাটকে হাশিমের একটি গান ব্যবহার করেছিলেন।
তিনি বলেন, “যখন আমরা হাওয়া সিনেমায় ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটা ব্যবহারের জন্য হাশিম ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে দেখা করলাম, কিছু টাকা দিলাম, তারা বিস্মিত হলেন। তারা ভাবতেই পারেননি এমন কিছু একটা হতে পারে।’
‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের গীতিকার ও সুরকার হাশিম মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
গানটা হাশিম গাইতে না পারায় গেয়েছেন এরফান মৃধা শিবলু। তিনি নাকি হাশিমের সঙ্গে গান করেন ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে। সুমন জানান, শিবলুর কাছে কাছেও ছিল না হাশিমের বিস্তারিত।
‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি প্রকাশের পর চারুকলায় ডাকা হয়েছিল সুমনকে। সেখানে পরিচালকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। সুমন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে সবাই মিলে ধন্যবাদ দিয়েছেন। তাদের সবারই কথা, হাশিম ভাইকে নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু করতে চেয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি। হাওয়া সিনেমার মাধ্যমে হাশিম ভাইয়ের গানটি এখন অনেকেই শুনছে এবং তার নামটাও ছড়িয়ে যাচ্ছে।’
হাওয়া সিনেমা-সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত হাওয়া সিনেমার ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি ৬০০-এর বেশি কাভার করা হয়েছে। সেগুলো হাওয়ার অফিশিয়াল পেজে শেয়ার দেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি হাশিমের আরেকটি গান আলোচনায় এসেছে। গানটির শিরোনাম ‘তোমায় আমি পাইতে পারি বাজি’।