বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সিনেমায় প্রথম অভিনয়ে পেয়েছিলাম ১০ টাকা: রোজিনা

  •    
  • ৫ মে, ২০২২ ১৭:০২

‘আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একজন লোক আমাকে ডাকলেন। পরে বুঝেছি উনি সহকারী পরিচালক। তিনি এসে বললেন, এই মেয়ে এদিকে আস। সবাই তো হতভম্ব। কেন ডাকছে। পরে সেই সহকারী পরিচালক বুঝিয়ে দিলেন যে, তাদের একটি দৃশ্যের জন্য একজন মেয়ে দরকার।’

শুটিং দেখতে এসে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন রেনু নামে মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় আসা একটি মেয়ে। দৃশ্য ছিল ট্রেতে করে কিছু জিনিস নিয়ে এসে টেবিলে রাখার। এই ছোট্ট দৃশ্যের জন্য তিনি পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ১০ টাকা। অভিনয়ের পেশায় সেটি তার প্রথম আয়।

সেই রেনু পরে হয়ে ওঠেন চিত্রনায়িকা রোজিনা। ওই প্রথম অভিনয়ের কয়েক বছরের মাথায় তিনি গাড়ি কেনেন ৭০ হাজার টাকায়। ব্যস্ত হয়ে যান সিনেমায়। এক দিনে তিন-চারটি সিনেমার শুটিং করেছেন এ অভিনেত্রী। জিতেছেন দর্শকের হৃদয়।

কসাই সিনেমার জন্য ১৯৮০ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী ও ১৯৮৮ সালে জীবনধারা সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী রোজিনা মাঝে মাঝেই দেশে আসেন। ফিরে দেখা নামে সম্প্রতি একটি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। সেটা মুক্তি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আরেকটি সিনেমা করার ইচ্ছা আছে তার।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আসা, শৈশব, বেড়ে ওঠাসহ নানা বিষয় নিয়ে রোজিনা কথা বলেছেন নিউজবাংলার সঙ্গে।

সাদাকালো সিনেমার আমলে তরুণ বয়সী অভিনেত্রী রোজিনা। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা

রোজিনার নিজের ভাষ্যে:

‘জন্ম আমার গোয়ালন্দে, নানির বাড়িতে। রাজবাড়ি আমার বাবার বাড়ি।

‘আমরা চার বোন, দুই ভাই। শৈশবের অনেকটা সময় আমার গোয়ালন্দে কেটেছে। স্কুলজীবনটা আমার ছিল রাজবাড়িতেই।

‘রাজবাড়িতে চিত্রা হল ছিল (এখন যেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, মার্কেট করা হচ্ছে)। আমাদের বাড়ি থেকে সিনেমা হলের দূরত্ব ত্রিশ মিনিটের। বাড়ির পাশেই ছিল মসজিদ। মাগরিবের আজানের পরপর শুরু হতো সন্ধ্যার শো।

‘আমার মা সিনেমা দেখা পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন না আমি সিনেমা দেখি। সিনেমায় অভিনয়টাও পছন্দ করতেন না।

‘আমরা পাঁচ-ছয় বান্ধবী ছিলাম, একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। বাড়ির পাশ দিয়ে সিনেমার বিজ্ঞাপনের মাইকিং হতো রিকশায়। সেই বিজ্ঞাপন দেখার পর বান্ধবীদের মধ্যে আলোচনা চলত, যে-সিনেমা আসছে, সেটা দেখতেই হবে। কিন্তু আমাদের বাসা থেকে তো অনুমতি পাওয়া যাবে না।

‘তখন আমরা বুদ্ধি করতাম। সবাই মিলে বাসায় বলতাম, আমরা আমাদের এক বান্ধবীর বাড়িতে ঘুমাব। এভাবে আমরা এসব বলে সিনেমা দেখতে যেতাম।

‘মাগরিবের আজান দেয়ার পর সিনেমা দেখতে চলে যেতাম। স্কুলের টাকা বাঁচিয়ে রাখতাম সিনেমার টিকিট কেনার জন্য। যেদিন সিনেমা দেখতাম, তার পরদিন স্কুলে যেতাম না।

‘যখন কোনো বিয়েবাড়িতে বা অনুষ্ঠানে মাইকে গান বাজত, তখন পাশেই কোথাও বসে থাকতাম, গান শুনতাম।

‘বেড়ে ওঠার সময় থেকে সিনেমা আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।

‘বিকেলবেলা আমাদের বাড়িতে পণ্ডিত আসতেন, আমরা পড়তে বসতাম। আমি পড়া দিতে না পারলে তিনি আমার মাকে ডাকতেন। বলতেন, “রেনুর মা, তোমার মেয়ে আজ স্কুলে যায়নি।” মা বলতেন, “পিটান ধইরা।” আর বেতের বাড়ি দিতেন পণ্ডিত।

‘আমি একটু চঞ্চল ছিলাম। বান্ধবীদের সঙ্গে আম পেড়ে খাওয়া, কাঁঠাল পেড়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখা– এগুলো করার জন্য বকাঝকাও খেতাম। আশপাশের অনেকে জানত যে ওরা কয়েকজন আছে, একটু দুষ্টু।

‘যেদিন আমার মা মারতেন, সেদিন আমি পালিয়ে নানাবাড়ি চলে যেতাম। ট্রেনে চলে যেতাম, বেশিক্ষণ লাগত না। এভাবে যাওয়া-আসার মধ্যেই থাকতাম। এভাবে বেড়ে ওঠা।

রোজিনা অভিনীত হিট সিনেমা ’রাজমহল’ এর পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে ঢাকায় আসা

‘শাবানা ম্যাডাম, কবরী ম্যাডামদের দেখে ভাবতাম, এভাবে নাচব, গাইব, অভিনয় করব। আমার বাবার সঙ্গে ব্যবসা করতেন আলীজান ভাই। তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন, আমরা কখনও ঢাকা গেলে তার ওখানে যেতাম। পুরান ঢাকায় থাকতেন তিনি। তারা এলাকায় বাৎসরিক নাটকের অনুষ্ঠান করতেন। বাবার কাছে এলে অনেক সময় এসব নিয়ে গল্প করতেন। ওনার আবার চলচ্চিত্রের কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল। আমি তাকে মাঝে মাঝে বলতাম, “আমি অভিনয় করব, আমাকে নিয়ে যান।” তিনি বলতেন যে “না, খালাম্মা তোকে যেতে দেবে না।”

‘একদিন আমার মা খুব মেরেছিল। আমি রাগ করে চলে গিয়েছিলাম আলী ভাইদের বাড়িতে। এভাবে আমার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পা বাড়ানো।

‘সিনেমায় অভিনয় করে যে টাকা পাওয়া যায়, আমি জানতাম না। এটা ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা বলছি।

‘আমার মা ভেবেছিলেন, আমি গোয়ালন্দে গিয়েছি। এক দিন পর খবর নিয়ে দেখেন যে আমি নানাবাড়ি যাইনি। মা তো খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তখন নানা-মামা বেঁচে ছিলেন। পরে আমার চাচা দুই দিন পর ঢাকা গেলেন ছবি নিয়ে। পরে তিনি দেখলেন, আমি আলীজানদের বাড়িতে।

‘পরে আমার মা চলে এলেন ঢাকায়। যখনই শুনলাম মা আসছেন, আমি তো এই বাড়ি পালাই, সেই বাড়ি পালাই, চৌকির নিচে লুকাই। আমার মা দৌড়াচ্ছেন আমার পিছে পিছে। আমার মা দুই দিন থেকে আবার চলে গেলেন।'

প্রথম অভিনয়

‘আলী ভাইরা একটা নাটকের মহড়া দিচ্ছিলেন, বাৎসরিক নাটক। আমি সেই মহড়া গিয়ে দেখতাম। যেদিন নাটকটি মঞ্চস্থ হবে, তার দুই দিন আগে হিরোইন অসুস্থ হয়ে গেল। পরে আমাকে বলা হলো অভিনয় করতে।

‘রিহার্সেল না করে কীভাবে অভিনয় করব, আমি তো না না করছিলাম, কিন্তু তাতে কাজ হলো না। আমাকে কাজটা করতেই হলো। দুই দিন রিহার্সেল করেছি। লালবাগের শায়েস্তা খান হলে সেই নাটক মঞ্চস্থ হয়।

‘আলী ভাইয়ের পরিচিত চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ এসেছিলেন সেই নাটকের শো-তে। ওখান থেকে আমি একটি বিজ্ঞাপনের অফার পাই। বিজ্ঞাপনটি ছিল মায়া বড়ির (জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল)।

উপমহাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে রোজিনা (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

ক্যামেরার সামনে প্রথম

‘খেজুর বাগানে বেরাতে গিয়েছিলাম। তখনও সংসদ ভবন উদ্বোধন হয়নি। আলী ভাই আর তার ভাগনিদের সঙ্গে গিয়েছিলাম। দেখি শুটিং হচ্ছে। সিনেমাটির নাম ছিল জানোয়ার। কালীদাশ বাবু ছিলেন পরিচালক আর ওয়াসিম ভাই ছিলেন হিরো, হিরোইন ছিলেন সুচরিতা ম্যাডাম।

‘শুটিংটা ছিল এমন যে, একটা মঞ্চ। সেখানে নাচ হবে। সামনে টেবিল, তার ওপর বিভিন্ন রকম বোতল।

‘আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একজন লোক আমাকে ডাকলেন। পরে বুঝেছি উনি সহকারী পরিচালক। তিনি এসে বললেন, এই মেয়ে এদিকে আস। সবাই তো হতভম্ব। কেন ডাকছে। পরে সেই সহকারী পরিচালক বুঝিয়ে দিলেন যে, তাদের একটি দৃশ্যের জন্য একজন মেয়ে দরকার।

‘দৃশ্যটি এমন: একটা মেয়ে ট্রে-তে করে বোতল-গ্লাস নিয়ে গিয়ে টেবিলে রাখবে। এটাই তার কাজ এবং এটাই হলো দৃশ্য।

‘আমি গেলাম। আমাকে মেকআপ রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। প্যান্ট-শার্ট পরানো হলো। গায়ে লাগছিল না। তারপরও জোর করে পরানো হলো। পরে ফ্লোরে এসে রিহার্সেল দিলাম। দারাশিকো ছিলেন, শর্বরী ম্যাডাম ছিলেন নৃত্যে।

‘আমার শুটিং হয়ে গেল। মেকআপ রুমে গিয়ে আবার সব খুলে রেখে আসলাম। বের হওয়ার পর আমাকে ১০ টাকা দেয়া হলো। সেটাই বলতে গেলে আমার সিনেমায় অভিনয়ের প্রথম ইনকাম।

প্রথম ফটোশুট

‘এর মধ্যে বলে রাখি, সিনেমার যে মুভি ক্যামেরাম্যান ছিলেন, তিনি স্টিল ফটোগ্রাফারকে বললেন, মেয়েটার চেহারা তো খুব শার্প, ওর কিছু ছবি তুলে রাখ। আমি তো ছবি তুলে চলে আসলাম। কিন্তু সেই ছবিগুলো ছড়িয়ে গিয়েছিল।

সিনেমার জন্য ইন্টারভিউ

‘চঞ্চল মাহমুদের (অভিনেতা) সঙ্গে একটি কাজ করার কথা চলছিল। পরিচালক কে ছিলেন মনে নেই, আফজাল সাহেব ছিলেন প্রযোজক, তিনি মারা গেছেন। আমাকে সঞ্চিতা দিলেন পড়ার জন্য। বললেন জোরে জোরে পড়।

‘পড়লাম। ওনারা আমাকে সিলেক্ট করলেন। বললেন, নাচ এবং অভিনয় শিখতে হবে। তখনও আমি আলী ভাইয়ের বাসাতেই থাকছি এবং কাজগুলো অনেক কম সময়ের মধ্যে হয়ে যাচ্ছে। অনেক দিন ধরে থাকছি, কষ্ট করছি, এমন না।

‘সেই সিনেমার শুটিং শুরু হলো। এর মধ্যে আমি মহড়া শেষ করেছি। শুটিং করছি বলধা গার্ডেনে। এর মধ্যে আমার পক্স (জলবসন্ত) হয়েছিল। সব ঠিক হয়ে গেলেও মুখের একটি পক্সের দাগ শুকাচ্ছিল না। ওটার দাগ এখনও রয়ে গেছে। সেটা শুটিংয়ের সময় মেকআপ দিয়ে কাভার করতে অনেক সময় লাগছিল। শেষ করে বাগানের মধ্যে গেলাম, গিয়ে দেখি ম্যাডাম কবরী বসে আছেন। আমার একটু অবাক লাগল। কারণ সিনেমায় তো আমার একক নায়িকা হবার কথা। একদিন শুটিং করলাম। বাসায় ফিরে আলী ভাই আর মাকে বললাম, এখানে তো আমার একক নায়িকা হবার কথা। এরপর আমি আর শুটিংয়ে যাইনি।

‘সিনেমায় আমার কোনো গডফাদার নেই বা এমন কোনো গার্জিয়ান ছিল না যে আমার সঙ্গে সব সময় থাকে। তখন গুলিস্তানে ছিল প্রযোজকদের অফিস। সেখানে গিয়ে আমি কিন্তু বসে থাকিনি।

অভিনেত্রী রোজিনা। ছবি: সংগৃহীত

রেনু থেকে রোজিনা

‘এর মধ্যে মিন্টু আমার নাম সিনেমার প্রস্তাব এলো। ওই সিনেমা থেকে আমার নাম হলো রোজিনা। আমি তো নতুন। মহিউদ্দিন স্যার ছিলেন, সবাই তাকে “স্যার” বলে ডাকত। তিনি অনেক যোগবিয়োগ করে আমার এ নাম দিয়েছিলেন। সিনেমাটির প্রেস কনফারেন্স হয়েছিল। সিনেমার চরিত্রের নামও রাখা হয়েছিল রোজিনা, যেন নামটি পপুলার হয়।

‘এর মধ্যে আরেকটি সিনেমা করেছিলাম। ওটার নাম ছিল আয়না। সেখানে আমার নাম দেয়া হয়েছিল শায়লা। এসব কিন্তু খুব দ্রুত হয়ে যাচ্ছে।

জনপ্রিয়তা পাওয়া

‘১৯৭৮ এ রাজমহল সিনেমা রিলিজ হলো। তখন আমি বেশ হিট। সবাই ভালোবাসে। তখন অনেক কাভার স্টোরি হয়েছে আমাকে নিয়ে। চিত্রালীতে বেশি হয়েছে।

‘নারায়ণগঞ্জে শুটিং হচ্ছিল। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকত। ফারুক ভাই (নায়ক ফারুক) ওই ছেলেকে গিয়ে একদিন বলল যে আমি নাকি তাকে বলেছি টাক হয়ে যেতে। সেই ছেলে পরদিন টাক হয়ে এসেছে।

‘আরেকবার মহেশখালী গিয়েছি শুটিং করতে। সেখানে এক পাগলা ভক্ত এলো। আমার জন্য পাগল। পারভেজ ভাই ছিলেন হিরো। ভক্তকে পারভেজ ভাই বললেন যে একদিন খাসির রোস্ট করে খাওয়াও, তাহলে রোজিনার সঙ্গে কথা বলতে দেব। সেই ভক্ত তো তাই করে নিয়ে এসেছে।

‘এমন অনেক ঘটনা আছে।

‘নিজ এলাকায় গেলে তখন লোকেলোকারণ্য। দেয়াল টপকে আমাকে দেখতে আসত। আমি তাদের সঙ্গে সব সময় কথা বলতাম, অবহেলা করতাম না। আমি তো সেখানকারই মেয়ে।

অভিনেত্রী রোজিনা। ছবি: সংগৃহীত

ব্যস্ততা ও অ্যাওয়ার্ড

‘পাঁচ-ছয় বছরের বেশি সময় ধরে আমি সবচেয়ে বেশি শুটিং করেছি। আমার অভিনীত সবচেয়ে বেশি সিনেমা রিলিজ হয়েছে। এফডিসিতে আমি ৩ থেকে ৪টি সিনেমার শুটিং করতাম।

‘আমি কিন্তু যৌথ প্রযোজনার সিনেমাও অনেক করেছি। আমি পাকিস্তানি সিনেমা করে নিগার অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছি।

এ বিভাগের আরো খবর