প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাছে বিরল মেধার মানুষ হিসেবে পরিচিত। চলচ্চিত্রকারের পাশাপাশি তিনি ছিলেন কবি, লেখক ও নাট্যব্যক্তিত্ব। তার নির্মিত সিনেমার আবেদন সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে চিরকালের।
ঋত্বিক ভারতীয় ‘মাস্টার ফিল্ম মেকার’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হলেও তার নাড়ি পোঁতা রয়েছে বাংলাদেশেই।
ঢাকার সূত্রাপুরে ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর জন্ম নেয়া ঋত্বিকের জীবনের কৈশোর-তারুণ্যের একটা বড় সময় কেটেছে রাজশাহীতে। বিভিন্ন লেখকের লেখায় এমন তথ্য পাওয়া যায়। এসব লেখার কোনোটিতে ঋত্বিক রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়ালেখা করেছেন বলেও বলা হয়েছে।
ঋত্বিকের রাজশাহীতে অবস্থানের সময়সীমা নিয়ে এসব লেখায় কিছু বিভ্রান্তি থাকলেও নগরীর মিঞাপাড়াতে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল যে জমিতে অবস্থিত, সেটিই যে ঋত্বিকের পৈতৃক ভিটা, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে জমির কাগজপত্রে।
এখানে মোট ৩৪ শতক জমির অর্ধেকজুড়ে হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতালের একটি দ্বিতল ভবন রয়েছে। এর পাশেই হলুদ রঙের কয়েকটি ঘরসহ কিছু অংশ ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক ভিটার টিকে থাকা অংশ। এটি হাসপাতালের আউটডোর ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘরগুলোর কোথাও কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে।
এই ৩৪ শতক জমির কাগজপত্রে মালিক হিসেবে ঋত্বিক ঘটকের মা ইন্দুবালা দাসী এবং তার স্বামী হিসেবে সুরেশচন্দ্র ঘটকের (ঋত্বিকের বাবা) নাম রয়েছে।
সংস্কৃতিপ্রেমীরা বলছেন, এ দেশে ঋত্বিক ঘটকের এই একমাত্র স্মৃতিচিহ্নটি বছরের পর বছর অবহেলায় পড়ে আছে। তার স্মৃতিবিজড়িত ঘরটিকে সাইকেল গ্যারেজও বানিয়েছিল হোমিও কলেজ কর্তৃপক্ষ।
তাদের আন্দোলনের পর ঋত্বিকের বসতবাড়ি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। তবে সেই উদ্যোগ এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায়।
দেশভাগের পরে ঋত্বিকের পরিবার ১৯৫০ সালের দিকে এই ভিটা ছেড়ে ভারতে চলে যায়। পাকিস্তান আমলে এই ভিটাকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরশাদের সরকারের আমলে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক কলেজের নামে এই ভিটা ইজারা দেয়া হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ পরে তা খারিজ ও নামজারি করে নিজেদের নামে করে নেয়।
চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ড. সাজ্জাদ বকুল জানান, ঋত্বিক ঘটক এমন একজন চলচ্চিত্রকার যাকে শুধু ভারত-বাংলাদেশই নয়, সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রবোদ্ধারা সমীহের চোখে দেখে থাকেন। তার চলচ্চিত্রে শোষিত, নিপীড়িত, নিঃস্ব, নিরন্ন মানুষের জীবন যেভাবে উঠে এসেছে, তা অমূল্য মানবিক দলিল হিসেবে স্বীকৃত। যা বলার তা সোজাসাপ্টায় তিনি চলচ্চিত্রে বলে গিয়েছেন। ভারতের নামকরা চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে’ উপাধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন ঋত্বিক।
এমন একজন ব্যক্তিত্বের পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীতে, এই তথ্য রাজশাহীর লোকজন আগে জানতেন না বলে জানান সাজ্জাদ।
তিনি বলেন, ‘ঋত্বিক ছকে-বাঁধা, কেতাদুরস্ত কোনো চলচ্চিত্রকার ছিলেন না। ব্যবসাসফল বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রকার তো ছিলেন না, সে বলাই বাহুল্য। তাই তার চলচ্চিত্র নিয়ে, তার চিন্তাচেতনার জগৎ নিয়ে সাধারণ মানুষ খুব বেশি জানেন না। তাই রাজশাহীতে ঋত্বিকের পৈতৃক ভিটা থাকার খবর চাউর হওয়ার সময় দেখা যায়, রাজশাহীর সাধারণ মানুষও ঋত্বিক সম্পর্কে জানেন খুব কম।’
রাজশাহীতে ঋত্বিক ঘটকের নামে ‘ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। এরপর থেকে ঋত্বিক ঘটকের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর ৪ নভেম্বর ঋত্বিক সম্মাননা পদক প্রদান ও চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠান ঋত্বিকের ভিটায় গড়ে ওঠা কলেজ আঙিনাতেই করা হয়ে আসছে। তখন থেকে রাজশাহীবাসী জানতে শুরু করে যে এটি ঋত্বিকের পৈতৃক ভিটা।
সাজ্জাদ বকুল বলেন, ‘শুরুতে হোমিওপ্যাথিক কলেজ কর্তৃপক্ষ এই ভিটা যে খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের তা-ই মানতে চাননি। পরে ঋত্বিকের বোন প্রতীতি দেবী, ভাইঝি মহাশ্বেতা দেবী ও প্রতীতির মেয়ে আরমা দত্ত যখন এই ভিটায় এসে তাদের পরিবারের স্মৃতিচারণা করেছেন, তখন ধীরে ধীরে কর্তৃপক্ষ সেটা স্বীকার করে নেন। তারপরে তারা আবার নতুন দাবি তুলে ধরে বলতে থাকেন, এই ভিটা ঋত্বিক ঘটকদের হলেও ঘরগুলো অনেক পরে করা।’
সাজ্জাদ বকুল জানান, হোমিওপ্যাথিক কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত এই ভিটার একটি অংশের দেয়াল ও ঘর ভেঙে কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকেল গ্যারেজের নির্মাণকাজ শুরু করে। তখন রাজশাহীর ‘ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির’ নেতৃত্বে চলচ্চিত্র সংসদকর্মীরা এর প্রতিবাদ শুরু করে।
প্রতিবাদের খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ঋত্বিকের বাড়ি সংরক্ষণ করে তার নামে একটি চলচ্চিত্রকেন্দ্র ও জাদুঘর গড়ে তোলার দাবিতে রাজশাহীর চলচ্চিত্র সংসদগুলোর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক কর্মীরা ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করেন। হোমিওপ্যাথি কলেজ কর্তৃপক্ষ পরে গ্যারেজ নির্মাণের কাজ বন্ধ করে।
রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, ‘এটি একটি এনিমি প্রপার্টি। আমরা এটি কিনে নিয়েছি। এটির খাজনাও আমরাই দিই। ১৯৬৬ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত।
‘আমাদের অর্থ সংকট আছে। তারপরও আমরা আমাদের সাধ্যমতোই সংস্কার করতে গেছিলাম। তখনই এটি ভেঙে ফেলার অভিযোগ ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসন এটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমি জানি।’
ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি এফএমএ জাহিদ জানান, এই বাড়ি সংরক্ষণের দাবি উঠেছে ২০০৮ সালেই। সেই থেকে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ সবই করেছে রাজশাহীর সংস্কৃতিকর্মীরা। এক যুগ পরও তাদের দাবি পূরণ হয়নি। শুধু চিঠি চালাচালিতে সীমাবদ্ধ।
জাহিদ আরও জানান, গত ডিসেম্বরে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি সংরক্ষণের জন্য তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নজরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দেয় জেলা প্রশাসন। ২০২১ সালের মে মাসে গণপূর্ত বিভাগ একটি পরিকল্পনা পাঠায় জেলা প্রশাসনের কাছে। চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর এটি রাজশাহীর জেলা প্রশাসক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ঋত্বিক ঘটকের বসতবাড়ি সংরক্ষণ করার জন্য আন্দোলন করেছিলাম। এটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারলে আমরা আমাদের পরের প্রজন্মকে কী দেখাব? সেই লক্ষ্যে আমরা মানববন্ধনসহ আন্দোলন করে এসেছি। সেই সুবাদে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নজরে আসে। এরপর প্রতিমন্ত্রী নিজে এখানে এসেছেন। শিল্পকলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক এখানে এসেছেন। তাদের নির্দেশনায় জেলা প্রশাসক ৭ সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছেন। পরে এটি সংরক্ষণের জন্য তারা একটি পরিকল্পনা করেন। গণপূর্ত বিভাগকে দায়িত্ব দেয়।’
সংরক্ষণের উদ্যোগ বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি যখন সরকারি পর্যায়ে চলে গেল, তখন তারা করোনার জন্য দেরি হয়েছে বলতে চায়। তাদের অনীহা ছিল। কিছু সময় তারা ফাইল পেয়েও দেরি করে। পরে আমাদের সেই ফাইলের অনুলিপি নিয়ে গিয়ে কাজ করতে হয়েছে। আমরা এই বাড়ি সংরক্ষণ করেই ছাড়ব। আমরা চেষ্টা করেই যাব বাড়ি সংরক্ষণ না হওয়া পর্যন্ত।’
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, ‘স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্য আমরা ৫৬ লাখ টাকার একটি এস্টিমেট করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এটা যেই অবস্থায় আছে, এটিকে ডিজাইন করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে এই বাড়িটি সংরক্ষণের কাজ শুরু করব।’