ছোট পর্দার পরিচিত মুখ মনোজ কুমার প্রামাণিক। ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মেও বিচরণ বাড়ছে তার। এর বাইরেও পরিচয় আছে তার। ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে পড়ান তিনি।
এ মুহূর্তে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বেশ কিছু কাজে ব্যস্ত মনোজ। ওয়েব ফিল্মের পাশাপাশি সম্প্রতি একটি ওয়েব সিরিজেও কাজ করেছেন। তবে কোন প্ল্যাটফর্মের জন্য কাজ করছেন, তা বড় বিষয় নয় মনোজের কাছে। তার আগ্রহের বিষয় শুধু অভিনয়।
অভিনয় ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা জানান মনোজ।
কোন চরিত্র কেমন লাগে
এ পর্যন্ত অনেক চরিত্রেই অভিনয় করেছেন মনোজ। এর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে বেশি কঠিন লেগেছে, তা জানতে চাওয়া হয় অভিনেতার কাছে।
জবাবে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে কোনো চরিত্রই কঠিন বা সহজ লাগে না। সব একটা প্রসেসের মধ্য দিয়ে যায়। সবগুলো সম্পর্কে একটু গবেষণার দরকার আছে; চিন্তাভাবনার দরকার আছে। কখনো সেটা করতে পারি, কখনো সেটা সঠিকভাবে করতে পারি না সময়ের অভাবে। সব চরিত্র আমার কাছে একই রকম মনে হয়।’
বেছে বেছে কাজ করেন কি না, জানতে চাইলে মনোজ বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে এত বাছাই করে কাজ করার সুযোগ আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এখনও তৈরি হয়নি। আমাদের কাজের পরিমাণ বাড়ছে, কিন্তু ভালো কাজের পরিমাণ আসলে এখনও অনেক কম। বিশেষ করে টেলিভিশনে আমরা যারা কাজ করি, আমাদের বাজেট-সময় সবকিছু মিলিয়ে আসলে বেছে...
অভিনেতা মনোজ কুমার প্রামাণিক। ছবি: সংগৃহীত‘অনেকেই আমরা বলি বেছে বেছে কাজ করছি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এত বেছে কাজ করার সুযোগ থাকে না। এখন দেখা যাচ্ছে, যদি ৮০-৯০ পারসেন্ট গল্পই খারাপ হয়, ডিরেকশন খারাপ হয় বা ৮০-৯০ পারসেন্টই যদি আমাদের অল্প সময়, অল্প বাজেটের মধ্যে করতে হয়, তাহলে এর মধ্যে যদি আমি বাদ দিয়ে যাই, বেছে করতে হয়, তাহলে বেশির ভাগই বাদ পড়ে যাবে। যদি ভাবি শুধু ভালোগুলো করব, তখন তো পেট চলবে না। তো এত বেছে আমাদের কাজ করা হয় না।’
তিনি বলেন, ‘অনেক ক্র্যাশ কাজ তো আমারও আছে। সবারই আছে। কোনো কাজ খাটো করে বলছি না। এটা আমাদের করতে হয়। আমরা যারা অভিনয় করি সবাই আসলে চাই অভিনয়টা ভালো করে করতে এবং এমন কোনো অভিনয় করতে যেটাতে দর্শক আমাদেরকে ভালোবাসবে; দর্শকের ভালো লাগবে।’
‘টেলিভিশন নাটকের অবস্থা খুবই খারাপ’
নাটকের সার্বিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনপ্রিয় ও প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেতা মনোজ বলেন, ‘আমাদের নাটকের বাজেট নাই। আমাদের নাটকের যারা ডিরেকশন দিচ্ছেন তাদের কোয়ালিটি যথেষ্ট ভালো না। সবার না; বেশির ভাগেরই। এমন অল্প আয়োজনের মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়। ডিরেক্টর যদি ভালো করতে চানও, যদি টাইম দিতে চান, তাহলে সেই বাজেট নেই। একটা প্রোডাকশনের পেছনে সময় এক মাস, দুই মাস, পাঁচ মাস যে দেবেন, চলবে কীভাবে। সো এই কন্ডিশনের মধ্যে টেলিভিশন নাটকের অবস্থা খুবই খারাপ।
অভিনেতা মনোজ কুমার প্রামাণিক। ছবি: সংগৃহীত‘তারপরও আমরা করে যাচ্ছি। কারণ আমাদের জীবিকা; এটা প্রয়োজন। এর মধ্যে থেকেই কিছু কাজ হয়তো ভালোও হচ্ছে। বাজারে ১০টা হলে তার মধ্যে হয়তো তিনটা-চারটা ভালো হচ্ছে। আর বাকি সাতটাই হয়তো সে রকমভাবে মানের হচ্ছে না।’
‘সিনেমার ডিরেক্টরদের আরও টেকনিক্যাল হতে হবে’
নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে সিনেমা নিয়ে নিজ ভাবনার কথা জানান মনোজ।
তিনি বলেন, ‘সিনেমার ক্ষেত্রে আমি বলব, লকডাউনের কারণে সিনেমা দেড়-দুই বছর যাবৎ বন্ধই আছে। আমরা কোনো সিনেমা দেখতে পাচ্ছি না। সিনেমার ক্ষেত্রে আমি বলব যে, টেকনিক্যালি আরও ডেভেলপ করতে হবে। আমার তাই মনে হয়। আমাদের আইডিয়া আছে অনেক ভালো। তারপরে ডিরেক্টরিয়াল হেড আছে, ক্রিয়েটিভ আছে, অভিনেতা-অভিনেত্রী আছে, কিন্তু টেকনিক্যাল ক্রু টিম যেটা সেইটা নাই বা ডিরেক্টরদেরকেও আরও টেকনিক্যাল হতে হবে। অনেক ম্যাথমেটিক্যাল হতে হবে।
‘ম্যাথমেটিক্স বলছি। অবশ্যই এটা একটা টেকনিক্যাল কাজ, কিন্তু একই সাথে অনেক কিছুর ম্যাথমেটিক্সের ফলে ফিল্ম তৈরি হয়। তো সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয় তাদেরকে আরও টেকনিক্যাল হওয়া উচিত। ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজটা সম্পর্কে আরও বোঝা উচিত, জানা উচিত এবং ওই প্র্যাকটিসটা হওয়া উচিত। তাহলে আরও ভালো সিনেমা এখানে হবে। হচ্ছে না, তা না। অনেকেই খুব ভালো করছেন। কান, বুসান লেগেই আছে। আমাদের অনেক সিনেমা অনেক দেশে প্রশংসিত হচ্ছে।’
‘অভিনেতাদের কাছে ওটিটি, টেলিভিশন, ফিল্মের পার্থক্য নাই’
মনোজের কথায় উঠে আসে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের বিষয়টি। তিনি মনে করেন, অভিনেতাদের কাছে প্ল্যাটফর্ম নয়, অভিনয়ই মুখ্য বিষয়।
‘একসময় মানুষ তো মাঠেঘাটে অভিনয় করত, একসময় মঞ্চ তৈরি করে সেখানে অভিনয় করেছে। তারপরে টেলিভিশন বা ফিল্মের ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেছে। অভিনয় দেখানো হয়েছে প্রজেক্টরে; টেলিভিশনে দেখেছি আমরা। তারপর আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখছি’, বলেন মনোজ।
অভিনেতা মনোজ কুমার প্রামাণিক। ছবি: সংগৃহীত‘আসলে মাধ্যমটা সব সময় চেঞ্জ হয়। যারা অভিনয় করেন তাদের কাছে ওটিটি, টেলিভিশন, ফিল্ম—এগুলোর কোনো পার্থক্য নাই। যদি কাজটা ভালো হয় তাহলে ভালো, যদি ভালো না হয় ভালো না। ওটিটি মানেই যে সব ভালো হয়ে যাবে বা হচ্ছে তা নয়’, যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘অনেক ওটিটি এখন দেখা যায় যে, কোয়ালিটি অ্যাচিভ করতে পারি নাই। আবার অনেকগুলো বেশ ভালো যাচ্ছে আরকি। তো অভিনেতাদের কাছে কোনো প্ল্যাটফর্ম কোনো বিষয় না।’
ওটিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এ অভিনেতা বলেন, ‘এখন যদি বলেন ওটিটির ভবিষ্যৎ কী? ডেফিনেটলি, একসময় মহাকাব্য রচিত হতো; মাঝখানে কোনো মহাকাব্য রচিত হয়নি। অনুকাব্য হয়ে গেছে, অনুকবিতা হয়ে গেছে। এখন কিন্তু আবার দেখবেন ওয়েব সিরিজ নামের যা হচ্ছে, এটা আবার এপিসোডি মহাকাব্যিক। তাই না? এটা আসলে ঘুরে ঘুরে আসে। ওটিটি এখন আছে, এখন ওটিটিতেই সবাই কাজ করবে। জানি না বিজ্ঞান কী আবিষ্কার করবে তারপরে।’
‘নীতিমালা দিয়ে কাকে আটকাবেন?’
ওটিটির নীতিমালা নিয়ে মনোজ বলেন, ‘নীতিমালা দিয়ে মানুষের নীতিকে, বিবেককে আসলে বেঁধে রাখা যায় না বা মানুষের খারাপ কোনো কিছুকে নীতি দিয়ে বাঁধা যায় না। তাহলে এত এত যে আইনের বই তৈরি হইছে পৃথিবীতে বা এত এত যে নীতি তৈরি হইছে পৃথিবীতে, কই আমি দেখি না যে পৃথিবীর মানুষ খুন করা বন্ধ রাখছে। ইন অ্যা ওয়ে দ্য কিল, ইন অ্যা ওয়ে দ্য লাভ টু।
‘সো যিনি শিল্পী, যিনি কিছু বানাচ্ছেন, ধরেই নিতে হবে যে তিনি শুদ্ধ একজন মানুষ। তিনি ভালোর জন্য, মঙ্গলের জন্যই কিছু করছেন। তাকে আসলে নীতিমালা দিয়ে বাঁধা যাবে না। যদি নীতিমালা দিয়ে বাঁধতেই হয় তাহলে তো সিনেমায় এখন…।’
নীতিমালা সব ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য কি না, সে প্রশ্নও তোলেন মনোজ।
তিনি বলেন, ‘এটা আসলে খুব কনফিউজিং একটা ব্যাপার। নীতিমালা দিয়ে বলা হলো যে, ধরেন সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য দেখানো যাবে না। কোনো চরিত্র যদি সিগারেটখোর হয়, তখন কী করবেন? সো তখন নীতিমালাটা কীভাবে অ্যাপ্লাই করবেন বা ধরেন অনেক ক্ষেত্রে আছে যৌনতা দেখানো যাবে না বলা হয়। যৌনতা তো জীবনের একটা অংশ। সেটা কেন দেখানো যাবে না? আর মানুষ কি ইন্টারনেটে পর্নো মুভি দেখতেছে না? ইন্টারনেটে ঢুকলে তারা যেকোনো ধরনের যৌন দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে।
‘তো কাকে আটকাবেন এই নীতিমালা দিয়ে? আমি বলতেছি না যে এ ধরনের দৃশ্যে গল্প ভরে দাও। তা না। কিন্তু এই দৃশ্যগুলো আমাদের জীবনের অংশ। এই দৃশ্যগুলো দেখানোই যাবে না, এটা আসলে মুশকিল।’
অভিনেতা মনোজ কুমার প্রামাণিক। ছবি: সংগৃহীতনীতিমালার অসুবিধা তুলে ধরে মনোজ বলেন, ‘এই প্রতিবন্ধকতা কীভাবে উতরানো যাবে? প্রথমত, আমি মনে করি নীতিমালা দিয়ে কোনো লাভ হয় না। দ্বিতীয়ত, নীতিমালা যতই কঠিন হোক না কেন, যিনি ক্রিয়েটিভ, যার মাথায় সৃষ্টিশীলতা আছে, তিনি কোনো না কোনো ওয়ে আউট করে নেন। সমস্যাটা এই দৃশ্য দেখানো যাবে বা এই দৃশ্য দেখানো যাবে না, এটাতে না; সমস্যা হচ্ছে একটা মানুষ কী বলতে চায়, সেটা সে কোনো না কোনোভাবে বলার ওয়ে খুঁজে নিতে পারে বুদ্ধি থাকলে।
‘এখন কী বলতে চাই সেটাকে থামানোই হচ্ছে নীতিমালার কাজ। কী দেখানো হচ্ছে এটা গুরুত্বপূর্ণ না, যখন মূলে গিয়ে আঘাত লাগে তখন আসলে নীতিমালার প্রয়োজন হয়। আমি সরকারকে, দেশের নিয়মকে কোনো কিছুকে খাটো করে বলছি না। কিন্তু জাস্ট একজন শিল্পী যে জায়গা থেকে অনুভব করে, সে জায়গা থেকে বলছি।’
তিনি বলেন, ‘নীতিমালার কোনো প্রয়োজন আছে মনে করি না। আবার নীতিমালা যদি দেয়ও, শিল্পীর তাতে কিছু যায় আসে না। সে একটা ওয়ে খুঁজে নিবে।’
অভিনয় নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান এ অভিনেতা।
তিনি বলেন, ‘অভিনয় নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। ভালো ভালো কাজ করতে চাই, ভালো গল্পে, ভালো ডিরেক্টরদের সঙ্গে। আর চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে কাজ করতে চাই।’