বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শূন্যে ভাসমান যার কবিতা

  •    
  • ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ২০:০১

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জারিফাই বিশ্বের প্রথম কবি যিনি নিজের সৃষ্টিকর্ম ধরে রাখতে নিজস্ব লিপি তৈরি করেছেন। উর্দু শিক্ষক সেরাজ আনসারি বলেন, ‘কবিতার ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি, আমি বিশ্বের কোথাও এমন ধরনের কবিতা দেখিনি। উনি যা বলছেন তা সত্যি হলে বিশ্বে তিনি এক অনন্য কবি।’

কাশ্মীরের জারিফা জান অদ্ভূত এক লিপি তৈরি করেছেন নিজের কবিতা লেখার জন্যে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় প্রচলিত কাশ্মীরি, হিন্দি বা উর্দু লিপিতে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারায় নিজেই তৈরি করেছেন অক্ষরলিপি। সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইসের সাংবাদিক রউফ ফিদা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এই কাশ্মীরি কবির। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য সেটি অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।জারিফা জান একটি কাগজ তুলে দিলেন, যেটিতে ছিল পেন্সিলে আঁকা কিছু বৃত্ত। কাছ থেকে দেখার পর বোঝা গেল, সবগুলো বৃত্ত এক রকম নয়– কিছু বড়, কিছু পুরোপুরি বৃত্তাকার নয়, কয়েক জোড়া বৃত্ত কাছাকাছি, কোনোটির ওপর আবার অসংখ্য বৃত্ত আঁকা হয়েছে। সারিবদ্ধভাবে সেগুলো আঁকা হয়েছে। সেগুলোর পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করতে করতেই তিনি একটি পেন্সিল দিয়ে আরেকটি কাগজে বৃত্ত আঁকা শুরু করলেন। উর্দু ও কাশ্মীরি লিপি যেভাবে লেখা সেভাবে– ডান থেকে বামে।জারিফার ছেলে শাফাত লোনে বলেন, ‘আমার মা ছাড়া এই লেখা বিশ্বের কেউ পড়তে পারবে না।’এই লাইনগুলো আসলে জারিফার নিজস্ব ভাষালিপি। নিজের কবিতাকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তিনি এই লিপি তৈরি করেছেন।ভারতের কাশ্মীরের বান্দিপুরা জেলার ৬৫ বছর বয়সী এই সুফি কবি কখনও স্কুলে যাননি। কাশ্মীরি বলতে পারলেও লিখতে বা পড়তে পারেন না।ইসলামের একটি বিশেষ ধারা সুফিবাদ। এটি মূলধারা থেকে আলাদা একটি বিশ্বাস, যেটি ধর্মীয় জীবনের গুঢ় বিষয় নিয়ে কথা বলে। এর মাধ্যমে সুফিরা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সরাসরি ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রচেষ্টায় থাকেন।জারিফা আমাকে বেশ গর্ব করেই বললেন, ‘এটা আমার ভাষা। এটা শূন্যের ভাষা। বহু বছরের চেষ্টায় আমি এটি বানিয়েছি।’বিয়ের কয়েক বছর পর চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে জারিফার সঙ্গে কবিতার পরিচয়। বাড়ির পাশের নদী থেকে একদিন পানি আনতে গিয়েছিলেন। তার দাবি, সেখানে হঠাৎ করেই একটি ঘোরের মধ্যে চলে যান ও দিগ্বিবিদিক শূন্য হয়ে পড়েন। ধাতস্থ হওয়ার পর টের পান তার কলসি খোয়া গেছে। এর চেয়েও বড় কথা, নিজেকে নতুন একজন মানুষ মনে হতে থাকে তার।তিনি বলেন, ‘হুঁশ ফেরামাত্র আমার মুখ দিয়ে একটি গজল বেরিয়ে আসে।’গজল বিশেষ এক ধরনের কবিতা বা গান, যার উৎপত্তি আরবি কবিতা থেকে। প্রেম, কামনা বা বিরহকে উপজীব্য করেই সাধারণত গজল রচনা করা হয়ে থাকে।জারিফা যোগ করেন, ‘ওই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল না কবিতা কী। কারণ আমি কখনও এর আগে কবিতা পড়িনি। তবে এর পর আমি শত শত কবিতা ও গজল লিখেছি।’নিজের রচিত একটি কবিতা পড়ে শোনান তিনি:‘পানিয়ে সোয়ারান আম ইয়াউনিয়েলালুনিয়ে থোভথাম নার।ইয়াউ মিউন চাম্বি দুলউনিয়েয়ইয়ি চু সামসারা নাপাইদার।’

(আমি যৌবন ধ্বংস হতে দেইনি, কারণ আমার ভেতরে স্ফূলিঙ্গ ছিল। তবু এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় আমার যৌবন অলীক।)জারিফা যখন বুঝতে পারেন তিনি কবিতা লিখতে পারছেন, তখন তার ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ে। তারা ইংরেজি ও উর্দুতে লিখতে ও পড়তে পারত। তবে জারিফার কবিতাগুলো ছিল কাশ্মীরিতে। অবহেলিত এই ভাষার ব্যবহার কমছে খোদ কাশ্মীরেই।জারিফা বলেন, ‘তাদেরকে আরেকটা ভাষা শিখতে বলে লাভ হতো না। বিষয়টি ঠিকও হতো না। কারণ তাদেরকে শেখাত কে? স্কুলে ইংরেজি বা উর্দুর মতো কাশ্মীরি ভাষার কোনো বিষয় নেই। এছাড়া আমি নিশ্চিত ছিলাম না, আদৌ আমার কবিতার কথা কাউকে বলব কিনা।’কয়েক বছর পর তিনি সবাইকে নিজের কবিতার কথা বলার সাহস পান। প্রথমে তার স্বামীকে বলেন, এরপর বলেন সন্তানদের। তাকে অবাক করে দিয়ে সবাই কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। তবে নিজের মাত্র কয়েকটি কবিতা মুখস্ত ও মনে রাখতে পেরেছিলেন তিনি; অধিকাংশই সংরক্ষণ না করায় ভুলে গিয়েছিলেন।শুরুর দিকে শাফাত সেগুলো টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে রাখেন। জারিফার বড় মেয়ে কুলসুম অল্পবিস্তর কাশ্মীরি জানতেন। কুলসুম চেষ্টা করেন কাশ্মীরিতে সেগুলো লিখে রাখতে। তবে জারিফা এই পদ্ধতিতে কবিতা সংরক্ষণ করায় সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না।তিনি বলেন, ‘আমি তো কবিতা পড়ে দেয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের সব জায়গায় নিয়ে যেতে পারব না। অথবা তাদের বলতে পারি না যে, আমার কানে কানে বলে দাও আর আমি অন্যদের সেগুলো আবৃত্তি করে শোনাই। এছাড়া আমার মাথায় যখন একটা কবিতা আসবে তখন ওরা রেকর্ড করে বা কাগজে লিখে দেয়ার জন্যে আমার সঙ্গে নাও থাকতে পারে।’

নিজের উদ্ভাবিত লিপিতে কবিতা পড়ছেন জারিফা জান। ছবি: সংগৃহীত

আর এ কারণেই জারিফা লেখার একটি নিজস্ব পদ্ধতি বের করেন।মাথায় যখনই কোনো কবিতা আসে তিনি একটি কাগজে বিভিন্ন আকৃতির বস্তু এঁকে ফেলেন। কিছু বৃত্ত থাকে আক্ষরিক অর্থে।উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কবিতায় যদি কোনো শব্দ থাকে আপেল, তাহলে আমি একটা আপেল আঁকি। যদি হৃদয়ের কথা থাকে, তাহলে আমি সেই চিহ্ন আঁকি।’পরে যখন তার মেয়ে সময় পেতো জারিফা ওই বৃত্তগুলোর অর্থ বলতেন, আর কুলসুম কবিতাগুলোকে সাধারণ ভাষায় লিপিবদ্ধ করতেন।

জারিফা যোগ করেন, ‘আমি তো পড়াশোনা করিনি। কখনও কলমই ধরিনি। যে কারণে আমি যাই আঁকতাম সেটা বৃত্তের মতো হয়ে যেত। আমি একটি কলা আঁকতে গেলেও সেটি বৃত্তাকার হতো।’ওই অদ্ভূত বৃত্তগুলো কবিতার চরণ মনে করিয়ে দিতে তার সামনে ইঙ্গিত হিসেবে কাজ করত। কুলসুম সেগুলো লিখে রাখতেন। তবে তিন বছর আগে কুলসুমের মৃত্যুতে সেটিও থেমে যায়।শোকাহত জারিফা কিছু সময়ের জন্য কবিতা লেখা বন্ধ রাখেন। তবে শোক কাটিয়ে কিছুদিন পর আবার সেই বৃত্তাকার লেখাগুলো পড়া শুরু করেন তিনি।তিনি বুঝতে পারেন, বহু বছর ধরে বৃত্তগুলোকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে করতে নতুন একটি লিপি তিনি তৈরি করে ফেলেছেন। একমাত্র তিনিই এটি পড়তে পারেন। এগুলো নির্দিষ্ট কোনো শব্দকোষ নয়, যেখানে একটি আকৃতির শুধু একটি অর্থই আছে। এর অর্থগুলো বদলাতে থাকে। কারণ, তিনি একেক সময়ে একেকটির জন্য একেক অর্থ ঠিক করেন। যেগুলো শুধু তার পক্ষে বোঝা ও মনে রাখা সম্ভব।পৃষ্ঠাভর্তি এই আকাবাঁকা বৃত্তগুলো কয়েকটি বইয়ের মধ্যে রাখা। প্রায় ৩০০ কবিতা তিনি লিখেছেন। তার পরিবার চেষ্টা করছে, বৃত্তলিপির পাশাপাশি সাধারণ লিপিতে অনুবাদ করে এগুলো ছাপানোর।বিশেষজ্ঞদের ধারণা জারিফাই বিশ্বের প্রথম কবি যিনি নিজের সৃষ্টিকর্ম ধরে রাখতে নিজস্ব লিপি তৈরি করেছেন।

উর্দু শিক্ষক সেরাজ আনসারি বলেন, ‘কবিতার ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি, আমি বিশ্বের কোথাও এমন ধরনের কবিতা দেখিনি। উনি যা বলছেন তা সত্যি হলে বিশ্বে তিনি এক অনন্য কবি।’জারিফার ছেলে জানান, অনেকেই এই বৃত্তগুলো থেকে তার মায়ের পাঠোদ্ধার করার দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখেন। তাদের ধারণা, জারিফার আসলে কবিতাগুলো মনে আছে। উনি বৃত্ত দেখে পড়ার ভান করেন।তবে কাশ্মীরের অন্যতম বিখ্যাত ও পুরনো সুফি কবি আব কারিম পারওয়ানা জারিফার কথা বিশ্বাস করেন।তিনি বলেন, ‘বিশ্বে এমন কোনো কবি নেই, যিনি নিজের সব লেখাই মুখস্থ রাখতে পারেন। আমি এমন কাউকে দেখিনি বা কাউকে বলতে শুনিনি যে, তারা নিজেদের কবিতার সংগ্রহ মনে রেখেছেন। উনি একজন মিস্টিক কবি। আর মিস্টিসিজমে সবকিছুই সম্ভব।’

এ বিভাগের আরো খবর