মেয়েসন্তান জন্ম দেয়ায় চার দিনের নবজাতকসহ গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে যে নারীকে স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে; সেই গৃহবধূ রোকসানা খাতুন সন্তানের পিতৃপরিচয় ও নির্যাতনের বিচার চেয়ে এবার আদালতে হাজির হয়েছেন।
রোববার দুপুর ১টায় গাইবান্ধা নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক আবদুর রহমানের আদালতে ১৩ দিন বয়সী মেয়েকে কোলে নিয়ে রোকসানা খাতুন বাদী হয়ে মামলা করেছেন।
রোকসানা খাতুনের পক্ষে মামলাটি লড়ছেন আইনজীবী হাসিবুল ইসলাম হ্যাপি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মক্কেলকে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন চার দিনের শিশুবাচ্চাসহ তাড়িয়ে দিয়েছেন। এর আগে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ২ লাখ টাকা যৌতুক না পেয়ে রোকসানাকে নির্যাতন করে। রোকসানাকে করা নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে তার শরীরে, যার ছাড়পত্র আমার হাতে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘আশা করি মূল আসামি রোকসানার স্বামীর সঠিক বিচার আমরা দেখতে পাব।’
গত ১১ মার্চ চার দিন বয়সী মেয়েকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে গেলে রোকসানাকে বিতাড়িত করা হয়। এ অমানবিক ঘটনাটি সর্বপ্রথম সরেজমিন গিয়ে তথ্যবহুল সংবাদ প্রচার করে অনলাইন সংবাদমাধ্যম নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম।
চার দিনের নবজাতকসহ মাকে বিতাড়িত করার খবরটি নিউজবাংলায় প্রচারের পর দেশজুড়ে ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। তবে এই অমানবিক ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও রোকসানার পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনও তার খোঁজ রাখেনি।
আদালতের বারান্দায় মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে গৃহবধূ রোকসানা খাতুন বলেন, ‘যৌতুক দিতে না পারায় ও (স্বামী) আমাকে ডিভোর্স করে। আমি আমার স্বামীর কঠিনতম শাস্তি চাই। আমার মতো কেউ যেন মেয়েসন্তান জন্ম দিয়ে এভাবে স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত না হয়। আমি যদি আমার সন্তানের বাপের পরিচয় দিতে না পারি; তবে আমি আমার স্বামী রাজা মিয়ার ফাঁসি চাই।’
রোকসানা আরও বলেন, ‘চার দিনের বাচ্চাটার কী দোষ। ও মেয়ে তাই বাবার বাড়িতে জায়গা পায় নাই। ভাবছিলাম, ওরা ভুল বুঝতে পারবে। বাবুসহ আমাকে ঘরে নেবে। কিন্তু না, ওরা একবারও বাবুটার খবর নিল না।’
রোকসানার মামা মো. লতিফ বলেন, ‘যৌতুকের জন্য আমার ভাগনিকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। চার দিনের মেয়েশিশুসহ তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন রোকসানার স্বামী বলছে; ওরা নাকি আমার ভাগনিকে তালাক দিয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে বিয়ের পর থেকে গত ৮ মার্চ পর্যন্ত কীভাবে তারা আমার ভাগনিকে তাদের বাড়িতে রাখল?’
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত মেয়ে জন্ম দেয়ার কারণেই তারা আমার ভাগনিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ছেলে জন্ম দিলে হয়তোবা তারা ভাগনিকে বাড়িতে উঠতে দিত, সংসারও হতো।’
গত ৮ মার্চ রোকসানা রংপুরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে মেয়েসন্তান জন্ম দেন। পরে ১১ মার্চ দুপুরে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের ঘোমামারা গ্রামে স্বামী রাজা মিয়ার বাড়িতে চার দিনের নবজাতকসহ যান রোকসানা। কিন্তু কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার কারণে নবজাতকসহ ওই মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। পরে বাধ্য হয়ে রোকসানা মেয়েসহ সুন্দরগঞ্জে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন।
এদিকে দরিদ্র দিনমজুর বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রোকসানা পড়েছেন বিপাকে। অস্ত্রোপচারে জন্ম নেয়া শিশুটি বুকের দুধ পান না করায় তাকে বাজারের কেনা দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। তা ছাড়া রোকসানাকেও নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছে।
এসবের জোগান ঠিকভাবে দেয়া তার বাবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এখন কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে রোকসানা ও তার নবজাতকের।
চোখের পানি ফেলে রোকসানার বাবা লুৎফর রহমান বলেন, ‘কামলা খাটি খাই হামরা। বেটিক ভালো ঘরত বিয়ে দিনো। এখন কী হলো এগলে। হামারে চলে না। বেটিক-নাতনিক কী খিলেই এখন।’
লুৎফর রহমান মেয়ের চিকিৎসা, ওষুধ, নাতনির দুধ ও মামলার অর্থের জন্য বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন।