এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ‘বি’ গ্রুপকে আগে থেকেই বলা হচ্ছিল গ্রুপ অফ ডেথ। এই গ্রুপে ইতোমধ্যে প্রথম ম্যাচে লঙ্কানদের কাছে ৫ উইকেটের হার দিয়ে এশিয়ান মিশন শুরু করেছে সাকিব আল হাসানের দল। ফলে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তাদের শেষ ম্যাচটি ‘ডু অর ডাই’-এ পরিণত হয়েছে।
শেষ ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপের সুপার ফোরে খেলার আশা বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর টিম টাইগার, তবে এ ম্যাচে শুধু জিতলেই এখন চলবে না, তাকিয়ে থাকতে হবে নানা সমীকরণের দিকে। কেননা বাংলাদেশের সুপার ফোর-ভাগ্য নির্ভর করবে মঙ্গলবার আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের ওপরও।
ক্রিকেট দুনিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক নবীন আফগানিস্তান। আফগানিস্তান প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ২০০৯ সালে। আর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় ১৯৮৬ সালে। যদিও মূল সমস্যা হলো আফগানিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ হলেই বাড়তি মানসিক চাপ ভর করে বাংলাদেশ দলের ওপর।
অতীতের ম্যাচগুলোতে আফগানিস্তানের সঙ্গে পরাজয়ের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা দর্শকের বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়েছিল। আর কেনই বা সমালোচনা করবে না। বোমার শব্দ আর বারুদের গন্ধে বেড়ে ওঠে আফগান শিশুরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান যেন এক মৃত্যুপুরী। স্বল্পসময়ে আবির্ভাব হলেও দারুণ ক্রিকেট খেলে মোহাম্মদ নবী, রশিদ খানরা।
টাইগারদের এ ম্যাচটি আজ পাকিস্তানের লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে শুরু হবে বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৩টায়। বাঁচা-মরার এ লড়াইয়ের আগে একটু পেছনে তাকাতে চাই। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গত এশিয়া কাপেও ‘বি’ গ্রুপে ছিল আফগানিস্তান, যেখানে তাদের সঙ্গী ছিল বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। শক্তিমত্তার বিচারে গ্রুপের আন্ডারডগ ছিল আফগানিস্তান। সেবার গ্রুপ পর্বে তারা যা করে দেখিয়েছে, সেটাই বা কতজন ভেবেছিল? প্রথমে শ্রীলঙ্কা, এরপর বাংলাদেশকেও হারিয়েছে হেসেখেলেই। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সুপার ফোরে জায়গা করে নিয়ে সব হিসাব পাল্টে দিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা সেই রিদম ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত আসরের পুরোনো কাসুন্দি নতুন করে ঘাঁটার কারণ, এবারের আসরেও একই গ্রুপে পড়েছে এই তিন দল। এসব কথা বলার কারণ সর্বশেষ আসরের মতো এবারও আফগানরা শক্তিমত্তার বিচারে আন্ডারডগ, কিন্তু বাস্তবচিত্র আর পরিসংখ্যান অনেকটাই ভিন্ন। এই যেমন বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের শেষ ওয়ানডে সিরিজের কথাই ধরুন না। সেখানে বাংলাদেশ শেষ ম্যাচে জিতে ধবল ধোলাই হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। ওই সিরিজে তামিম ইকবালের অবসরের নাটকের পর ২০১৫ সাল থেকে ইংল্যান্ডের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে বাংলাদেশের মাঠে আধিপত্য বিস্তার করে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল আফগানিস্তান।
এবার একটু পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিতে চাই। বলা হয়ে থাকে পরিসংখ্যান একটা গাধা। কারণ পরিসংখ্যান দিয়ে কিছু যায়-আসে না; যদি না দল মাঠের খেলায় ভালো পারফরম্যান্স করতে পারে। পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশই। দুই দল এখন পর্যন্ত ১৪ বার এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে উভয়ের মোকাবিলা করেছে। এর মধ্যে ৮টিতে জয় টাইগারদের ও ছয়টিতে জয় রশিদ বাহিনীর।
এশিয়া কাপের এবারের আসরটা যেহেতু ওয়ানডে ফরম্যাটে হচ্ছে, তাই বাংলাদেশ কিঞ্চিত স্বস্তিতে থাকতেই পারে, তবে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। একদিকে বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স এবং অনভিজ্ঞ তরুণ ক্রিকেটার, অন্যদিকে আফগানদের রশিদ খান, মোহাম্মদ নবী, ফজল হক ফারুকির মতো অভিজ্ঞ বোলার।
আফগানদের বিপক্ষে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা নড়বড়ে ব্যাটিং লাইনআপ। এই মুহূর্তে ওপেনার, খেলোয়াড়দের সামর্থ্য আর ফর্ম নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে বাংলাদেশের। টুর্নামেন্টের আগে নানা নাটকীয়তার পর বাংলাদেশের সাবেক ওয়ানডে অধিনায়ক ও অভিজ্ঞ ওপেনিং ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল টুর্নামেন্ট থেকে সরে দাঁড়ান। সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসান বলেছেন, এই টুর্নামেন্টে অভিজ্ঞ তামিম ইকবালের না থাকা বাংলাদেশ দলের জন্য ক্ষতি।
ওপেনিংয়ে এখন পর্যন্ত একবারও তামিমকে আউট করতে পারেননি মুজিব উর রহমান। ইনিংসের শুরুর দিকে দুজনের চারবারের দেখায় সবকটিতে জিতেছেন তামিম ইকবাল। এদিকে অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান লিটন দাসও নেই। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারের গুরুদায়িত্ব থাকবে মুশফিকুর রহিমের কাঁধেই। তরুণ তাওহীদ হৃদয়ের দারুণ সম্ভাবনা আছে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার। এ ছাড়া রয়েছে দলের ব্যাটিংয়ের লোয়ার মিডল অর্ডারে পরীক্ষিত পারফর্মার না থাকার বিষয়টি।
শামীম পাটোয়ারী, আফিফ হোসেন, মেহেদি মিরাজ, মাহেদি হাসানরা ব্যাটিংয়ের সাত নম্বরে খেলতে পারেন, কিন্তু একমাত্র মেহেদি মিরাজ বাদে অন্য কারও পরিসংখ্যান বা সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সই তেমন আশা জাগানিয়া নয়।
বাংলাদেশ দলের মূল শক্তি সবসময়ই ছিল স্পিন বোলিং আর মিডল অর্ডার ব্যাটিং। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফাস্ট বোলিং। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানদের বিপক্ষে ভালো করতে হলে সব বিভাগেই ভালো করতে হবে। ব্যাটিংয়ে ফর্মে রয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। আগের ম্যাচে অসাধারণ খেলেছেন তিনি। এ ছাড়া সাকিব আল হাসান আর মুশফিকুর রহিম শুধু অভিজ্ঞতার হিসেবেই নয়, পারফরম্যান্সের দিক থেকেও নিশ্চিতভাবে দলের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা।
বোলিংয়ে বাংলাদেশ দলের প্রধান শক্তির জায়গা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এ ছাড়া নাসুম, মিরাজকে নিয়ে গঠিত স্পিন অ্যাটাক যেকোনো দেশকে ভোগাতে যথেষ্ট। পেসার তাসকিন, মুস্তাফিজ, হাসান মাহমুদের ওপর বাড়তি নজর থাকবে।
ভুলে যাবেন না আফগানিস্তানের টপ-অর্ডারের সঙ্গে বাংলাদেশের টপ-অর্ডারের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আফগানিস্তানের টপ-অর্ডার দলের প্রয়োজনে দ্রুতগতিতে রান তুলতে সক্ষম। ওপেনিংয়ে আছেন মারকুটে ক্রিকেটার হজরতুল্লাহ জাজাই। মেরে খেলতে পছন্দ করেন জাজাই ও রহমানউল্লাহ গুরবাজ। আফগান ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজ যেকোনো বড় দলের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারেন।
মাত্র ২৪ ওয়ানডেতে এরই মধ্যে ৫টি সেঞ্চুরি ও দুটি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন গুরবাজ। কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৫২ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। সব মিলিয়ে আফগানদের ইনিংসের ভিত গড়ার দায়িত্বটা তার কাঁধেই থাকছে। গুরবাজের সঙ্গে ওপেন করবেন ইব্রাহিম জাদরান। তার সাম্প্রতিক ফর্ম খুব একটা ভালো না হলেও ইতোমধ্যেই তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। বড় মঞ্চেই স্বরূপে ফিরবেন এই ওপেনার, এমনটাই চাইবে টিম ম্যানেজমেন্ট। এই দুজনের ব্যাকআপ হিসেবে আছেন রিয়াজ হাসান।
তিন নম্বরের গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে থাকবেন রহমত শাহ। চারে খেলবেন হাশমতউল্লাহ শাহিদি। অধিনায়কত্ব সামলানোর পাশাপাশি দলকে বড় সংগ্রহ এনে দিতে ব্যাট হাতেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। পাঁচে খেলবেন নজিবুল্লাহ জাদরান। অভিজ্ঞ এই ব্যাটার মিডল অর্ডারে বড় ভরসার নাম। তার পাওয়ার হিটিং বাংলাদেশের বড় চিন্তার বিষয়।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সতর্কবার্তা পেয়ে গেছে ফজল হক ফারুকিকে নিয়ে। আফগানিস্তানের বাঁ হাতি এই ফাস্ট বোলার বাংলাদেশের টপ-অর্ডারকে বেশ ভুগিয়েছেন দ্বিপক্ষীয় সিরিজে। তাদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকার নাম রশিদ খান। মুজিব-রশিদদের ঘূর্ণিতে বিপর্যস্ত হয়েছিল টাইগাররা।
আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের মূল শক্তি স্পিনাররাই। দেশটির স্কোয়াডে আছে বেশ কয়েকজন অলরাউন্ডার। ১৭ জনের স্কোয়াডে ব্যাটিং-বোলিং দুটিই করতে পারেন ছয়জন। এসব বিষয় নিয়ে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ দলের বাড়তি পরিকল্পনা থাকবে। পরিকল্পনা থাকবে আফগানিস্তানেরও। তাই লড়াইটা মোটেও সহজ হবে না।
ইতোমধ্যেই লাহোরে পৌঁছে অনুশীলন করেছে বাংলাদেশ। ইতিবাচক দিক হচ্ছে লাহোরের উইকেট সাধারণত ব্যাটিং সহায়ক হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরু কিংবা বাংলাদেশ ক্যাপ্টেন কি সেটি ধরতে পারবেন নাকি প্রথম ম্যাচের মতোই ভুল করবেন? টসে কে জিতছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। টসে জিতে ব্যাটিং বা বোলিং নেয়ার ক্ষেত্রে অধিনায়কদের বেশ ভাবতে হয় এখানে। প্রথম কারণ, এই ফরম্যাটে লক্ষ্য জানা থাকাটা ভালো, আবার লক্ষ্য যদি সামর্থ্যকে ছাড়িয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে বিপদ। তাই নিজেদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরিকল্পনার বাস্তবায়নটা মিললেই সাফল্য পাওয়া সম্ভব।
আর শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের কন্ডিশন, উইকেট, প্রতিপক্ষ আর নিজেদের শক্তিমত্তা সবদিক বিবেচনায় এবারের এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বড় প্রতিপক্ষ হিসেবেই থাকবে রশিদ খান-মুজিব উর রহমানরা। কাগজে-কলমে আফগানদের তুলনায় এক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ। অতীত সমীকরণ কথা বলছে টাইগারদের হয়ে, কিন্তু মাঠের লড়াইয়ের আগে হলফ করে বলা মুশকিল কে জিতবে।
বাংলাদেশ সমীকরণে এগিয়ে থাকলেও মাঠের লড়াইয়ে পিছিয়ে নেই আফগানিস্তান। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগান দলটি ক্রিকেটে পা রাখার পর থেকেই দারুণ খেলছে। এশিয়ার ছোট দল হয়েও চোখ রাঙাচ্ছে বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে আমি বাজিটা রাখব বাংলাদেশের পক্ষে।
বাংলাদেশ এই ম্যাচ জিতেই পরবর্তী রাউন্ড, অর্থাৎ সুপার ফোরে খেলবে। কেননা গত আসরে প্রথম ম্যাচ হেরেও এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল শ্রীলঙ্কা। আর্জেন্টিনাও বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ হেরেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তাই আমরাও আশা করতেই পারি টিম টাইগার্স শেষ পর্যন্ত সব বাধা অতিক্রম করে চ্যাম্পিয়নের মতো কামব্যাক করবে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক বাংলা