নতুন কর আইন, ২০২৩ এই সপ্তাহে সংসদে উপস্থাপন করা হবে বলে আশা করা যায়। আইনটি অত্যন্ত সরল বাংলায় লেখা হয়েছে এবং আয়ের সব উৎসকে অধ্যায়ভিত্তিক একীভূত করা হয়েছে। এটি একজন ব্যবহারকারীকে একটি উৎস থেকে সমস্ত প্রাসঙ্গিক আয় এবং সেই অধ্যায় থেকে বিয়োজন খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।
গাণিতিক সূত্রের ব্যবহার সবার জন্য কর নির্ধারণ সহজ করে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেতন থেকে আয় নির্ধারণ সহজ হবে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, যা খুব সহজভাবে অর্থ বুঝতে সাহায্য করবে। গ্রসিং-আপ কনসেপ্ট যে কাউকে বুঝতে সাহায্য করবে যে কীভাবে কোনো লেনদেন নেট ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হয় এবং ভিত্তিমূল্য গণনা করতে হয়।
আমরা যখন রিভিউ কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছি, তখন আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নতুন আইনকে সহজতর করা, বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কর কর্তৃপক্ষের অযৌক্তিক ক্ষমতা হ্রাস, ব্যবসায়ের খরচ কমানো এবং আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডসের (আইএফআরএস) সঙ্গে দ্বন্দ্বটি পর্যাপ্তভাবে কমানো হয়েছে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়জনিত লাভ/ক্ষতির প্রয়োগ, ধারণাগত পরিসম্পদের অনিষ্টজনিত ক্ষতি, সম্পদ ব্যবহারের অধিকারের প্রয়োগ, বিনিয়োগ সম্পত্তি পুনর্মূল্যায়নে লাভ ইত্যাদি।
ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে (ডব্লিউপিপিএফ) অবদান এখন গ্রহণযোগ্য ব্যয়ের তালিকায় রয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়িক ব্যয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে, অ্যামোর্টাইজেশন সময়সূচিতে এমন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা মূলধনের প্রকৃতির কারণে অনুমোদিত নয়।
মোটরযানের ব্যয়ের সীমা ৩০ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। কিছু অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছ সত্তা যথা: এসপিভির আয় করমুক্ত করা হয়েছে এমন সত্তার বিকাশের জন্য। উইথহোল্ডিং ট্যাক্স রিটার্নের সংখ্যা ২৯ থেকে কমিয়ে ১২টি করা হয়েছে।
বেশির ভাগ রিটার্ন সর্বজনীন স্বনির্ধারণ ভিত্তিতে জমার বিধান করা হয়েছে। সুতরাং খুব কম করদাতাকে নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে যদি না ফাইলটি নিরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়। অডিট প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ করা হয়েছে। ডিজিটালাইজেশনের জন্য আলাদা অধ্যায় চালু করা হয়েছে, তবে বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যথাযথ বাজেটসহ একটি বিস্তৃত আইটি কৌশল বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত আমরা এর সুফল পেতে সক্ষম হব না।
পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পারসনস, ২ কোটি টাকার বেশি টার্নওভারের একটি ফান্ডকে নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী জমা, ইটিআইএনের নিবন্ধন বাতিল এবং আরও ছয়টি সেবা বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন জমার (পিএসআর) আওতায় আনা প্রকৃতপক্ষেই করের জাল তৈরি/বৃদ্ধি করবে।
আইনটি আন্তর্জাতিক সেরা অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শেয়ারভিত্তিক পেমেন্ট, ডিমার্জার-সম্পর্কিত বিধান, থিন ক্যাপিটালাইজেশন এবং জেনারেল অ্যান্টি অ্যাভয়ডেন্স রুল (জিএএআর) চালু করা হয়েছে। তদুপরি, রিফান্ড প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করা হয়েছে যা দেশে ব্যবসা করার সহজতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে এবং করদাতাদের তহবিল ফেরতকে ত্বরান্বিত করবে। এটি কেবল ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ের জন্য তারল্য বৃদ্ধি করবে না; বরং এটি কর ব্যবস্থার ওপর সামগ্রিক বিশ্বাসও বাড়াবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্তর্ভুক্তির ফলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায্যতার ওপর আইনের দৃষ্টিকে জোরদার করবে। করদাতাদের কর প্রদানে উৎসাহ দেবে।
এ পরিবর্তনগুলো, বিশেষত জিএএআর প্রবর্তন এবং থিন ক্যাপিটালাইজেশন রোধের পদক্ষেপগুলো কর ফাঁকি এবং কর এড়ানো প্রতিরোধের বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে। ফলস্বরূপ আইনটি এখন ট্যাক্সের জন্য আরও বিস্তৃত, ন্যায্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ কাঠামো সরবরাহ করবে।
অন্যদিকে টিডিএস হার কমানোর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বরং এটি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এটি কোম্পানির ব্যয় বাড়িয়ে তুলবে। আমরা টিডিএস হারকে যৌক্তিক করার প্রস্তাব করেছি। কারণ এখন ডিজিটাল ভেরিফিকেশন সিস্টেমের (ডিভিএস) মাধ্যমে মুনাফা/বিক্রয় অনুপাত শনাক্ত করা সহজ। আবার এটিও সত্যিই যে, টিডিএসের ওপর সরকারের বিশাল নির্ভরতা রয়েছে। তাই এই কথা মাথায় রেখে টিডিএসে আমূল পরিবর্তন আশা করা যায় না।
বড় করপোরেট সংস্থাগুলো এখন নিজেরাই উৎপাদন করতে বাধ্য হয়। কারণ উচ্চ হারের টিডিএসের কারণে এসএমই থেকে সোর্সিংয়ের ব্যয় বেড়ে যায়। ন্যূনতম করের বিধানের ক্ষেত্রে, কার্বনেটেড পানীয়র ওপর ন্যূনতম কর ৮৩০ শতাংশ বৃদ্ধি সত্যিই বিস্ময়কর। এর জন্য এই শিল্পকে ন্যূনতম করের দায় নিষ্পত্তি করার জন্য তহবিল ধার করতে হবে।
প্রস্তাবিত আইনটিতে লোকসানে থাকা কোনো সংস্থার অন্যান্য আয়ের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি সমন্বয়ের বিধান নাই, যা লোকসান নির্ধারণের সাধারণ নীতি থেকে সরে যায়। বিলম্বিত রিটার্ন জমা একজন করদাতার জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, যা একজন করদাতাকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।
সরকারি সিকিউরিটিজ বিনিয়োগের ওপর হঠাৎ করে সীমা আরোপের বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ কোনো ব্যক্তির যোগ্য সিকিউরিটিজগুলোতে বিনিয়োগের জন্য সীমিত বিকল্প রয়েছে। শেয়ারে বিনিয়োগকে যেমন ছিল, তেমনই রাখার জন্য ধন্যবাদ, তবে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের সীমা প্রবর্তন করা উচিত নয়। কারণ আমরা আরও করপোরেট বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ দেখতে চাই।
আমরা এখনও নিশ্চিত নই যে নতুন কর আইনের বিধিগুলো কখন চালু করা হবে এবং কর আইনের ইংরেজি সংস্করণ কখন প্রকাশ হবে, যা আমাদের বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) অংশীদারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আমি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমার মতামত শেয়ার করছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই ধরনের প্রগতিশীল কর আইন অবশ্যই বাংলাদেশকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, যদি উল্লিখিত প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা যায়।
লেখক: পরিচালক, এসএমএসি অ্যাডভাইজারি সার্ভিসেস লিমিটেড