‘সু-স্বাস্থ্যের মূলনীতি, নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যবিধি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি দিবসটি উপলক্ষে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও।
দিবসটি পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাদ্য সম্পর্কে সবার মাঝে সচেতনতা জাগিয়ে তোলা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিগত ৫ বছর ধরে ঘটা করে দিনটি পালনের মধ্যেই আমাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে কী না। মানুষ পুষ্টিকর সুষম খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে কতটা সচেতন হয়েছে সে প্রশ্নও অবান্তর নয়।
সুষম ও নিরাপদ খাবার মানুষকে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। তেমনি আবার অনিরাপদ খাদ্য মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণা প্রচলিত যে খাবার খাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পেট ভরা।
নিরাপদ খাদ্য হলো মানসম্মত, ভেজালমুক্ত ও সঠিক গুণাগুণসমৃদ্ধ খাবার। অথচ আমাদের এখানে যেনতেনভাবে পেট ভরলেই তাকে খাবার হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। গড়পড়তা মানুষ মনে করে খাবার খেলেই হলো। পুষ্টি কী আর নিরাপদ খাদ্য কী- এসব বিষয় নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। খাদ্যের গুণাগুণ তো দূরের কথা, সেটি কতটা নিরাপদ তা নিয়েও বেশির ভাগেরই কোনো ভাবনা নেই।
আবার অনেকে মনে করেন, নামিদামি খাবার মানেই তা পুষ্টিকর। কম দামের খাবারও যে অনেক নামিদামি খাবারের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর হতে পারে সে বিষয়টি আমাদের অনেকেরই অজানা। খাবার কেনা বা গ্রহণ করার সময় দাম যাচাই না করে সেটির গুণাগুণ ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করাটা অপরিহার্য।
নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে আমরা এখনও উদাসীন। আমরা অনেকেই সময় বাঁচাতে সহজলভ্য, আকর্ষণীয় ও রেডিমেড খাবারে আসক্ত হয়ে পড়ছি। গরমে বাইরে বের হলে প্রবল তৃষ্ণায় অনেকেই ভিড় জমান রাস্তার পাশের লেবুর শরবত, ফলের জ্যুস, রং-বেরঙের পানীয় শরবতের দোকানের সামনে। অথচ সেগুলোতে ব্যবহৃত বরফের বেশিরভাগই জীবাণুযুক্ত সরবরাহ লাইনের পানি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। আবার মিষ্টি স্বাদ আনতে ক্ষতিকর স্যাকারিন এবং আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় টেক্সটাইলের বিভিন্ন রং ও কেমিক্যাল।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহরগুলোর অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভাজা-পোড়া খাবারের দোকান। পিছিয়ে নেই টক-ঝাল মেশানো চটপটির পসরাও। এসব খাবার দেখতে খুবই আকর্ষণীয়, লোভনীয়। কিন্তু এই খাবারগুলোর বেশিরভাগই তৈরি করা হয় পচা-বাসি সামগ্রী ব্যবহার করে। ভাজার ক্ষেত্রে একই তেল বার বার ব্যবহার করা হয়, যেখানে তৈরি হয় ট্র্যান্স ফ্যাট।
অনিরাপদ দূষিত পানিতে নানা উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হয় টক পানি। অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে ফাস্টফুডের দোকান, ছোট ছোট ফুডকোর্ট। এগুলো ফুটপাতের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। সেসব দোকানে চলছে কম দামে নানা ফাস্টফুড জাতীয় খাবারের রমরমা বেচাকেনা।
খাবার সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় করে তুলতে এসবে ব্যবহার করা হচ্ছে স্বাদ বর্ধক নানা উপাদান- টেস্টিং সল্ট, নানা ধরনের সস ও ক্যাচাপ। বর্তমানে খাবারের স্বাদ বাড়াতে মাত্রাতিরিক্ত হারে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট ব্যবহার করা হচ্ছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেকের বাসায় সকালে কিংবা বিকেলের নাস্তার টেবিলে থাকছে পাউরুটি ও নানা ধরনের বেকারি আইটেম। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব খাদ্যপণ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর পটাশিয়াম ব্রোমাইড ও ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি থাকে।
আমরা পুষ্টিবিদেরা সব সময়ই খাদ্য তালিকায় দেশীয় মৌসুমি ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে বলি। নির্দিষ্ট মৌসুমের ফলমূল ও শাকসবজিতে ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকে। তবে নির্দিষ্ট মৌসুম ছাড়া এবং দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা নামি-দামি বিভিন্ন ফলমূল ও শাকসবজি সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন জাতীয় বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এসব স্বাস্থ্যে জন্য ক্ষতিকর।
খাবারে উপরোক্ত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান ও দূষিত পদার্থ মেশানোর ফলে খাবার অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে শরীরে সহজে বার্ধক্য আসছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে, কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এভাবে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
অনিরাপদ খাদ্য রোগের জন্ম দেয়, অপুষ্টিকর খাদ্যে স্বাস্থ্যহানি ঘটে। একইসঙ্গে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে, অসুস্থ ও দুর্বল সন্তানের জন্ম দেয়। শিশু বয়স থেকে এসব ভেজাল ও অপুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের প্রতিক্রিয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
দুর্বল স্বাস্থ্যের জনগোষ্ঠী দিয়ে সুস্থ, সবল ও কর্মঠ জাতি গঠন সম্ভব হয় না। দেশে অনিরাপদ ও অপুষ্টিকর খাদ্যের রমরমা বাণিজ্যে এক কথায় দেশ ও জাতি হুমকির মুখে পড়ছে।
বিশ্বব্যাপী প্রতি দশজনের মধ্যে একজন খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত। নিরাপদ খাদ্য যেমন সুস্বাস্থ্যের উৎস, তেমনই অনিরাপদ খাদ্য অনেক রোগের কারণ। সেজন্য সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে রোগমুক্ত বা রোগের জটিলতামুক্ত থাকতে হবে। আর সেজন্য খাদ্য নিবার্চনের আগে সেটা কতটুকু নিরাপদ ও পুষ্টিকর তা অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে।
লেখক: পুষ্টিবিদ, ফরাজী হাসপাতাল বারিধারা ও লা মানো ডার্মা অ্যান্ড লেজার মেডিক্যাল।