বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাংবাদিকতায় কালের অভিযাত্রী তোয়াব খান

  • দুলাল আচার্য   
  • ১ অক্টোবর, ২০২২ ১৭:৩২

ত্রিকালদর্শী এক স্বপ্নীল মানুষ ছিলেন তোয়াব খান। ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও একজন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি। অনিয়ম, দুর্নীতি, মৌলবাদ, জঙ্গিতন্ত্রসহ দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে তার সাংবাদিকতা ছিল আপসহীন ও তেজদীপ্ত।

চলে গেলেন সাংবাদিকতার বটবৃক্ষ তোয়াব খান। শনিবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিংবদন্তি সাংবাদিক তোয়াব খান বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে দ্যুতি ছড়ানো গুণীজন ছিলেন।

১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক জনতার মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক হন। এরপর ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিকের ভূমিকা পালন করেন। সে সময় তার আকর্ষণীয় উপস্থাপনায় নিয়মিত প্রচারিত হয় ‘পিন্ডির প্রলাপ’ নামক অনুষ্ঠান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক পাকিস্তান থেকে বদলে যাওয়া দৈনিক বাংলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব ছিলেন। পরে তিনি প্রধান তথ্য কর্মকর্তা এবং প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশের দিন থেকেই প্রায় তিনি পত্রিকাটির উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। জীবনের শেষ দিনটি তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন। তবে মানুষের কাছে তার পরিচয় জনকণ্ঠ-এর তোয়াব খান হিসেবেই। ২০১৬ সালে সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য ‘একুশে পদক’ পান এই গুণী সাংবাদিক।।

ত্রিকালদর্শী এক স্বপ্নীল মানুষ ছিলেন তোয়াব খান। ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও একজন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি। অনিয়ম, দুর্নীতি, মৌলবাদ, জঙ্গিতন্ত্রসহ দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে তার সাংবাদিকতা ছিল আপসহীন ও তেজদীপ্ত। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, রিপোর্টিং, ফিচারসহ অন্যান্য পাতায় নিঃসংকোচে লেখা প্রকাশে দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ দিতেন।

কখনও সক্রিয় রাজনীতি করেননি। তবে রাজনীতির কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন। তার নীতি ও নৈতিকতা ছিল প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার। সাংবাদিকতার ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সঙ্গে স্মৃতিময় ঘটনা, স্বাধীনতাপূর্ব এবং পরবর্তী রাজনীতির নানা স্মৃতিময় ঘটনা তার কাছ থেকে শুনেছি। তিনি ছিলেন গুণীজন, সাংবাদিকতায় তার অবদান জীবিত অবস্থায়ই তিনি প্রমাণ দিয়ে গেছেন।

তোয়াব খানের সাংবাদিকতা ও জীবনসংগ্রাম আমার সাংবাদিকতা জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি বলতেন, সাংবাদিকতার দায়বন্ধতা সব সময় পাঠকের কাছে। কোনো সম্প্রদায়, রাজনৈতিক দল বা সরকারের কাছে নয়। সাংবাদিকদের পরীক্ষা দিতে হয় প্রতিদিন। তাই সংবাদ পরিবেশনে অতিমাত্রায় সচেতন হওয়া জরুরি। বলতেন, পাঠক যেমন কাগজের মূল প্রাণ, তেমনি তারা বিশ্লেষক ও বিচারক। আমার সাংবাদিকতার পরিপূর্ণতা তার কাছে। ২০০৯ সালে জনকণ্ঠ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিয়ে প্রথম দিকেই তার নজর কেড়েছিলাম একটি ধারাবাহিক লেখা সম্পাদনা করতে গিয়ে। লেখাটির সম্পাদনা দেখে তোয়াব ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বেশ ভালো করেছ। সব লেখাই এভাবে দেখে ছাড়বে।’ সেই থেকে বিশ্বাস আর কাজের প্রতি আন্তরিকতায় বিশ্বস্ত হই। প্রায়ই সম্পাদকীয় ও চতুরঙ্গ পাতা দেখাতে গেলে বলতেন, ‘লেখাগুলো তুমি পড়েছ তো?’ বড় লেখা কীভাবে সীমিত শব্দের মধ্যে আনতে হয়, অপ্রয়োজনীয় ও একাধিকবার ব্যবহৃত শব্দ বর্জন করে বিকল্প শব্দের ব্যবহারের নির্দেশ দিতেন। বাক্যের যোগ্যতা হারায় এমন কোনো শব্দ ব্যবহার না করার কথা বলতেন। অনেক ক্ষেত্রে শব্দ ধরে দেখিয়ে দিতেন। যেদিন আমার সম্পাদকীয় লেখার পালা ছিল, সেদিন সম্পাদকীয়টিতে কোনো অসংগতি থাকলে মার্ক করে পরিবর্তন এবং পরিমার্জনের কথা বলতেন। আসলে জনকণ্ঠ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতে গিয়ে নতুনভাবে আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি ছিল তোয়াব খানের কাছে।

২০১৯ সালে আমি জনকণ্ঠ ছেড়ে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) যোগ দিই। তোয়াব খান চাননি আমি জনকণ্ঠ ছেড়ে আসি। তিনি আমার অব্যাহতিপত্র ১৫ দিন ধরে রেখে দিয়েছিলেন। বললেন, ‘তোমার ব্যাপারে আমি মালিকের সঙ্গে কথা বলব। তুমি চলে যাও আমি চাই না।’

সর্বশেষ তিনি জনকণ্ঠ-এ আমাকে পার্টটাইমও রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাকরির শর্তের কারণে তা সম্ভব হয়নি। পিআইবিতে যোগদানের পরও তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা হতো। পিআইবির সাময়িকী নিরীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ (‘আমার তীর্থযাত্রা’) ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক তার দুটি লেখা আমরা প্রকাশ করেছিলাম। সর্বশেষ সিনিয়র সাংবাদিক আলী হাবীব ভাইকে দিয়ে তার একটি সাক্ষাৎকার করিয়ে নিরীক্ষায় প্রকাশ করেছিলাম। তোয়াব ভাইকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত বহু স্মৃতি আজও অমলিন।

আমার মতো বহু সাংবাদিকের কাছে তোয়াব খান একটি অহংকারের নাম। কারণ সাংবাদিকতায় তিনি সাধারণ থেকে অসাধারণ। সাংবাদিকতার প্রতিটি স্তরে তিনি প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে পরিণত হয়েছিলেন মহীরুহে। তাই একজন শারীরিক তোয়াব খানের চলে যাওয়া মানে সবশেষ নয়। সাংবাদিকতায় তার বর্ণাঢ্য জীবনই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। তোয়াব খান হারিয়ে যাওয়ার নয়, কারণ তার ব্যাপ্তি গণমাধ্যমব্যাপী, তিনি যে সাংবাদিকতায় কালের অভিযাত্রী।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

এ বিভাগের আরো খবর