বাংলাদেশ ও ভারত ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয় সংগীত এবং অন্য অনেক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে পারস্পরিক বোঝাপড়ার দৃঢ়তা এবং বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে, যা গড়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ ও সদিচ্ছার আলোকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এই দুই দেশের মধ্যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক শুধু রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিস্তৃত হয়েছে কৌশলগত ক্ষেত্রেও।
বাংলাদেশের বন্ধুভাবাপন্ন এই দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ সেপ্টেম্বর চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেছিলেন। ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বরের এই সরকারি সফরে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।
আশা করা হচ্ছে, এই সফর দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও উষ্ণ করবে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি করবে। সেই সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের কিছু অমীমাংসিত ইস্যু এই সফরে বাড়তি মনোযোগ পেতে পারে, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার বাইরে।
এবারের সফরে বাংলাদেশ চাইছে দুই দেশের মধ্যে যে সর্বোচ্চ সম্পর্ক, তা আরও একবার প্রমাণ করতে। বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, এমন যে মনোভাব ভারতের তৈরি হয়েছে তা দূর করতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে এক ডজনের ওপর চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক নিয়ে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি প্রস্তুতিমূলক বৈঠক যতগুলো করা সম্ভব, সেগুলো আগস্ট মাসেই হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও ভারত স্থলসীমানা, সামুদ্রিক বিরোধসহ অনেক বড় সমস্যা সমাধান করেছে এবং দুই দেশের সম্পর্ক ২০ বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিপক্ব।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে গঙ্গা চুক্তির ২৬ বছর পর কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর (এমওইউ) হতে যাচ্ছে। সমঝোতা অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারত থেকে কুশিয়ারা নদীর ১৫৩ কিউসেক পানি পাওয়ার আশা করছে।
এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন বিষয়ক দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে কুশিয়ারা স্মারক সই হওয়ার পাশাপাশি তিস্তার বিষয়ে একটি সমাধান আসতে পারে।
তিস্তা চুক্তির বিষয়ে এখন পর্যন্ত একমাত্র বাধা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। খোঁজা হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধানও। শেখ হাসিনার আসন্ন সফরে এ বিষয়ে একটি ফল পেতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সব সময়ই উদ্বেগের। সে জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের যেকোনো পর্যায়ের আলোচনায় সীমান্ত হত্যা এবং শান্তিপূর্ণ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা অন্যতম ইস্যু। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সীমান্ত হত্যা কমে এসেছে। এবারের আলোচনায়ও সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ জোর দেবে। মানব, মাদক ও সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে।
এবার সফরের অর্থনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি ‘সেপা’ (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট)। এই চুক্তি হলে ভারত ও বাংলাদেশের পণ্য দুই দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে এই চুক্তি অনুমোদন করেছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ অ্যান্টি-ডাম্পিং নীতি নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক নবায়ন হতে পারে। জ্বালানি নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতা চাওয়াসহ এ সফরে প্রায় ১০ থেকে ১২টি চুক্তি ও সমঝোতা হতে পারে। এই সফর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সহযোগিতামূলক কাঠামোর মধ্যে কিছু সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন। প্রথমত, আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন সমস্যা সমাধানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সীমান্ত হত্যা এবং সীমান্তজুড়ে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের ইস্যুটি দুই দেশের মধ্যে বিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই দশকে বিএসএফ ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। নিয়মবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ড এড়াতে যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত বৈঠক জোরদার করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, মিথ্যা খবর, গুজবের পাশাপাশি আর্থসামাজিক ইস্যুতে অপপ্রচারের দিকেও নজর দিতে হবে।
এর কারণ হলো সংখ্যালঘু নিপীড়ন সম্পর্কে গুজব তাদের সমকক্ষদের মধ্যে প্রায়ই সহিংসতা এবং নেতিবাচক অনুভূতি উসকে দেয়। অবশেষে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের কাছ থেকে আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করে। নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে ভারতকে মিয়ানমারের ওপর তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করা উচিত।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির পরিবর্তনশীল প্রকৃতির কথা মাথায় রেখে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য বিকল্প উপায় দেখতে হবে। ভারত ও বাংলাদেশ বেশির ভাগ বিষয়ে কমবেশি একমত হয়েছে। এই স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। তিস্তা নদী এবং রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো ভারতকে কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানে চাপ প্রয়োগ করতে হবে যেন বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়। বেআইনি ব্যবসা, পাচার এবং গবাদিপশুর চোরাচালান, বিশেষ করে মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রেও নজর রাখতে হবে। ভারত ও বাংলাদেশকে অবশ্যই সার্ক, বিমসটেক এবং বিবিআইএনের মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোতে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য, সংযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, সীমান্ত নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা, পানিসম্পদ, প্রতিরক্ষা এবং জনগণের মধ্যে আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বহুমুখী দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় কাজ করতে হবে।
লেখক: আকিব রহমান শান্ত