ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম-ই কেবল পারে প্রযুক্তিনির্ভর একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে।
বাংলাদেশে বর্তমানে উদ্ভাবিত এবং ব্যবহৃত ইভিএম মেশিনটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত ইভিএম মেশিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা নিয়ে ভিন্ন প্রযুক্তিতে এটি ভিন্নভাবে উদ্ভাবিত। নতুন এই মেশিনটির উদ্ভাবকদের সঙ্গে আগের মেশিনের উদ্ভাবকদের কোনো সংযোগ নেই– নেই আগের ইভিএম মেশিনের কোনো সম্পর্ক।
নতুন এই মেশিনে একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না এবং ভোটের সময় ছাড়া এর আগে বা পরের দিনে বা রাতে কখনই ভোট দেওয়া যায় না। ভোটার আঙুলের ছাপ দিলেই কেবল ইলেকট্রনিক ব্যালট পেপার ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয়, অন্যথায় নয়। ব্যালট পেপার অন হওয়ার পর ভোটার তার ভোট প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তা আবারও অকেজো হয়ে যায় এবং অন্য একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ না দেওয়া পর্যন্ত আর ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয় না। একজন ভোটার দ্বিতীয়বার ভোট দিতে চাইলে মেশিন নিজেই তাকে ভর্ৎসনা করে ফিরিয়ে দেয়।
মানুষের করা দুর্নীতির সব প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয় এই মেশিন, তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে। কোনোভাবেই কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়া যায় না বিধায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর রক্তপাতের সূত্রপাতের কোনো সুযোগ থাকে না এই ব্যবস্থায়।
শান্ত পরিবেশে নির্ভয়ে ভোট দিতে ইভিএমের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের প্রকৃত ভোটাধিকার নিশ্চিত করে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের পথকে মসৃণ ও প্রশস্ত করতে প্রয়োজন নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার।
যেকোনো নতুনত্বের মাঝেই থাকে হাজারো জিজ্ঞাসা, ভয়, সন্দেহ আর দ্যোদুল্যমানতা। তা ছাড়া এ দেশে অতীতে ঘটে যাওয়া বহুবিধ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা জনগণের মাঝে আশাতীত।
হ্যাঁ-না ভোটের প্রহসন থেকে শুরু করে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি, কেন্দ্র দখল করে একজন মাস্তানের হাজারো ভোট প্রদান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর রক্তের বন্যা প্রবাহিত করে নেতা হওয়া কিংবা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছে ঘেঁষতে না দেওয়া– কী না ঘটেছে এ দেশের নির্বাচন ঘিরে। তাই ইভিএমকে ঘিরেও রয়েছে অনেক প্রশ্ন-অনেক অবিশ্বাস, যদিও বিগত হাজারখানেক নির্বাচনে এই মেশিনের ব্যবহার প্রমাণ করেছে এর নিরপেক্ষতা এবং জনগণের আস্থা। এই নির্বাচনগুলোর কোনোটিতেই হয়নি কোনো সহিংসতা, ঝরেনি কারও রক্ত। ভোট কারচুপির কোনো প্রমাণও কেউ দেখাতে পারেনি। তবু ভয়! যা তারা দেখছে তা কি আসলেই সত্য? নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, এ বিশ্বাসই দানা বাঁধতে চায় না এ দেশের মানুষের মনে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের এই স্বপ্নের বাংলাদেশ দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, অতীতের সব ব্যর্থতা-গ্লানিকে পেছনে ফেলে, একটি ধনী উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। আর এই স্বপ্নকে টেকসই বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ, যা সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া সম্ভব নয়। ইভিএম-ই কেবল পারে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে।
একজন মানুষ, তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তার রয়েছে পরিবর্তনের স্বপ্ন, বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড় করানোর দৃঢ় প্রত্যয়। পরিবর্তনের স্বপ্ন যাদের চোখেমুখে, তারা যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে জানেন বলেই আজকের পৃথিবীতে এত প্রযুক্তি, মানুষের জীবনে এত সমৃদ্ধি। তার পরও বিশ্বাসের জায়গাটা সুদৃঢ় হয় না, অনেক জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খায় আমাদের মস্তিষ্কজুড়ে। আর ইভিএম সম্পর্কে এই জিজ্ঞাসাগুলো নিয়েই আজকের এই প্রবন্ধের অবতারণা।
ইভিএমে ভোট কারচুপি করা যায় না
প্রথমেই ধরা যাক, রহিম সাহেব ইভিএমে নিমগাছ প্রতীকে ভোট দিলেন, সেই ভোট বটগাছ প্রতীকে যাবে না কেন? প্রোগ্রাম করে তো সবকিছুই করা যায়, সুতরাং এক প্রতীকের ভোট অন্য প্রতীকে নেয়া সম্ভব হবে না কেন? চাইলেই আপনি কোনো ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করে দেখিয়েও দিতে পারেন যে এক প্রতীকে ভোট দিলেন তা অন্য প্রতীকে চলে গেল।
ভাবছেন, কী ভয়ংকর ব্যাপার! তাই না? না, মোটেই তা নয়। আপনি ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করতে পারলেও আপনার বাসার টিভির জন্য প্রোগ্রাম করতে পারবেন না। কারণ টিভির প্রোগ্রামটি টিভি তৈরির সময়ই কোম্পানির নিজস্ব কোডিংয়ের সাহায্যে তৈরি করে টিভির ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তাই এই প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সে রকম ইভিএমের প্রোগ্রামও চাইলেই আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন না।
একটি টিভি যেমন তৈরির পর চলে যায় কাস্টমারদের কাছে, তেমনি একটি ইভিএম তৈরির পর এটি উপজেলা নির্বাচন অফিসে চলে যায়। একটি ক্যাসেট প্লেয়ারের ভেতর যেমন কোনো সিনেমা থাকে না, ক্যাসেট ঢুকিয়ে তা চালাতে হয়, তেমনি একটি ইভিএম মেশিনে কোনো ডেটা থাকে না। কোন মেশিন কোন কেন্দ্রে যাবে, তাও কারও জানা থাকে না– এমনকি নির্বাচন কমিশনারও তা জানেন না।
কোনো ধরনের কাস্টমাইজেশন ছাড়াই একই মেশিনে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনা করা হয়। অন্যপক্ষে প্রত্যেক নির্বাচনের আগে ভোটারদের ডেটা, প্রার্থীদের ডেটা, প্রিসাইডিং অফিসারদের আঙুলের ছাপসহ তথ্য এবং নির্বাচন সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্য এসডি কার্ড এবং স্মার্ট কার্ডে কাস্টমাইজ করে নির্বাচন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মেশিন নির্বাচন কার্য সম্পাদন করে।
এসডি কার্ড ও স্মার্ট কার্ডে কোনো প্রোগ্রাম থাকে না। এই কার্ডগুলো কীভাবে কাস্টমাইজেশন করা হবে, প্রার্থীদের এবং প্রতীকগুলোর সিরিয়াল কী হবে, তা মেশিনের জানা থাকে না। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী এসডি কার্ড ও স্মার্ট কার্ড কাস্টমাইজেশনের সময় প্রার্থী অথবা তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকতে পারেন। ইভিএম মেশিন কেবল একটি ক্যাসেট প্লেয়ারের মতো কাজ করে বলে কার্ডগুলোয় দেয়া ডেটা যেভাবে যে সিরিয়ালে দেওয়া হবে, মেশিন ঠিক সেইভাবে একই সিরিয়ালে কাজ করবে।
যেহেতু মেশিন ও কাস্টমাইজেশন সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনের আগে প্রোগ্রাম কাস্টমাইজেশন করার কোনো সুযোগ নেই, তাই এই মেশিনে এক প্রতীকে প্রদত্ত ভোট অন্য প্রতীকে স্থানান্তর সম্ভব নয়। তার ওপর একই প্রোগ্রাম যেহেতু সব মেশিনে ব্যবহৃত হয়, তাই প্রোগ্রামে কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে তা সব মেশিনেই প্রতিফলিত হতো এবং এটি দৃষ্টির অন্তরালে রাখা সম্ভব হতো না। কিন্তু এই ধরনের কোনো সমস্যা কখনও দেখা যায়নি।
ইভিএমে হ্যাক করা যায় না
মোবাইল ফোনসহ সব স্মার্ট মেশিনে হ্যাক করা যায় এবং প্যাচ ডাউনলোড করে সফটওয়্যার আপডেট করা যায়। তাহলে ইভিএম মেশিনে কেন হ্যাক করে ফলাফল পরিবর্তন করা যাবে না অথবা নির্বাচনের আগে প্যাচের মাধ্যমে প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা যাবে না?
এখানে সবার জেনে রাখা ভালো যে ইভিএম মেশিনে কোনো ইন্টারনেট অথবা মোবাইল সংযোগ নেই। এসডি কার্ড ও স্মার্ট কার্ড ঢোকানোর পোর্ট ছাড়া অন্য কোনো পোর্ট না থাকায় মেশিনটিকে কোনোভাবেই অন্য কোনো যন্ত্রের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। মেশিনের ভেতরের প্রতিটি পোর্ট ইভিএমের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা, যাতে মেশিন খুলে এটিকে অন্য কোনো যন্ত্রের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া না যায়।
আবার এসডি কার্ড ও স্মার্ট কার্ডে যে ডেটা ঢোকানো হয় এবং নির্বাচনের সময় যে ডেটা জমা হয়, তা নিজস্ব অ্যালগরিদম এবং কোড ব্যবহার করে এনক্রিপটেড করে রাখা হয়। তাই এসব কার্ডে সংরক্ষিত ডেটা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
এসব বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে এই মেশিনকে হ্যাকিং কিংবা দূরনিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয় । ইভিএম সম্পূর্ণভাবে হ্যাকিং এবং প্যাচ থেকে মুক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি যন্ত্র, যাকে কোনোভাবেই কেউ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে না। এ কারণে ফলাফল পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।
বিশ্বের সেরা ইভিএম বাংলাদেশে
বিশ্বের প্রায় ১২০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে আনুমানিক ২৫টি দেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয়, যার বেশির ভাগে রয়েছে ইভিএম-বিতর্ক। প্রাযুক্তিক দিক থেকে উন্নত অনেক দেশও চিন্তা করছে তারা ইভিএম ব্যবহার করবে কি না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ইভিএম কতটা নির্ভরযোগ্য– এই প্রশ্ন মোটেই অবান্তর নয়।
প্রযুক্তিতে আমরা শক্তিশালী দেশ নই– এ কথা যেমন সত্য, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি আমাদের উদ্ভাবিত অনেক প্রযুক্তি মোটেই দুর্বল নয়, বরং তাদের জন্য শিক্ষণীয়। বায়োমেট্রিকসহ জাতীয় পরিচয়পত্র তথা ভোটার তালিকা প্রণয়ন, কোভিড-১৯-এর টিকা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্ভাবিত প্রযুক্তির গুণগত মান তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। দেখিয়ে দিয়েছি যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তাদের চেয়ে বেশি সফলকাম। ইভিএম মেশিনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে আমাদের ইভিএমই যে বিশ্বসেরা– এই চ্যালেঞ্জ আমরা প্রকাশ্যে ছুঁড়ে দিতেই পারি।
আমাদের ইভিএম উদ্ভাবনের পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইভিএম ভোট গণনার মেশিনে পরিণত হয়েছে– সেগুলো না পারে ভোটারদের শনাক্ত করতে, না পারে মেশিন তার নিজস্ব কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এবং না পারে ভোটের সময় নিয়ন্ত্রণ করতে।
আমাদের দেশে বর্তমানে ব্যবহৃত ইভিএম মেশিন ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব ইভিএম মেশিন প্রতিটি নির্বাচনে ব্যবহারের আগে কাস্টমাইজ করে নিতে হয়। ২০১৩ সালের আগে বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইভিএম মেশিনও প্রতিটি নির্বাচনের আগে কাস্টমাইজ করে নিতে হতো। বর্তমানে উদ্ভাবিত এবং ব্যবহৃত ইভিএম মেশিন একবার তৈরির পর আর কাস্টমাইজ করতে হয় না, ফলে এই মেশিনে কোনো প্রকার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বা ভোট কারচুপির সুযোগ নেই।
উন্নত দেশের ইভিএম মেশিনগুলোকে পরিবর্তন করে আমাদের মেশিনের সমতুল্য বা আরও উন্নত করতে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হলো তাদের দেশে বায়োমেট্রিকসহ কোনো ভোটার ডেটাবেজ না থাকা।
ভিভিপ্যাট ব্যবহার না করার কারণ
ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে উদ্ভাবিত ইভিএম মেশিনে ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল অর্থাৎ ভোটার কর্তৃক যাচাইকৃত কাগজ নিরীক্ষার পন্থা (সংক্ষেপে ভিভিপ্যাট) ব্যবহার করা হলেও আমাদের দেশে তা ব্যবহার করা হয় না কেন? এটি একটি সর্বজনীন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আগে আমাদের জানা প্রয়োজন ভিভিপ্যাট কী এবং কেন ব্যবহৃত হয়।
প্রত্যেক ভোটার ভোটদানের পর যে প্রতীকে ভোট দিল, মেশিন থেকে তা প্রিন্ট করে ব্যালট বাক্সে জমা করার পদ্ধতিকে ভিভিপ্যাট বলে। পরে মেশিন প্রদত্ত প্রতীকভিত্তিক ভোটের সংখ্যা এবং ব্যালট বাক্সে জমাকৃত প্রতীকভিত্তিক ভোটের সংখ্যা মিলিয়ে দেখা হয় মেশিন ঠিকমতো কাজ করেছে কি না।
ভারতসহ যেসব দেশ ভিভিপ্যাট ব্যবহার করেছে, তারা সবাই কমবেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ভোটদান পদ্ধতি হয়েছে বিতর্কিত। অনেক সময় ভোটগ্রহণ এবং ফলাফল বাতিল করতে হয়েছে।
ভিভিপ্যাট ব্যবহারে রয়েছে বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা, যার একটি হলো মেশিনের সঙ্গে প্রিন্টারের সংযুক্তি। প্রিন্টার যেহেতু যান্ত্রিক সঞ্চালনে কাজ করে, তাই যেকোনো সময় হতে পারে পেপার জ্যামসহ বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক ঘটনা। যেমন ধরুন আপনি ভোট দিলেন এবং মেশিনও আপনার ভোট গ্রহণ করে প্রিন্টারকে নির্দেশ দিল তা প্রিন্ট করার। কিন্তু প্রিন্টার ভোটটি প্রিন্ট করার সময় কাগজ আটকে গেল। এখন উপায়? একবার ভাবুন তো, ভোট দেওয়া হয়ে গেছে, অথচ ব্যালট প্রিন্ট হচ্ছে না কিংবা অর্ধেক প্রিন্ট হয়ে আটকে আছে। ডাকলেন একজন কারিগরি বিশেষজ্ঞকে পেপার জ্যাম ছাড়াতে। বিশেষজ্ঞ জ্যাম ছাড়াতে এসে দেখে ফেললেন ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছে। ব্যত্যয় হলো নির্বাচনি আইনের, কিন্তু শাস্তি দেবেন কাকে? অপরাধ সংঘটিত হলো, কিন্তু কাউকে অপরাধী করা যাবে না। নির্বাচনি আইন সংশোধন করতে হবে, তখন ঘটে যাবে আরেক বিপত্তি। অন্যের ভোট দেখার পথ সুগম হবে, সমাজে সৃষ্টি হবে আরেক অরাজকতা। কোনো একজন নেতাকে ভোট না দেওয়ার শাস্তি ভোগ করতে হবে গরিব নিরীহ জনগণকে।
আবার মেশিনের ফলাফলের সঙ্গে ব্যালট বাক্সে সংরক্ষিত কাগজের মাঝে দেখা দেবে অসংগতি। ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ নানাবিধ ঘটনার অবতারণা হবে ভোটদান পদ্ধতিকে বিতর্কিত করতে। যেসব দেশে প্রত্যেক ভোটের আগে মেশিনকে কাস্টমাইজ করার কারণে সন্দেহের সৃষ্টি হয়, তারাই কেবল ভিভিপ্যাট ব্যবহার করেছে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার একটি প্রয়াস হিসেবে। আমাদের দেশে ব্যবহৃত ইভিএম মেশিন যেহেতু নির্বাচনের আগে কাস্টমাইজ করা হয় না, তাই ভিভিপ্যাটের ব্যবহার নির্বাচনে শুধু প্রতিবন্ধকতাই বৃদ্ধি করবে, নতুন কিছু অর্জিত হবে না।
ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিল কিংবা ভোট ঠিকমতো হয়েছে কি না, তা আশ্বস্ত করতে আমাদের ইভিএমে সংযুক্ত করা হয়েছে একটি বৈশিষ্ট্য– ভোটদান সম্পন্ন হলে ব্যালট স্ক্রিন থেকে উধাও হয়ে যায় অন্যান্য প্রতীক, ভোটার যে প্রতীকে ভোট দিয়েছে কেবল সেই প্রতীকটি স্ক্রিনজুড়ে ভেসে ওঠে মাত্র ৪ সেকেন্ডের জন্য। স্পিকারে উচ্চারিত হবে ‘আপনার ভোট দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে।’
ভোটের আগে মেশিনকে কাস্টমাইজ করা হয় না বলে এখানে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুযোগ নেই। অন্যপক্ষে নির্বাচনি আইন অনুযায়ী ভোটের তথ্য সংরক্ষণ করতে হয় পাঁচ বছর পর্যন্ত। কোন ভোটার কখন ভোট দিলেন, কোন প্রতীকে ভোট দিলেন– এসব তথ্য বিচ্ছিন্ন ডেটাবেজে সংরক্ষিত হয় মেশিনের নিজস্ব কোডের মাধ্যমে এনক্রিপ্টেড করে। বিচ্ছিন্ন ডেটাবেজ হওয়ায় যেমন কে কাকে ভোট দিল, তা উদ্ধার করা যায় না, তেমনি নিজস্ব কোডে এনক্রিপ্টেড হওয়ায় ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভোটের এই ডেটাবেজ স্মার্ট কার্ডে সংরক্ষিত হয় বলে দীর্ঘদিন স্থায়ী থাকে এবং যেকোনো সময় কার্ডটি যেকোনো ইভিএম মেশিনে ঢুকিয়ে ফলাফল প্রিন্ট করা যায়। তাই কেবল নির্বাচনের সময় নয়, নির্বাচনের পরও ইভিএম মেশিনে ভোট জালিয়াতির কোনো সুযোগ নেই।
প্রিসাইডিং অফিসারের বিশেষ ক্ষমতা
বাংলাদেশের ইভিএমে ভোট দেয়ার জন্য আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক। এনআইডি কিংবা ভোটার সিরিয়াল নাম্বার মেশিনে প্রবেশ করালে এসডি কার্ডে সংরক্ষিত ডেটাবেজে ভোটারের যে আঙুলের ছাপ সবচেয়ে ভালোভাবে গৃহীত হয়েছে, সেই আঙুলটি স্ক্যানারে স্থাপনের জন্য মনিটরে নির্দেশনা প্রদর্শিত হয়। সঠিক আঙুলটি স্ক্যানারে স্থাপন করলে মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা পরীক্ষা করে ভোটারের ছবিসহ যাবতীয় তথ্য পোলিং এজেন্টসহ সবার জন্য মনিটরে প্রদর্শন করে এবং ইলেকট্রনিক ব্যালট ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয়।
এই পদ্ধতি তাত্ত্বিকভাবে ৯৯.৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর। কোনো কারণে কোনো ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে ওই ভোটারের আঙুলের ছাপ মেশিন কর্তৃক গৃহীত হয় এবং প্রিসাইডিং অফিসার নিজের আঙুলের ছাপ এবং পিনকোড দিয়ে ভোটারকে সত্যায়িত করেন। পরবর্তীকালে প্রিসাইডিং অফিসার কর্তৃক সত্যায়িত আঙুলের ছাপগুলো আলাদা করে পর্যবেক্ষণ, বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজ আপডেট করা সম্ভব।
উল্লেখ্য, প্রিসাইডিং অফিসার চাইলেই যে কাউকে ভোটদানের সুযোগ করে দিতে পারেন না, কেবল যাদের আঙুলের ছাপ মেলেনি, নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাদের আঙুলের ছাপ গ্রহণ করে ভোটদানের সুযোগ করে দিতে পারেন।
প্রিসাইডিং অফিসারের এই বিশেষ ক্ষমতা কেবল অনধিক ১ শতাংশ ভোটারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন ভোটারের মধ্যে একজন ভোটারকে এই বিশেষ পদ্ধতিতে ভোটদানের সুযোগ দেওয়া যায়। তাই প্রিসাইডিং অফিসারের এই বিশেষ ক্ষমতা কোনোভাবেই ভোটদানকে প্রভাবিত করতে পারে না কিংবা কোনোভাবেই ভোট কারচুপির কোনো ধরনের সুযোগ তৈরি করে না, কেবল সব নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে।
গোপন কক্ষে ভোট কারচুপির প্রতিকার
ইভিএমে একবার ভোট দিলে ওই ভোটারের পক্ষে আর কোনোভাবেই আবার ভোট দেওয়া সম্ভব হয় না। ইলেকট্রনিক ব্যালট গোপন কক্ষে স্থাপন করা হয়, যাতে নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী ভোটার কাকে ভোট দিল, তা অন্য কেউ দেখতে না পারে। কিন্তু গোপন কক্ষে যদি আগে থেকে কোনো মাস্তান অবস্থান করে এবং ইলেকট্রনিক ব্যালট উন্মুক্ত হলে ভোটার ভোট দেওয়ার আগেই ওই মাস্তান ভোট দিয়ে দেয়, তখন ইভিএম মেশিনের কিছু করার ক্ষমতা থাকে না।
এই ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব পেপার ব্যালট পদ্ধতির ভোটকেন্দ্র দখলের শামিল এবং নির্বাচন কমিশনের উচিত তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ভোট কারচুপির এই অভিনব পন্থাকে সনাতনী পেপার ব্যালট পদ্ধতির সঙ্গে তুলনা করলে ইভিএম মেশিন ব্যবহারের তিনটি যৌক্তিক সুবিধা পাওয়া যায় এবং সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেয়।
প্রথমত, ভোটদানের জন্য ভোটারকে অবশ্যই কেন্দ্রে আসতে হয়, ভোটার কেন্দ্রে না এলে ওই মাস্তান কোনোভাবে ভোট দিতে পারবে না। জনমত তৈরির মাধ্যমে জনগণ কিংবা যেকোনো প্রার্থী এই ধরনের কারচুপির পথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আগের ব্যালট পেপার পদ্ধতিতে একজন মাস্তান কেন্দ্র দখল করে একাই মাত্র কয়েক মিনিটে শত শত ব্যালট পেপারে সিল মারতে পারত। কিন্তু ইভিএমে যতজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে আসবেন এবং আঙুলের ছাপ দেবেন, তার বাইরে একটা ভোটও ওই মাস্তান দিতে পারবে না। তৃতীয়ত, পেপার ব্যালট পদ্ধতিতে কেন্দ্র দখলের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনো প্রমাণ না থাকায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত না, কিন্তু ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হলে গোপন কক্ষে ক্যামেরা স্থাপন করে নির্বাচন কমিশন পুরো নির্বাচন তদারক করতে পারে। আগে ব্যালট পদ্ধতিতে মাস্তান যেকোনো জায়গায় বসে ব্যালটে সিল মারতে পারত, এ কারণে এই ক্যামেরা পদ্ধতি কার্যকর ছিল না। এখানে উল্লেখ্য যে, ইভিএম পদ্ধতিতে উদ্ভব গোপন কক্ষের কারসাজি কেবল তখনই সম্ভব, যখন (১) নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থী জনবিচ্ছিন্ন হয়, এমনকি পোলিং এজেন্টও দিতে সমর্থ হয় না; (২) জনগণ মাস্তানকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য সবকিছু জানার পরও ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে আঙুলের ছাপ দেয় এবং একজন দেশদ্রোহী মাস্তানকে সহায়তা করতে স্বেচ্ছায় নিজেকে সমর্পণ করে; এবং (৩) নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে একজন মাস্তানকে ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে থাকার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।
যে জনগণ ক্ষমতার উৎস, সেই জনগণই যখন ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কোনো মাস্তানকে ভোটগ্রহণের সুযোগ করে দেয়, তখন ইভিএমের পক্ষে কিছু করার থাকে না। তাই জনগণ সচেতন হলে এ ধরনের গোপন কক্ষে ভোট কারচুপি দূর করা সময়ের ব্যাপার, যা আগের ব্যালট পেপার পদ্ধতিতে সম্ভব ছিল না। সুতরাং এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইভিএম পদ্ধতিতে কোনো ধরনের ভোট কারচুপি করা যায় না এবং কেন্দ্র দখল করা যায় না। এটাও কোনো দুর্বোধ্য বিষয় নয় যে, গোপন কক্ষে ভোট কারচুপির জন্য ইভিএমকে দায়ী করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
ভোটকেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন ও প্রতিকার
জনগণকে যেহেতু বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে আলাদা আলাদাভাবে ভোটকেন্দ্রে আসার সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয় না, তাই কখনও ভোটকেন্দ্রে লম্বা লাইন থাকবে, আবার কখনও ফাঁকা থাকবে- এটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা। নির্বাচন কমিশনের কাছে সবার মোবাইল নাম্বার থাকায় এই সমস্যা সমাধানকল্পে কমিশন চাইলে প্রত্যেক ভোটারকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ভোটদানের সময়ের ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারে, যা হবে একটি যুগোপযোগী এবং প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত। তবে এটাও সত্যি যে ভোটারদের আঙুলের ছাপ মিলতে অনেক সময় কয়েকবার চেষ্টা করতে হয় কিংবা অন্য কোনো অনভ্যস্ততার কারণে ভোটদানে বেশি সময় লাগে।
ইভিএম মেশিন ব্যবহার করে ভোট প্রদান পদ্ধতি, স্ক্যানারে আঙুল স্থাপনের সঠিক পদ্ধতি, আঙুলকে সহজে স্ক্যান করার সুবিধার্থে পূর্বপ্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ ও কার্যকর প্রচারণা ভোটগ্রহণের সময় কমিয়ে এনে জনগণকে স্বস্তি দিতে পারে। ইভিএমে ভোটদানের ক্ষেত্রে ভোটার তালিকায় স্বাক্ষর বা আঙুলের ছাপ গ্রহণ এবং আঙুলের ওপর অমোচনীয় কালি ব্যবহার একটা অনাবশ্যক এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়, যা বাতিল করে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা যায়। যথাযথ প্রশিক্ষণ, প্রচারণা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আগের ব্যালট পেপার পদ্ধতির চেয়েও ইভিএমে ভোটদানে অনেক কম সময় লাগবে এবং জনভোগান্তি লাঘব হবে। প্রকৃত ইচ্ছা এবং সঠিক সিদ্ধান্তই পারে একটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিতে, যা পরিপূর্ণভাবে জনভোগান্তি লাঘব করবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে যেমন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলে, অন্যদিকে তেমনি জনগণের জীবনকে আরামপ্রদ করে তোলে।
বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ইভিএম বিশ্বের যেকোনো দেশের ইভিএমের চেয়ে উৎকৃষ্ট। এই মেশিনে কোনোভাবে ভোট কারচুপি করা যায় না। ব্যবহৃত ব্যাটারি ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন পাওয়ার সাপ্লাই দিতে পারে। ভোটগ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন হয় না এবং যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই মেশিন ব্যবহার করা যায়। ভোটদান পদ্ধতি খুব সহজ– মাত্র দুটি বোতাম চাপতে হয়। আলাদা কোনো জ্ঞান বা শিক্ষার প্রয়োজন হয় না।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র ইভিএমই পারে ভোটের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে দিয়ে সুস্থ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তাই ইভিএম ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগ, বুয়েট এবং সদস্য, ইভিএম উদ্ভাবন ও কারিগরি কমিটি