অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপটা ব্যাগ থেকে বের করে মনিটরটা সোজা করে টেবিলে রাখলেন। ল্যাপটপটা নীরবে বসে থাকল টেবিলের উপর। শাটডাউন। খোলা শুধু টপ কভারটা। আপনি জামাকাপড় বদলালেন। এরপর বাথরুমে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বসলেন বিছানায়। বন্ধ ঘরে কেউ নেই। কেউ দেখছে না আপনার ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো। কিন্তু ল্যাপটপের মনিটর প্যানেলের ঠিক মাঝখানের ছোট্ট লেন্সটা? আপনি জানেন না। ওটা কাজ করে যাচ্ছে। লাগাতার। কানেকশন? দরকার নেই। লেন্সটা খোলা থাকলেই যথেষ্ট। ক্যামেরা চলছে, কেউ না কেউ ওপার থেকে দেখছে আপনার ঘর, আপনাকে, আপনার পরিবারকে।
এক পরিচিতজনের সঙ্গে আলাপ করছেন। ফ্ল্যাট কিনতে চান। তার আগে প্রয়োজনীয় কিছু আলোচনা। কোন এলাকায় কিনলে ভালো হয়, কোথায় কত দাম চলছে, লোন নিতে গেলে কী কী করতে হবে। প্রায় বিশ মিনিটের আলোচনা। মোবাইল ফোনটা পাশে রাখা। ইন্টারনেট, জিপিএস— সব বন্ধ। আলাপ-আলোচনা সেরে ফোনের নেট অন করলেন। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে জমে থাকা মেসেজ চেক করেই গেলেন ফেসবুকে। ঘাঁটতে ঘাঁটতে কয়েকটা পোস্টের পরই এল একটা বিজ্ঞাপন, ফ্ল্যাটের। খান কয়েক পোস্টের পর আবার। ফোন বন্ধ থাকলেইবা কী! মাইক্রোফোন চলছে। কেউ না কেউ শুনছে। বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে। দেখছেও, ক্যামেরা দিয়ে।
বারো বছর আগে ইউরোপে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে কথাটা বলেছিলেন ব্রুস স্নেইয়ার— আমরাই ফেসবুকের প্রোডাক্ট, পণ্য, যার সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া! সহজ-সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করলে ‘যা বিক্রি হয়’ সেটাই প্রোডাক্ট। অর্থাৎ চাল-ডাল, ফোন-বাড়ি, গাড়ি, এই সবেরই প্রোডাক্ট হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা, মানে আম জনতা কেন খামাখা প্রোডাক্ট হয়ে গেলাম? গোড়ায় যাওয়া যাক। অ্যাপ ইনস্টল করলেন। প্রথমেই অ্যাপটি কী প্রশ্ন করবে? আমি কি আপনার ফোনের ক্যামেরা, কনট্যাক্ট, মেসেজ ইত্যাদি ‘ইউজ’ করতে পারি? আপনি সম্মতি দিলে সেই অ্যাপ চালু হবে। আর সঙ্গে সঙ্গে সে ঢুকে পড়বে আপনার ব্যক্তিগত জগতে। বোঝার চেষ্টা করবে, আপনার চাহিদাটা ঠিক কী। এটাই আজকের বাজার অর্থনীতির ভিত! রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিসার্স করার প্রয়োজন এখন ফুরিয়েছে। সেই জায়গা নিয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)।
ফেসবুকে একটার পর একটা পোস্ট পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন আপনি। হঠাৎ ভালো লাগল একটি। দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখলেন সেটি। ‘লাইক’ বোতামে টিপলেন। আপনি জানতেও পারলেন না যে, সেটা ট্র্যাক হয়ে গিয়েছে। কেউ মেপে নিয়েছে, কত সময় আপনি সেই পোস্টের জন্য খরচ করেছেন। কোন ধরনের পোস্টে আপনার লাইক বেশি পড়ছে। এরপর থেকে সেই ধরনের পোস্টই কিন্তু আপনার কাছে বেশি আসবে। ধীরে ধীরে ওই ‘ভালোলাগা’য় আপনি আসক্ত হয়ে পড়বেন। ঠিক এমনটাই ‘ওরা’ চায়, যারা টাকা ছড়াচ্ছে। ইন্টারনেট-ভাষায় রেকমেন্ডেশন। নিজের অজান্তেই আপনি ঢুকে পড়বেন অদ্ভুত এক বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায়। কার নজরে আপনি? কোনো ব্যক্তি নয়। নিছক সার্ভার, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। যা ট্র্যাক করে আপনাকে। লাগাতার। আপনার কনট্যাক্ট লিস্ট, ই-মেল, ব্যাঙ্ক ডিটেইলস, ছবির গ্যালারি, মেসেজ, সব কিছু। একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বেসমেন্ট, একটি দ্বীপ, যেখানে শত শত একর এলাকায় ইনস্টল করা রয়েছে সেই সব সার্ভার। একটির সঙ্গে আর একটি যুক্ত। ইন্টার কানেকটেড। প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল।
সবটাই হচ্ছে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে। আপনার আসক্তিকে এদের ভাষায় বলা হচ্ছে এনগেজমেন্ট। সেটা বাড়লে গ্রোথ। আর সেখান থেকেই হচ্ছে উপার্জন। আপনার নয়। আপনার জানাশোনার বাইরে বহু লোকের। টাকা লুকিয়ে রয়েছে এখানেই। আপনার-আমার ডেটার মধ্যে। আপনি ভাবছেন, সবটাই তো ফ্রি। কিন্তু না। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামকে টাকা দিচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতারা। বদলে তারা কী চাইছে? নিশ্চয়তা। আপনাকে সম্মোহিত করার। সেটাও বিলক্ষণ সম্ভব। তার জন্য আপনার সব ডেটা থাকতে হবে। যা সোশ্যাল মাধ্যম, গুগল, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার, এদের সবার কাছে আছে। তথ্যই এখন উপার্জনের খনি। যার কাছে যত বেশি ডেটা, সে তত ধনী। আপনার-আমার তথ্য সে বিক্রি করবে। যার দর বেশি, তাকে।
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু শেষদিকে সমীকরণ বদলে গিয়েছিল। রিপাবলিকান ট্রাম্প স্যুইং স্টেটগুলোর উপর নির্ভর করে বাজিমাত করেছেন। সবাই অবাক হলো। ভাবল, ট্রাম্পের সেই স্লোগান ‘লেটস মেক আমেরিকা গ্রেট আগেন’ই তাহলে পাশা উল্টে দিল? বিষয়টা অতটাও সহজ না। কারণ, ধীরে ধীরে বাজারে এল একটা নাম—কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। আর ছোট্ট দুই কামরার একটি অফিস। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচার কার্যালয়। যেখান থেকে ট্রাম্পের প্রচারের জন্য দিনে ফেসবুক-বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ হতো ১০ লাখ মার্কিন ডলার। তাহলে গোটা প্রচারপর্বে কত খরচ হয়েছে? হাতের কর গুণে ঠাহর করা মুশকিল।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার হয়ে যিনি পুরো বিষয়টিকে রূপ দিয়েছিলেন, তার নাম ব্রিটনি কাইজার। ফেসবুক তাকে বা তার কোম্পানিকে দিয়েছিল ৩ কোটি মার্কিন নাগরিকের তথ্য। ইনফোগ্রুপ দিয়েছিল ৬ কোটি ই-মেল। পাশাপাশি আরও কিছু সমীক্ষা রিপোর্ট এবং ডেটাট্রাস্টের মতো সংস্থার তথ্যভাণ্ডার তো ছিলই। এই তথ্য কীভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল? প্রথম ছিল প্রোফাইল খতিয়ে দেখা। কোন ভোটারের কী দুর্বলতা। ঠিক সেই মতো মেসেজ, ভিডিও তৈরি করে পাঠিয়ে দিতে হবে তার অ্যাকাউন্টে। তিনি সেটা দেখবেন। প্রভাবিত হবেন। যার ফলটা পাওয়া যাবে ভোটের দিন। সোজা কথায় প্রোপাগান্ডা। সঠিক জায়গায় আঘাত করতে হবে। যা খুঁজে দেবে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। একই ঘটনা ঘটেছিল ব্রিটেনেও।
ব্রেক্সিট ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রচার প্রক্রিয়ার দায়িত্বে কে ছিলেন? ব্রিটনি কাইজার। ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে পালা বদলের নেপথ্য ভূমিকা কার ছিল? ব্রিটনি কাইজার। স্লোগান তুলেছিলেন ‘ডু সো’। টার্গেট ছিল নতুন ভোটার। যুব সম্প্রদায়। অ্যাফ্রো-আমেরিকান বা যে ভারতীয়রা ওই দেশে থাকেন, তাদের বুঁদ করে দিয়েছিল ‘ডু সো’ স্লোগান, মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত, একটি রাখা অপরটির উপর— ভোট দেব না। মাস্টার প্ল্যান, ওতেই কাজ হলো। একটা অংশ ভোট দিল না। আর কুর্সিও বদলে গেল।
কিন্তু পারলেন না ব্রিটনি। বেরিয়ে এলেন সব ছেড়ে। ফাঁস করে দিলেন। কাঠগড়ায় দাঁড়াল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। মার্কিন কংগ্রেসে জবাবদিহি করতে হলো মার্ক জুকারবার্গকে। ইলিনয়ের ডেমোক্র্যাট সিনেটর রিচার্ড ডাবরিন ফেসবুকের হর্তা-কর্তা-বিধাতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘রাতে আপনি কোন হোটেলে ছিলেন? আর একটা বিষয় প্লিজ একটু বলবেন... গত সপ্তাহে আপনি কাকে কাকে মেসেজ করেছেন?’
—‘না, জনসমক্ষে এসব আমি জানাতে পারব না’।
—‘এটাই মোদ্দা কথা। ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার। একদিকে দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের কথা বলছেন (কানেকটিং পিপল অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড), আর অন্যদিকে দেখুন, আধুনিক আমেরিকাকে কোন খাদে আপনি ঠেলে দিয়েছেন।’ বারবার রুমাল দিয়ে ঘাম মুছলেন জুকারবার্গ। কিন্তু বলতে পারলেন না, তথ্য আসলে ব্যক্তি-সম্পত্তি। যা অন্য কাউকে বিক্রি করার অধিকার তার নেই। থমকে গেলেন তিনি।
কিন্তু আতঙ্ক তার বহর বাড়িয়ে গেল নিঃশব্দে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেল, মাদক নিলে নাকি করোনা ভাইরাস সেরে যায়। কেউ বলল, আমরা কেউ রোগী নই, সরকার এমন কিছু একটা করছে, যা আমাদের দেখতে দিতে চায় না। খবরের থেকেও দ্রুত ছড়ায় এই ফেক নিউজ। সৌজন্যে? সোশ্যাল মিডিয়া। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলবে না কোনটা ভুয়ো খবর, আর কোনটা নয়। কোনটা প্রোপাগান্ডা, আর কোনটা সত্যি। আমরা সেটাই বিশ্বাস করব। স্রোতে ভাসব, আন্দোলন করব, আগুন লাগাব।সফোক্লিস বলেছিলেন, ‘মরণশীল জীবনে বড় কিছু এলে অভিশাপ সঙ্গে নিয়ে আসে।’ ডিজিটাল-মাধ্যম যদি ভূতের রাজার বর হয়, অভিশাপ হলো তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের উপর খোদকারি করা। এটাই মানতে পারেননি ব্রিটনি। মানতে পারেননি এডওয়ার্ড স্নোডেন। সিআইএ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির হয়ে কাজ করতেন। দেখেছিলেন, দেশের স্বার্থে যা তিনি বানাচ্ছেন, সেটা কীভাবে যেন মারণাস্ত্রে বদলে যাচ্ছে। পালিয়ে এলেন স্নোডেন। দুনিয়াকে দেখালেন, কীভাবে ‘সরকার’ প্রত্যেক নাগরিকের উপর নজরদারি চালাচ্ছে। কীভাবে ঢুকে পড়ছে অন্দরমহলে। কীভাবে সব ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি চলে যাচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে দেশদ্রোহী বলল। বারাক ওবামা বললেন, ও একটা ক্ষতিকর হ্যাকার মাত্র। সত্যিই কি তাই?
স্নোডেন না থাকলে আমরা জানতে পারতাম না নজরদারির আতঙ্ক কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। জানতাম না যে, ব্যক্তিগত জীবন বলতে আমাদের আর কিছু নেই। আর তা আজ থেকে নয়, অন্তত গত দু’দশক ধরে। ওই দেশদ্রোহী হ্যাকার শিখিয়েছেন মাইক্রোওয়েভ ওভেনের গুরুত্ব। মোবাইল ফোন তার ভিতর রেখে স্রেফ দরজাটা বন্ধ করে দিলে আর ট্র্যাক করা সম্ভব নয়। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন কিচ্ছু না। স্নোডেনই শিখিয়েছেন, মোবাইল বা ল্যাপটপের ক্যামেরাটা ঢেকে রাখতে। প্রয়োজনে খুলে নেবেন। সামান্য একটা হ্যাকার, না একজন সত্যিকারের হিরো!
আসলে আমাদের জীবনের ডিজিটালাইজেশন হয়ে গিয়েছে। এখান থেকে আমরা বের হতে পারব না। এই আসক্তি, এই অভিশাপ নিয়েই বাঁচতে হবে। আর একটা আতঙ্ক, কেউ না কেউ দেখছে। সব সময়। আজ আমরা যন্ত্র চালনা করছি। কাল যন্ত্র চালাবে আমাদের, মানব সমাজকে।
ডিজিটাল ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের হাতে আমরা অজান্তেই বন্দি হয়ে গেছি!
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রাবন্ধিক।