ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে মাঠের অভাব আর মোবাইল ফোনে বুঁদ নগর জীবন কীভাবে শিশুদের ভবিষ্যৎকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে- সেই কথা প্রকাশ করেছেন ভাষণে।
‘...প্রতিটা এলাকায় খেলার মাঠ থাকা একান্তভাবে প্রয়োজন’ একথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের শিশুরা এখন তো সব ফ্ল্যাটে বাস করে এবং ফ্ল্যাটে বাস করে সেগুলো ফার্মের মুরগির মতোই হয়ে যাচ্ছে। তবে ঢাকা শহরে খেলাধুলার জায়গা যে কম, সে কথা তুলে ধরে বিষয়টিকে ‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন সরকারপ্রধান।
বক্তব্যে আশার কথাও শুনিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে খালি জায়গা পাচ্ছি খেলার মাঠ করে দিচ্ছি। শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের প্রতি গুরুত্বারোপ করে দেশের প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠ রাখার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রাজধানীর কলাগান এলাকার তেঁতুলতলা মাঠে থানা নির্মাণের প্রতিবাদ করায় ১২ঘণ্টার বেশি সময় থানা হাজতে থাকতে হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার কিশোর ছেলেকে। এ ঘটনায় রীতিমেতো দেশজুড়ে তোলাপাড় সৃষ্টি হয়। তীব্র সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী মাঠে থানা নির্মাণ না করার ঘোষণা দেন, সেইসঙ্গে জমির মালিক পুলিশ বিভাগ হলেও জায়গাটি উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এমন একটি ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল দেশবাসী। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তখন প্রধানমন্ত্রী ভুল করেননি। সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার বাহবা কুড়িয়েছেন।
খেলার মাঠে থানা নির্মাণ না করার ঘোষণায় শুধু যে ধানমন্ডি এলাকার মানুষ খুশি হয়েছে তা নয়। গোটা দেশের মানুষ এই ভেবে খুশি হয়েছে যে- প্রধানমন্ত্রী শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত জায়গা দরকার এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুভব করেছেন।
রাষ্ট্রের একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সবার কথা ভাববেন এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে খেলার মাঠের মতো ছোট খাট বিষয় নিয়েও শেষ পর্যন্ত তাকেই ভেবেচিন্তে ঘোষণা দিতে হয়েছে বলেই, সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গায় তিনি আরও বেশি স্থান করে নিয়েছেন।
গত ১১ মে এক অনুষ্ঠানে শিশুদের নাগরিক দুঃসহ জীবনের কথা ভেবে খেলার মাঠের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যটি সারা দেশের মানুষকে আরও বেশি আশান্বিত করে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। সেইসঙ্গে তিনি যেহেতু বিষয়টি অনুভব করতে পেরেছেন, সেক্ষেত্রে আশা করা যেতে পারে এ ব্যাপারে দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাবে। আমরা নতুন খেলার মাঠ পাব। যা নতুন প্রজন্মের জন্য সুখবরই বটে!
একটি পরিকল্পিত নগরীর জন্যও তো উন্মুক্ত জায়গার দরকার হয়। বয়স্ক নাগরিকরা নানা ধরনের অসুস্থতায় ভোগেন। হাঁটাহাঁটির মাধ্য দিয়ে সুস্থতার প্রয়োজনে তাদেরও মাঠের দরকার। নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি সব মিলিয়ে নানা দিক থেকে মাঠের কোনো বিকল্প নেই।
রাজধানীতে লোকসংখ্যা বর্তমান প্রায় দুই কোটি। বিশ্বে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের অন্যতম এই মেগাসিটি। নগর পরিকল্পনাবিদরা গড়ে সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য অন্তত তিন একর আয়তনের একটি খেলার মাঠ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। সে হিসাবে রাজধানীতে প্রায় এক হাজার ৬০০টি খেলার মাঠ প্রয়োজন!
আদতে মাঠ আছে মাত্র ২৫৬টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ মাঠের আয়তনই তিন একরের কম। তবুও আছে তো?
কষ্টের বিষয় হলো দুই সিটি করপোরেশনের এমন ৪১টি ওয়ার্ড রয়েছে, যেখানে কোনো খেলার মাঠ নেই। ৩৫টি ওয়ার্ডে মাঠ কিংবা পার্কও নেই। অথচ দুই থেকে তিন দশক আগেও রাজধানীতে খেলার মাঠের জন্য এতটা হাহাকার ছিল না। কেন ঢাকায় হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ? এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সরকার ও দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কারণেই মাঠ উধাও হয়ে যাচ্ছে। মাঠ যে নাগরিক জীবনে অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো বিষয়, কেউই তা আমলে নেয়নি। হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর এখন সবাই মাঠের প্রয়োজনীয়তা টের পাচ্ছে। যদিও মাঠ নিয়ে ঢাকা শহরে কথা চলছে প্রায় দুই যুগের বেশি। কিন্তু যাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবার কথা তাদের কানে পানি গেছে অনেক পর। এটা ঠিক হয়নি। আরও আগেই এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিল সব পক্ষের।
চোখের সামনে মাঠ গেল, সবুজ ঢাকা ফাঁকা হয়ে ভরে ওঠল ভবনে, ফাঁকা সড়ক গাড়িতে ভরল, খালগুলো ভরাট হয়ে গেল, পুকুর গেল, দূষণ আর দখলে নষ্ট হলো; নদী-জল হলো বিবর্ণ, উজার হলো অন্য জলাশয়, মানুষে মানুষে সয়লাব হলো শহর অথচ সবাই মিলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালাম!
এটা উন্নত দেশে তো চিন্তাই করা যায় না। স্বাস্থ্যসম্মত নগরী গড়ে তোলা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। তাইতো কারো কোনো জবাবদিহি নেই। থাকলে, যাদের দায়িত্ব ছিল এসব বিষয় দেখভাল করার তাদের জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হতো। তাহলে এ ধরনের বিপর্যয় আসত না। ‘মাঠ চাই-মাঠ চাই’, ‘শিশুদের মুক্ত বাতাস দাও’, ‘খেলাধুলার নিশ্চয়তা দাও’ বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবার চিৎকার করতে হতো না।
বেদনাদায়ক হলো, যখন ঢাকা মহানগরীরর পত্তন শুরু হয়, তখন পাড়া-মহল্লাভিত্তিক খালি জায়গা ও খেলার মাঠ ছিল। শহর যখন বড় হতে শুরু করে, তখন মাঠের জন্য জায়গা দান কিংবা অধিগ্রহণ কোনোটাই কেউ করেনি। সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যেও কখনও খেলার মাঠ বা পার্ক ছিল না। এখন যখন বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছে তখনও আড়ালে-আবডালে খেলার মাঠের নকশায় যুক্ত হচ্ছে ভবন।
নগরবিদরা বলছেন, রাজধানীতে জনপ্রতি ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা প্রয়োজন। আছে মাত্র ৯০ শতাংশের এক শতাংশ। আর ১৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে থাকা উচিত একটি করে খেলার মাঠ। নাগরিক সুবিধা দেয়ার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে খেলার মাঠ করতে গণপূর্ত, রাজউক, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মতো সংস্থাগুলোর সহযোগিতা তারা পায় না।
সংশোধিত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের আগে রাজউকের জরিপে দেখা যায়, দুই সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডে এক হাজার ১৩৭ একর জায়গায় পার্ক থাকার কথা। সেখানে আছে মাত্র ২৭১ একরে। খেলার মাঠ থাকার কথা এক হাজার ৮৭৬ একর জায়গায়। আছে মাত্র ২৯৪ একরে।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠে মার্কেট তৈরি করে আয় বাড়ানোর জন্য ভাড়া দেয়া হচ্ছে। অনেক শিক্ষাঙ্গনে মাঠ থাকলেও ক্লাস শেষে ফটক বন্ধ করে দেয়ায় শিশু-কিশোররা বিকেলে সেখানে খেলতে পারে না।
এটা অনস্বীকার্য যে, দেশে সামাজিক অপরাধ বেড়েছে। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সমাজ। অন্যায়-অনাচার, অপরাধ দমন ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় শিশু-কিশোরদের সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খেলার মাঠের বিকল্প নেই। মাঠের মুক্ত বিনোদন না পেয়ে মোবাইল ফোন, নেশা, অপরাধ থেকে শুরু করে নানা রকম আসক্তির দিকে ঝুঁকছে শিশুরা। এতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বাড়ছে তেমনি সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার অনিশ্চয়তা বেশি।
বর্তমানে ঢাকা শহরে কতসংখ্যক শিশু ও কিশোরের বসবাস? সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ একটি এলাকায় আড়াই থেকে তিন হাজার বাসিন্দা থাকলেই একটি বড় খেলার মাঠ বা হাঁটাচলার জন্য উন্মুক্ত খোলা স্থান থাকা দরকার এলাকাবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য।
মাঠ না থাকার কারণে অনেক শিশু-কিশোর বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় এমনিতেই ভুগছে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। কিন্তু পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈষম্যের, অসমতার কারণে এবং নষ্ট রাজনীতির জন্য তারা এই স্বদেশে সুনাগরিক হয়ে বেড়ে ওঠার অধিকারবঞ্চিত নতুন প্রজন্ম।
গৃহবন্দি জীবনের কারণে অনেক শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে- এই তথ্য মনোচিকিৎসকরা প্রতিনিয়ত জানাচ্ছেন। সুস্থ শরীর সুস্থ মন গঠনে খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। সবার আগে বেদখল হয়ে যাওয়া মাঠ দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। খাস জমিতে নতুন মাঠ চাই। যেখানে শহরের পরিধি বাড়ছে সেখানে যেন পরিকল্পিতভাবে সব কিছু হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক