বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘বাজাও শঙ্খ, দাও আজান’

  • প্রণবকান্তি দেব   
  • ২৫ মে, ২০২২ ১৭:৫৮

আজ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এর মতো অসাম্প্রদায়িক বার্তাবাহী স্লোগান নিয়েও বিকৃত প্রচার। রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুদের কবি আর নজরুলকে মুসলমানের কবি বানানোর প্রতিযোগিতায় খুব সুকৌশলে নেমেছে একটি গোষ্ঠী। উল্টোদিকে, প্রগতির ঝান্ডাধারীরা ব্যস্ত নিজেদের ফায়দা হাসিলে। আজকের শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবাদের মধ্যে নজরুলের জীবনাদর্শ তুলে ধরার কোনো তাগিদ কোথাও আছে?

দিনে দিনে শুধু ‘মুসলমান’, দিনে দিনে শুধু ‘হিন্দু’ হয়ে ওঠা এই আঁধার নামা সময়ে আবার পড়ি নজরুলের সেই পঙ্‌ক্তিগুলো- “কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা/ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/এক মানবের একই রক্ত মেশা/কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।” (‘বিংশতাব্দী’/‘প্রলয়-শিখা’)। সব কালে সব ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া নজরুলের সেই ‘মানুষ’ আজ কোথায়! যেদিকে চোখ রাখি, কেবল হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান। অথচ সেই ‘মহীয়ান মানুষ’-এর দেখা নেই। কোথায় হারিয়ে গেল তার দেখা “সব দেশে-সবকালে, ঘরে ঘরে মানুষের জ্ঞাতি।”

ঊর্ধ্বাকাশে স্যাটেলাইট উড়লেও বাংলাদেশের হৃদয়ে নানাবিধ ক্ষত লেগে আছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আছে, উন্নয়নের ডামাডোল আছে। কিন্তু বাঙালির মানসজগতের বিকাশ নেই আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। চারপাশে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, এখনও বহু পথ পাড়ি দেয়া বাকি।

বিভেদের অনলে পুড়ছে আমাদের হৃদয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পে ক্রমশ পচে গলে যাচ্ছে সমাজ। একই বৃন্তে ফোটা দুটি ফুল আজ দুই দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। বিংশ থেকে একবিংশ- কতটুকু এগোলাম আমরা... আছে কারো হিম্মত, বলবেন- ‘বাজাও শঙ্খ, দাও আজান।’

আমরা পিছনে হাঁটছি কেন, কেউ কি ভাবছি এ সংকট থেকে উত্তোরণের! অক্টোপাসের মতো ঘিরে থাকা সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির মোকাবিলায় অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর তৎপরতা কী? কেবলই পদ-পদবি, গোলটেবিল, টক শো, বড় বড় কলাম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের সেমিনার! সারা দিন মাইক্রোফোনে অসাম্প্রদায়িকতার ঝড় তুলে এসে নিজের সন্তানকে বলে দেয়া ‘হিন্দু/মুসলিম বাচ্চাদের সাথে মিশো না’।

আমাদের স্কুলগুলো থেকে, আমাদের পাড়া-মহল্লা থেকে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী উধাও হলো কেন, কীভাবে ইভেন্ট, প্রজেক্ট আর শুধুই চাকরি বাঁচানোর আয়োজন হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল! করপোরেট দুনিয়া খুবলে খাছে মননচর্চার সবুজ বাগিচা আর কিছু স্বার্থান্বেষী, আত্মপ্রতারক, মুখোশধারী মানুষ। যারা নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছেন, ম্লান করে দিচ্ছেন সাহিত্য-সংস্কৃতির অমিয় আভা। বিনিময়ে আমরা এগোচ্ছি অসার, আনন্দহীন, বিষণ্ন এক ভবিষ্যতের দিকে।

নজরুল যে মূঢ়তা, যে কূপমণ্ডূকতার মুণ্ডুপাত করতে চেয়েছিলেন দীর্ঘকাল আগে, দীর্ঘকাল পরে আজ আমরা কোথায় আছি! এখনও পান থেকে চুন খসলেই ‘ধর্ম অবমাননার’ অজুহাত তুলে চলে দুর্বলের ওপর নিপীড়ন। ধর্মের নামে উগ্রতার করাল গ্রাসে বন্দি তরুণ সমাজ। ধর্মকে পুঁজি করে ফায়দা লোটার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

বাঙালির মানস সরোবরে নজরুল বপন করে দিয়েছিলেন যে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বীজ, আজ তা বৃক্ষ, ফলে-ফুলে শোভিত হওয়ার পরিবর্তে জন্ম দিয়েছে এক শুষ্ক, রুগ্‌ণ, পত্রপল্লবহীন উদ্যানে। তিনি সাম্যের গান গেয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে যে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন, এই কাতারটিই হলো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির মূল মন্ত্রই মানুষ। মানুষই সে সংস্কৃতির প্রথম ও শেষ কথা, অন্য কিছু নয়-“এক সে আকাশ মায়ের কোলে, যেন রবি-শশী দোলে/এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ীর টান।”

‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে কবি লিখেছেন- “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ- প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।”

অথচ আজ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এর মতো অসাম্প্রদায়িক বার্তাবাহী স্লোগান নিয়েও বিকৃত প্রচার। রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুদের কবি আর নজরুলকে মুসলমানের কবি বানানোর প্রতিযোগিতায় খুব সুকৌশলে নেমেছে একটি গোষ্ঠী। উল্টোদিকে, প্রগতির ঝান্ডাধারীরা ব্যস্ত নিজেদের ফায়দা হাসিলে। আজকের শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবাদের মধ্যে নজরুলের জীবনাদর্শ তুলে ধরার কোনো তাগিদ কোথাও আছে?আছে স্কুলে, বিদ্যায়তনে কোনো আয়োজন কেবল নামকাওয়াস্তে । এ প্লাস ব্যাধির এ বিরূপ সময়ে নজরুলের কবিতার মর্মার্থ শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরার জন্য কোনো শিক্ষক কি এগিয়ে আসেন ক্লাস রুমে? নজরুলের নামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিক ফটোসেশন আর বাগাড়ম্বর ছাড়া কি উপহার দেয় জন্ম, মৃত্যু দিবসে?

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী কর্মসূচি থাকে এসব দিনে? প্রশ্নগুলোর গভীরে গেলে আজকের বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র সম্পর্কে কিছুটা উত্তর মিলবে। যে জাতির জাতীয় কবি নজরুল, সে জাতি আজও কীভাবে পোশাকে ধর্ম খোঁজে, ধর্মীয় গোঁড়ামিতে মেতে ওঠে হানাহানিতে। কে বোঝাবে ওদের! কবি নিজেই বলে গেছেন- …“মূর্খরা সব শোনো,/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”…

এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, নজরুল বড় প্রাসঙ্গিক আজ। তার ভাবদর্শনচর্চা বড় প্রয়োজন এখন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে নজরুল আমাদের নিত্য অনুপ্রেরণার নাম। তাকে পঠন-পাঠন ছাড়া হৃদয়ে ধারণ সম্ভব না। তাই শুরুটা করতে হবে তাকে অধ্যয়নের মাধ্যমেই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

এ বিভাগের আরো খবর