বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মৌলিক অধিকার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে

  •    
  • ২২ মে, ২০২২ ১৪:১০

বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সমুদ্র চুরির খতিয়ান তো নানা সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। মানুষ এসব খবর পায় ও ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু এ সংবাদটি পায় না যে, এসব দুর্নীতিবাজ বিচারের আওতায় এলো কি না। বরং এ তথ্য ভেসে আসে চিহ্নিত অনেক দুর্নীতিবাজ পুরস্কৃত হয় এবং নতুনভাবে দুর্নীতি করার মওকা খুঁজে নেয়। এভাবে দুর্নীতিবাজ বড় নেতা বা আমলা ফুলে ফেঁপে বেলুন হয়ে এক সুন্দর সকালে কানাডা, সুইজারল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবে।

স্বাধীনতা-উত্তর বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন জরুরি ছিল। তাই উন্নয়নের অনেক বেশি প্রত্যাশা অনেকেই করেনি। ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে বিএনপি, আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টি দীর্ঘ সময় ধরে শাসন ক্ষমতায় ছিল। এসময়ে একটি পরিবর্তন প্রত্যাশিত ছিল। বড় বড় বিলাসি বেসরকারি হাসপাতাল আর ডায়গনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সরকারি হাসপাতালের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আর বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের সমন্বয়ের কথা কোনো সরকার পক্ষই ভাবেনি।

রাজনীতি অঞ্চলের ক্ষমতাশালী মানুষ, সরকার পরিচালক ও ধনীক শ্রেণি সামান্য অসুখেও ছুটে যান থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে। এরা নিজেরাই যেখানে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থাশীল না হয়ে দেশান্তরী হন তা হলে আসল সংকটটি অনুধাবন করবেন কেমন করে! চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নতিইবা হবে কীভাবে! হয়তো ভাবেন আমরা নিরাপদে থাকি পচনশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষ মরুক বা বাঁচুক তা দেখার দায় কি আমাদের!

গণশক্তি এবং জনমন তুষ্টি বিষয়টি আমলে না এনে রাজনৈতিক পান্ডাদের পেশি শক্তির ওপর নির্ভরতা যেদিন থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ জায়গা করে নিল সেদিন থেকে রাষ্ট্রের সব জায়গায় প্রশাসনের সকল রন্ধ্রে দুর্নীতির নিশ্চিন্ত আশ্রয় হলো।

দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক সরকারকে নিজেদের উপর নির্ভরশীল করে তোলে। ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্ষমতায় পৌঁছার সিঁড়ি হিসেবে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দেয়। তাই হাজার অন্যায় করলেও এদের সাতখুন মাফ হয়ে যায়। একারণে স্বাস্থ্য খাত থেকে শুরু করে দেশের সব খাতেই দুর্নীতিবাজরা সব অন্তঃসারশূন্য করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাবান নেতা ও সব ধরনের প্রশাসনে দুর্নীতির ভাইরাস করোনার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় করোনাকালে এসে আমাদের অত্যন্ত আতঙ্কের সঙ্গে দুর্নীতি-আক্রান্ত স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা দেখতে হয়েছে।

এখন করোনার প্রকোপ কমে গেলেও দুর্নীতির ভাইরাস আরও শক্তিমান হয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, স্বাস্থ্য খাতের নানাবিধ দুর্নীতির খবর বহুদিন ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পরও সরকারি দল ও সরকার এর তেমন কোনো প্রতিবিধানের চেষ্টা করেনি। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব জায়গায়ই দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলোর জন্য বড় বড় বাজেট বরাদ্দ হয়েছে আর এর উল্লেখযোগ্য অংশই অন্ধকার ড্রেন দিয়ে দুর্নীতিবাজদের পঙ্কে জমা হয়েছে। তাই করোনাকালের সংকটে এসে একে একে খসে পড়ছিল ঝুলির কালো বিড়ালগুলো।

একটু পেছনে ফিরে তাকাই। করোনার মতো এত ভয়াবহ মাহামারির মোকাবিলার জন্য অভিজ্ঞতা এবং প্রস্তুতি আমাদের থাকার কথা ছিল না। এই বাস্তবতা অবশ্যই বুঝতে হবে। তবে করোনা আঘাত না হানলে আমরা বুঝতে পারতাম না দুর্নীতিবাজরা কতটা ঘুণপোকার মত কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফাঁপা করে ফেলেছে। ভেন্টিলেশন থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকট যে এত প্রকট হবে কে বুঝেছিল! ইউরোপ-আমেরিকায় কভিড হানা দেয়ার পর সতর্ক হওয়ার জন্য বেশ কিছুটা সময় আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। দুর্নীতিবাজদের বিবেক কখনও কাজ করে না।

দেশপ্রেমের তো প্রশ্নই নেই। তাই হয়তো অপেক্ষা করেছে সংকট কখন আঘাত হানে। তখন তড়িঘড়ি অবস্থা সামাল দেয়ার জন্য নিজেদের দুর্নীতির হাত প্রসারিত করার মওকা পাওয়া যাবে। কার্যকারণ সূত্রে এই কল্পনা অনেকটা যেন মিলে গিয়েছিল। এদেশের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা মুখে যা-ই বলুন না কেন দেশ বা জনগণ নয় দল সুরক্ষাটাই প্রধান বিবেচনা করেন। ছোট দেশ; সবাই সবাইকে চেনে। চোখের সামনের ঘটনাগুলো আড়াল করা যায় না। দেশের মানুষের শ্রমের টাকার রাজস্ব থেকে সরকার উন্নয়নের কাজ করে। কিন্তু অসহায় মানুষ দেখে অভ্যস্ত সব সরকারের আমলেই স্থানীয়পর্যায় থেকে জাতীয়পর্যায় পর্যন্ত দলীয় পান্ডারা ঠিকাদারি থেকে শুরু করে সব ধরনের লাইসেন্স পেয়ে যায়।

তাই উপজেলা-জেলায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ যার যার সময় দলীয় অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য ঠিকাদারির ‘ঠ’ অভিজ্ঞতা যাদের নেই তারা ঠিকাদারির লাইসেন্স পেয়ে যায়। বিশেষ উপায়ে তারা টেন্ডারে জিতে কার্যাদেশও পায়। প্রায় সময় এসব কাজ বিক্রি করে দেয় সাব কন্ট্রাক্টটারদের কাছে। এভাবে কাজ শুরু হওয়ার আগে কমপক্ষে তিন জায়গায় বানরের পিঠা ভাগ হয়। ‘অফিস খরচে’ যায় একভাগ, মূল ঠিকাদার একভাগ রেখে সাব কন্ট্রাক্টকে দেয়। তিনি আবার তার ভাগ রেখে বাকি টাকায় কাজ সম্পন্ন করে।

ধরি এভাবে একটি রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু করে। সেই কাজের মান কতটা রক্ষা পায় তা সহজেই অনুমেয়। তাই রাস্তার মাথা সংস্কার করে লেজের দিকে আসতে আসতে মাথা ভেঙে যায়। অর্থাৎ জনগণের টাকা দুর্নীতিবাজদের পকেট ভরতেই শেষ হয়ে যায়। জনকল্যাণ হোক বা না হোক দলকল্যাণ তো হয়! করোনাকালেও তাই ঘটেছিল। আমরা কি ভুলে গেছি ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় মাস্ক কেনার কার্যাদেশ প্রায় প্রতিযোগিতাহীনভাবে পেয়ে যায় সরকারি দলের নেতার প্রতিষ্ঠান। আর সরবরাহ করে ফেলে নকল মাস্ক। বিপুল টাকার ভাগবাটোয়ারা কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল তা প্রমাণ করার ক্ষমতা জনগণের নেই।

তবু ভালো শেষপর্যন্ত সংকট আড়াল না করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা মোকাবিলায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রী কঠোর নজরদারি করেছেন। এতে সংকট মোকাবিলায় অনেকটা সাফল্য এসেছে।

বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সমুদ্র চুরির খতিয়ান তো নানা সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। মানুষ এসব খবর পায় ও ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু এ সংবাদটি পায় না যে, এসব দুর্নীতিবাজ বিচারের আওতায় এলো কি না। বরং এ তথ্য ভেসে আসে চিহ্নিত অনেক দুর্নীতিবাজ পুরস্কৃত হয় এবং নতুনভাবে দুর্নীতি করার মওকা খুঁজে নেয়। এভাবে দুর্নীতিবাজ বড় নেতা বা আমলা ফুলে ফেঁপে বেলুন হয়ে এক সুন্দর সকালে কানাডা, সুইজারল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবে।

সরকারের ঘরে দুর্নীতিবাজদের বসতি থাকলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সরকার দৃঢ় নয় বলে করোনা সংকটেও বেসরকারি হাসপাতালগুলাকে জনকল্যাণে এগিয়ে আসতে বাধ্য করতে পারেনি। বাধ্য করাতে হলে সততার শক্তির প্রয়োজন হয়। এর প্রমাণতো আমরা করোনাকালে বেশ কয়েকটি নামি বেসরকারি হাসপাতালের উদ্যোগের নমুনা দেখতে পেয়েছি।

নানা অপকর্ম করা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রতারক সাহেদ ধরা পড়লেও সেসময় একে আমার কাছে বড় কোনো ঘটনা মনে হয়নি। বরঞ্চ বড় ঘটনা ৬০-এর বেশি মামলা আর একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে র‌্যাবের ভাষায় ভয়ংকর এই প্রতারক ঘুরে বেড়াতে পেরেছিল কেমন করে! গোয়েন্দারা কি চোখে ঠুলি পরেছিল? রাজনৈতিক নেতা আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা বুকে বুক মেলাতে থাকল। হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলল। অথচ এমন একজন চিহ্নিত অপরাধীকে চিনতেই পারল না! তাহলে প্রশাসন আর দেশ চলছে কেমন করে! আর সরকার ও সরকারি দলের কথাই বলি। সাহেদকে আটকের জন্য যত কৃতিত্বের কথাই বলেন জনক্ষোভ তৈরির আগে সে চেষ্টা কি করেছেন? তিনি আওয়ামী লীগে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা বলে বেড়িয়েছেন তখনতো তা প্রতিবাদের বদলে উপভোগই করেছেন। ধরা পড়ার পর এই প্রতারককে না চিনতে চাইলে মানুষ কি দায়মুক্তি দেবে!

মানুষ এর একটি সরল অর্থই বুঝবে, তা হচ্ছে সবার কাছেই সম্ভবত এই প্রতারক কামধেনু ছিল। না হলে এত মামলার অভিযুক্তকে ব্যাংকগুলো কোটি কোটি টাকা ঋণ দেয় কেমন করে! একাধিক চেক জালিয়াতি করে অথচ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তার টিকিও ছোঁয় না। সহাস্যে এর সঙ্গে ছবি তোলেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা। করোনার মহাদুর্যোগে দেশে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল থাকার পরও সনদ তামাদি হয়ে যাওয়া এই প্রতারকের হাসপাতালের সঙ্গেই কোটি টাকার চুক্তি করতে হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।

বিনাপয়সায় চিকিৎসা করানোর কথা বলে একদিকে সরকারের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়েছিল আবার রোগীর স্বজনদের পকেট ফতুর করে দিচ্ছিল। অথচ এসব তথ্য জানতে বড় দেরি হয়ে যায় সরকারি কর্তৃপক্ষের। যখন পারিপার্শ্বিকতার কারণে হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে তখন মাঠে নামতে বাধ্য হন সবাই।

সাহেদ কাণ্ডের পরও কি নানা চেহারায় দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে না? আমাদের বরাবর মনে হয় রাজনৈতিক লাভালাভ আর প্রভাব থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে এবং দুদককে মুক্ত করে দিতে পারলে এসব অনাচার থেকে আমরা অনেকটা মুক্তি পাব। একই সঙ্গে করোনার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। দেশবাসী চিকিৎসা পাওয়ার মৌলিক অধিকার হারাচ্ছে। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত সামর্থ্য বিবেচনায় চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে ছোটেন। ঈশ্বর না করুন কভিডের মতো সংকটে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে এবং একই সঙ্গে সেসব দেশে মরণ ভাইরাস আঘাত হানলে চিকিৎসার জন্য তো নিজ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করতে হবে।

নাগরিকের চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর তো করোনাকালে প্রমাণ করছে তারা কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ পেতে রেখেছে। ওখানে কিছু ফেললেই নর্দমায় চলে যাবে। তাই প্রথমত এই অঞ্চল রাজনীতি প্রভাবমুক্ত করতে হবে। ঝুড়ির তলা মেরামত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের ছায়ামুক্ত করে নতুনভাবে সব সাজাতে হবে। আমি বিশ্বাস করি এদেশের চিকিৎসকগণ অকর্মণ্য, অদক্ষ আর অমেধাবী নন। মুক্ত পরিবেশে সুযোগ পেলে তাদের অনেকেই বিশ্বমানের চিকিৎসার কাঠামো গড়ে তুলতে পারবেন। সকলের চাওয়া হবে চিকিৎসার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত থাকুক মানুষের।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর