বছর ঘুরে আবারও ঈদ এসেছে। ঈদ মানে খুশি, সব মানুষের একসঙ্গে খুশি। এটি কেবল সর্বজনীন উৎসবই সম্ভব। যদিও প্রায় সব উৎসবেরই অনেকগুলো পর্ব থাকে। কোনো কোনো পর্ব একান্তই থাকে কিছু মানুষের জন্য, সবার জন্য নয়। কিন্তু বিশেষ ওই পর্বের পর উৎসবের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে। সেখানেও নানা পর্বের নানা ধরনের আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা থাকে।
ঈদের একটি পর্ব কেবল ধর্মীয় কার্য ও রীতিনীতি সম্পাদন করার। যেমন, ঈদের জামাত। তবে এই জামাতে কিশোর থেকে যেকোনো বয়সের পুরুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। নারীদের অনেকে শহরগুলোর বিশেষ আয়োজনে কেবল অংশ নিয়ে থাকেন। সেখানে নামাজ এবং কিছু ধর্মীয় সংক্ষিপ্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কয়েক বছর আগে নারীরা ঈদের ধর্মীয় পর্বে অংশ নেয়ার সুযোগ পেত না। এখনও নারীদের অংশগ্রহণ ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। অথচ এটি একটি ধর্মীয় পর্ব। এতে শিশু এবং নারীদের অংশ নেয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। ঈদ জামাতের পর ধর্মীয় পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এরপর সবাই পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে একে ওপরের বাসা বা ঘরে কুশলাদি বিনিময় করতে আসেন। এখানেই দেখা সাক্ষাৎ, গালগল্প, খাওয়া-দাওয়া চলে। এটি অবশ্য নির্ভর করে আয়োজকদের সামর্থ্য এবং আয়োজনের ওপর। যারা শহর থেকে গ্রামে ঈদ করতে যায়। তারা আপন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে খাওয়া এবং নিজেদের সম্পর্ককে নিবিড় করার চেষ্টা করে থাকে। অনেকেই পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া, ঈদের মিষ্টান্নসহ খাবারের নানা আয়োজনে অংশ নিয়ে থাকে।
বন্ধুবান্ধব অনেকেই এতে স্বাভাবিক নিয়মে অংশ নিয়ে থাকে। প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ যদি ভিন্ন সম্প্রদায়েরও হয়ে থাকে। তারাও এই দিনটিতে পরিচিতজন হিসেবে উন্মুক্তভাবে যাতায়ত করতে পারেন, ঈদের নানা খাবারদাবার তাদের জন্যও আয়োজন করা হয়ে থাকে। ঈদ উপলক্ষে অন্তত এক-দুইদিন সামাজিকভাবে একে ওপরের সঙ্গে মেলামেশা, খোঁজ-খবর নেয়া, জমিয়ে আড্ডা দেয়া ইত্যাদি চলতে দেখা যায়। অনেক এলাকায় ঈদ উপলক্ষে শহর কিংবা প্রবাস থেকে কেউ কেউ গ্রামে আসে। তাই নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গ্রামীণ সামাজিক বন্ধন নির্মাণমূলক সমাবেশ ও অনুষ্ঠানও অনেক জায়গায় হয়ে থাকে।
এসব অনুষ্ঠানে জাতি-ধর্ম, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অংশ নিয়ে থাকে। যে এলাকায় উদারভাবে ঈদ আনন্দের এই দিকগুলো পালিত হয়ে থাকে, সেখানে সামাজিক বন্ধন, মানুষে মানুষে সম্পর্কের সম্প্রসারণ, সম্প্রীতি ও মেলবন্ধন তত বেশি বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ পায়। এটি নির্ভর করে সেই এলাকার অতীত ঐতিহ্য এবং এর ধারক-বাহকদের উদ্যোগ এবং আয়োজন থেকে। অনেক এলাকায় নৌকাবাইচ বেশ জনপ্রিয় একটি খেলা। সবাই অপেক্ষায় থাকে ঈদে অনেকেই গ্রামে আসবেন। এই সময়ের জন্য সবার থাকে অধীর অপেক্ষা। সেটি ঈদের দিন বিকেল বেলা অথবা পরদিন বেশ সাড়ম্বরভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাতে একাধিক গ্রাম কিংবা অঞ্চলের মধ্যে প্রতিযোগিতার সুযোগও কোথাও কোথাও করে দেয়া হয়। এর ফলে নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, শিশু- কিশোর, বয়স্ক সবাই ভীষণভাবে উৎসবের আয়োজনকে উপভোগ করে থাকে। এ নিয়ে এলাকায় দারুণ উদ্দীপনা ও উত্তেজনাও থাকে। জয়-পরাজয় নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি হয়। হাডুডু, ফুটবল, ভলিবল আর ঐতিহ্যবাহী নানা খেলাধুলা নিয়েও কোথাও কোথাও ঈদ উপলক্ষে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
একসময় গ্রামে ঈদ উপলক্ষে নাটক-যাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বেশ প্রচলন ছিল। এতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই উৎসাহের সঙ্গে অংশ নিত। কিন্তু কেন যেন হালের দিনগুলোতে সাংস্কৃতিক এই ধারাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। বিনোদনের এই সুযোগগুলো অনেকেই এখন আর গুরত্ব দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছেন না। অনেকের আছে ব্যস্ততা আবার অনেকে বিষয়টিকে উদারভাবেও নিচ্ছেন না।
সামগ্রিকভাবে এই ঈদের উৎসব পর্বগুলো নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট এলাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশ ও নেতাকর্মীদের ওপর। যারা ঈদের এই সময়টিকে উৎসবের নানা বর্ণিল আয়োজনে উদযাপন করতে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকেন, ঐতিহ্যের ধারাকে অগ্রসর ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে থাকেন তারাই কেবল ঈদের খুশি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন। এটি একটি চমৎকার উপলক্ষও বটে। সেই উপলক্ষটি বড় ধরনের ছাপ ও প্রভাব গ্রামে রেখে যেতে পারে যদি শহর বা প্রবাস থেকে যারা ঈদ উপলক্ষে আসেন তাদের নিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন ও পালন করার ব্যবস্থা করা হয়। শহর থেকে অনেক শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী গ্রামে বেড়াতে আসেন।
তাদেরকেও যদি এসব আয়োজনে সম্পৃক্ত করা হয়, তাহলে গ্রামের পিছিয়ে পড়া অনেক শিশু-কিশোর-তরুণেরও মেলামেশা ও আয়োজনে মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ ঘটতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের গ্রামগুলোতে সে ধরনের সংগঠন ও চর্চার ধারা গড়ে ওঠেনি। তাহলে গ্রামীণ এবং শহুরে বয়স্করাই শুধু নয়, একেবারে শিশু-কিশোররাও উপকৃত ও শেখার অনেক সুযোগ পেত, ছেলেমেয়েরাও গ্রামের প্রকৃতি এবং মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্প্রীতি বৃদ্ধির সুযোগ পেত। গ্রামের শিশু-কিশোর তরুণরাও শহর থেকে আগতদের সঙ্গে মেলামেশায় অনেক কিছু শেখা এবং উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু গ্রামে এখন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হাওয়া বইছে সত্য, নগরের নানা সুযোগ-সুবিধাও বাড়ছে। কিন্তু আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার সেভাবে গ্রামে ঘটছে না। এক ধরনের নতুন চিন্তাভাবনার বিচ্ছিন্নতা গ্রামগুলোতে জেঁকে বসেছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে ঈদ উপলক্ষে অনেক জায়গাতেই শহর থেকে অনেকেরই আগমন ঘটলেও তেমন কোনো শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও সামাজিক সম্প্রীতির মিলন, বন্ধন বৃদ্ধির আয়োজন যেন অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।
এই কাজটি স্থানীয়ভাবে যেসব তরুণ এবং সচেতন মানুষ রয়েছেন তাদেরই নেয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারণে সেসব আয়োজনের কোনো সম্ভাবনা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে জনে জনে, পরিবারে পরিবারে কিংবা পাড়া-মহল্লায় নগর ও গ্রামের মধ্যে যে আধুনিক জীবনবোধের মেলবন্ধন ঘটার সুযোগের সম্ভাবনা ছিল সেটি খুব একটা সাড়া পাচ্ছে না। কিংবা অনুভূত হচ্ছে না। এখানেই আমাদের সমাজের বড় ধরনের সংস্কৃতির বন্ধন বিযুক্তির বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে যা রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা খুব একটা উপলব্ধিতে নিতে পারছে না। ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা দিন দিন দখলে চলে যাচ্ছে নানা অপশক্তির। কোথাও অর্ধশিক্ষিত, পথহারা, সমাজের বৈকল্য চিন্তার অধিকারী- তাদেরকে আমরা সহজ নামে বলি কিশোর গ্যাং, সন্ত্রাসী, মাস্তান, বখাটে।
যারা শেষবিচারে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও অপশক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়। মনে রাখতে হবে অর্থবিত্তের সঙ্গে শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিনোদন এবং চিত্তের উৎকর্ষ সাধনের আয়োজন যদি না থাকে তাহলে সমাজের অভ্যন্তরে অপশক্তি, সমাজবিরোধী শক্তি, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বেড়ে ওঠা কিশোর-তরুণদের মধ্যে সর্বগ্রাসী প্রভাব ফেলতে যে সুযোগ পেয়ে থাকে তা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয়ার শক্তির জায়গা থাকে না। আমাদের সমাজে সেই প্রবণতাই ক্রমশ বাড়ছে পাচ্ছে। এটি মোটেও আমাদের সমাজ ও মানুষকে বিকশিত হতে সাহায্য করবে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশেই অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সর্বজনীন উৎসবে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তা নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হীন স্বার্থ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রভাব এবং দেশে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্য থেকেই ঘটানো হয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে পবিত্র ধর্মের নাম। এমনকি পবিত্র ধর্মগ্রন্থকেও অপব্যবহার করে দেশে চরম সংঘাত-নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হয়েছিল। গেল বছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে বেশ কয়েক জায়গায় নিরীহ মানুষকে আক্রমণ, সম্পদ লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, উপাসনালয় ভাঙচুর, তাণ্ডব, রক্ষিত অর্থ লুটপাট ইত্যাদির সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল সামাজিক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করা, মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা হাজার বছরের ঐতিহ্য, জাতিগত বোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ইতিহাস ঐতিহ্য এবং রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বকে ভয়ানক এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়া।
এই অপকর্মটি যারা করেছে, তারা সমাজের ভেতরে বেড়ে ওঠা সেসব অপশক্তি যারা আমাদের জাতীয় জীবনের সব ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয় উৎসবের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে মোটেও দ্বিধা করে না। তাদের কাছে উৎসব মানেই হচ্ছে নিজেদের স্বার্থোদ্ধার করা, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একটি অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেয়া। যেখানে মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে নয়, বরং হিংসাত্মক ভেদবুদ্ধির রন্ধনে সমাজ যে আহার করবে তাদেরই একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। সেই সূক্ষ্ম উন্মাদনার কাজটি আমাদের পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করেও করা হচ্ছে, রাজনৈতিক মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতাও রয়েছে। কিন্তু আমরা সবসময় সেটি ভেতর থেকে দেখতে পাই না। আমাদের না দেখতে পারা ও বুঝতে না পারার সুযোগটি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বার বার বিভিন্ন উৎসব আয়োজন বা এর বাইরেও করে থাকে।
এখন সময় এসেছে সমাজের ভেতরে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটানো, জাতীয় জীবনের সব মহৎ অর্জন এবং উৎসব, পালা-পার্বণ ইত্যাদিকে সামষ্টিকভাবে পালন করার উদ্যোগ নেয়া। যে উৎসব যতবেশি আমাদের সবাইকে ধারণ করতে পারবে তার প্রভাব আমাদের সামগ্রিক জীবনেও ততবেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই বিশ্বজনীন বোধ, দীক্ষা এবং অভিজ্ঞতা আমাদের যেন পাথেয় হয়ে থাকে। তবেই আমাদের সমাজ ও মানুষের জীবন, সম্প্রীতি ও মেলবন্ধনে শক্তিশালী হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক।