বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মে দিবস দিনে দিনে

  • মামুনুর রশীদ   
  • ১ মে, ২০২২ ১৪:০৬

কৃষকদেরও উত্থান দেখেছি কিন্তু স্বাধীন দেশে কালক্রমে শ্রমিকরা দিকভ্রান্ত হয়ে গেছে, সরকার ও মালিকদের পদলগ্ন হতে ব্যস্ত। এই পরিস্থিতির কী করে উন্নতি হবে তাও আমাদের জানা নেই। কারণ বর্তমানে দুর্নীতি একটা বড় উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজে। দুর্নীতির লৌহকঠিন বেড়াজাল পেরিয়ে প্রকৃতভাবে জনকল্যাণে কাজ করা প্রায় অসম্ভব বলে বিবেচিত হচ্ছে। সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমরা সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারি, কিন্তু আন্দোলনে দিকনির্দেশনা করবেন রাজনৈতিক কর্মীরা।

একটি টেলিভিশন নাটক দেখছিলাম। নাটকটির প্রধান দুটি চরিত্র এক রিকশাওয়ালা ও তার স্ত্রী। রিকশাওয়ালার স্ত্রী এক ধনীর বাড়িতে কাজ করে, নাটকের শুরুতে স্ত্রী কাজে যোগ দিতে চাইলে দারোয়ান জানায় যে, বাড়িতে কেউ নেই। পরে আবার তাকে ডাকে সিঁড়িটা ঝাড়ু দিতে। সিঁড়ি ঝাড়ু দেবার সময়ই দারোয়ান ধর্ষকরূপে আবির্ভূত হয়। রিকশাওয়ালার স্ত্রী নিজেকে বাঁচিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ঘরে ফেরে। এদিকে রিকশাওয়ালা যাত্রীর কথামতো একটি ভুল রাস্তায় যেতে অস্বীকার করে। কিন্তু যাত্রী তাকে এমনভাবে চাপ দেয় যে, বাধ্য হয়ে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে। ট্রাফিক পুলিশ এসে তাকে মারপিট ও রিকশাটি বাজেয়াপ্ত করে। রিকশাওয়ালার মনে ভীষণ ক্ষোভ, সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

এদিকে রিকশার মালিক শুধু অশ্রাব্য গালিগালাজ নয়, রিকশাবাবদ তার কাছ থেকে জরিমানাও আদায় করে নেয়। এতসব ঘটনার পর রিকশাওয়ালা এখান থেকে মুক্তির পর রিকশাচালানো বাদ দিয়ে সে মরা মানুষের ভান করে রাস্তার পাশে চাটাইয়ে নিজেকে ঢেকে শুইয়ে পড়ে, তার স্ত্রী পাশে বসে থেকে মৃত মানুষকে দাফন করার জন্য ভিক্ষা চাইতে থাকে। বেশ কিছু টাকা ভিক্ষা জোটে কিন্তু রিকশাওয়ালার স্ত্রী এই কাজ করতে অসম্মতি জানায়, তবে রিকশাওয়ালা তা মানতে রাজি নয়। এবার স্ত্রীকে মরা মানুষ বানিয়ে স্বামী ভিক্ষা করতে থাকে। পরিণতিতে চাটাইয়ের ভেতরে মৃতদেহের অভিনয় করতে গিয়ে স্ত্রী ট্রাকচাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করে। এই নাটকটি দেখার পর ওই দিনই আমি রাস্তার পাশে এক চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। সামনে কর্মক্লান্ত রিকশাচালকদের সান্ধ্যকালীন নাশতা খাওয়ার সময় কলা-চা, রুটি-বিস্কুট এবং সবশেষে সিগারেটের সুখটান আর নিজেদের মধ্যে নানান রসিকতা করে সময় পার করে তারা। হঠাৎ শুনতে পেলাম তীব্রস্বরে এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা সিগারেটে সুখ টান দিয়ে কাউকে গালিগালাজ করছে।

আমি কান পেতে শুনতে পেলাম কোনো একটি হাসপাতালে একজন রোগীকে নিয়ে ওই বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা সেখানে গিয়েছিলেন। ওখানকার দালাল, সরকারি কর্মচারী ও চিকিৎসকদের গালাগাল করে এক নির্মম ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন তিনি। গালাগালির প্রাবল্য এত ছিল যে, অন্য রিকশাওয়ালা ঘটনা শুনে যতটা না দুঃখিত হচ্ছিল তার চেয়ে বেশি হাস্যরসের খোরাক পাচ্ছিল। নাটকে প্রতিবাদী রিকশাওয়ালা জীবিকার জন্যে মৃতদেহ নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির অভিনয় বেছে নিয়েছেন আর বয়স্ক রিকশাওয়ালা একটি মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে গালাগাল করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

একদা লেখকরা শ্রমজীবী মানুষের জীবন, তাদের সংস্কৃতি এসব বোঝার চেষ্টা করতেন এবং ম্যাক্সিম গোর্কি, আন্তন চেখভ, লুসুন এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এদের মতো অনেক লেখক তাদের জীবন, সংগ্রাম এবং সেখান থেকে একটা উত্তরণের বিষয় কিংবা বদলে যাওয়া মানুষের কাহিনি বলার চেষ্টা করতেন। গত শতাব্দীতে একদিকে যেমন শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আবার শেষের দিকে তার বিপরীতও দেখা গিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে আমাদের লেখকদের শ্রেণিচেতনার উন্মেষ ঘটেছে।

বর্তমানে যেখানে শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সবটাই বিনোদনের উপাচার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে একজন শ্রমজীবী মানুষের গালাগালিও একটা মুহূর্তের জন্য বিনোদনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয় এদেশের কোনো রাজনৈতিক দল এমনকি কমিউনিস্ট আদর্শের দল শ্রমিক শ্রেণির সচেতনতার জন্য বহুদিন ধরে কাজ করছেন না। আমরা একটি নাটকের দল হিসেবে বহু বছর ধরে শ্রেণি-সংগ্রামের পতাকাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি এবং ১৯৮১ সাল থেকে প্রতিবছর আরণ্যক নাট্যদল শহীদ মিনারে পয়লা মেতে আলোচনা, আবৃত্তি, প্রকাশনা এবং নতুন নাটকের অভিনয়ের আয়োজন করে থাকে। শহীদ মিনারের পাদদেশে সকাল দশটা থেকে এই অনুষ্ঠান শুরু হয়।

গত দশ-পনেরো বছর ধরে কমিউনিস্ট পার্টির একটি অঙ্গ সংগঠন সকাল বেলায় এখানে জমায়েত করে। ট্যানারি শ্রমিকদের একটি ছোট্ট অংশ তাতে যোগ দেয়, নেতারা দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা দিয়ে সেখান থেকে একটি মিছিল নিয়ে পল্টনের দিকে চলে যায়। এতে করে আমাদের অনুষ্ঠান বিলম্বিত হয়। যেসব দর্শক-শ্রোতারা আসেন তার বিভ্রান্ত হয়ে চলে যান। ওই শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মে দিবস সম্পর্কে তাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। লাল টি-শার্ট ও প্যান্ট পরে কিছু শ্রমিক এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হয় এবং দুপুরবেলায় আধা প্যাকেট বিরিয়ানি খেয়ে চলে যায়। এর মধ্যে ট্রাকবোঝাই সরকারি দলের শ্রমিকরা নানান গান-বাজনা সহকারে স্লোগান দিয়ে ট্রাক বোঝাই করে তারা রাস্তাজুড়ে মিছিল দিতে থাকে।

জেলা শহরগুলোতে সেদিন আধাবেলা গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে, দুপুরে খিচুড়ি-বিরিয়ানি খেয়ে তারপর তারা কাজে ফিরে যায়। এই দিনটি তাদের কাছে আনন্দের। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের কোনো নেতাই তাদের কর্মীদের মে দিবসের তাৎপর্য ব্যাখা করেননি। পৃথিবীর কোথাও এরকম আছে কি না জানি না, আমাদের দেশে পরিবহন মালিক এবং শ্রমিকে একাকার। যিনি শ্রমিক নেতা তিনিই মালিকের নেতা এবং তাদের সব উদ্যোগ যাত্রী শোষণের জন্য।

এবারে মে দিবস এবং ঈদ পাশাপাশি পড়েছে, মনে হয় না অর্ধেক বেলার কর্মবিরতিও সম্ভব হয়েছে। কিন্তু যেটা সম্ভব হবে তা হচ্ছে যাত্রীদের ওপর নিপীড়ন। ভাড়া ভাড়ানো, কোনো কোনো রুটে দ্বিগুণ করা এবং মানুষের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করা। যেমন লোকাল বাসের ভেতরে আসনের অতিরিক্ত মোড়ার ওপর বসিয়ে, দাঁড় করিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দূরের গন্তব্যের যাত্রীদের অসুস্থ করে নিয়ে যাওয়া। আবার কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বসে থাকা। কিছুক্ষণ পর গাড়ির হেলপার এবং যাত্রীদের মধ্যে চরম বাগবিতণ্ডার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে যায়। শ্রমিক নেতাদের চাঁদাবাজি এবং চাপাবাজি একই সঙ্গে চলতে থাকে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়ায়। রাস্তায় দুর্ঘটনা হবে মানুষ মারা যাবে। পরিবহন মালিকদের তাতে কোনো উৎকণ্ঠা বা উদ্বেগ দেখা যায় না। তাদের পক্ষ থেকে সরকারি প্রশাসন ক্ষতিপূরণ বা যা ব্যবস্থা করার করবে। দায়ী গাড়িচালকরাও ছাড়া পেয়ে যাবে। তবে ভাগ্য খারাপ হলে গাড়ির চালকটিও প্রাণ হারায়।

পরিবহন শ্রমিকরা তাদের বেতনের বাইরে বাড়তি অর্থ উপার্জন করে বটে কিন্তু জীবনযাপন করে মানবেতর। ঢাকা থেকে একা গাড়ি চালিয়ে দিনাজপুর অথবা তেতুঁলিয়া পর্যন্ত গিয়ে সুস্থ নিদ্রা বা গোসল, খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসা এটা তাদের জীবনে নেই। মালিকরা ট্রিপ বেঁধে দিয়েছে ড্রাইভাররা যত বেশি ট্রিপ দিতে পারবে তাদের ততই টাকা। কিন্তু এই টাকা দিয়ে কি সে তার পরিবারের সবার জন্য একটা সুস্থ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতে পারে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পারে না। আরেক ধরনের পরিবহন শ্রমিক আছে যারা ট্রাক চালায়। ফেরি পারাপারের জন্য কখনও দুই-তিন দিনও অপেক্ষা করতে হয় তাদের। এই সময়ে তাদের আহার-নিদ্রা সব কিছুই অস্বাভাবিক। মালিক বা সরকার কেউই এসব মানুষ নামের প্রাণীদের কথা ভাবে না।

বড় জুটমিলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কোনোটি চিরতরে আবার কোনো মিল ব্যাক্তিমালিকানায় চলে গেছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম জুটমিল আদমজি যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন পত্রিকায় আদমজি স্কুলে পড়ুয়া বাচ্চাদের একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। সেই ছবিতে দেখেছিলাম রোদন ভরা তাদের হাহাকার। সেই শিশুরা এখন কোথায় আছে? তার খবরও সরকার বা শ্রমিকনেতারা জানার এতটুকু প্রয়োজন বোধ করে না।

উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানে টঙ্গী, তেজগাঁওয়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম আমরা দেখেছি। কৃষকদেরও উত্থান দেখেছি কিন্তু স্বাধীন দেশে কালক্রমে শ্রমিকরা দিকভ্রান্ত হয়ে গেছে, সরকার ও মালিকদের পদলগ্ন হতে ব্যস্ত। এই পরিস্থিতির কী করে উন্নতি হবে তাও আমাদের জানা নেই। কারণ বর্তমানে দুর্নীতি একটা বড় উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজে। দুর্নীতির লৌহকঠিন বেড়াজাল পেরিয়ে প্রকৃতভাবে জনকল্যাণে কাজ করা প্রায় অসম্ভব বলে বিবেচিত হচ্ছে। সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমরা সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারি, কিন্তু আন্দোলনে দিকনির্দেশনা করবেন রাজনৈতিক কর্মীরা। কিন্তু সংস্কৃতি কর্মীরাও এক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবে রাত্রি যত অন্ধকার হোক না কেন দিনের আলোতো আসবেই। সেই প্রত্যাশায় থাকলাম।

লেখক: নাট্যকার-অভিনেতা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

এ বিভাগের আরো খবর