ঈদের বাজার জমে উঠেছে আর বেদনা জমাট বেঁধে আছে কিছু পরিবারে। তুচ্ছ ঘটনা আর বিরাট সংঘর্ষে হারিয়ে গেলেন নাহিদ আর মোরসালিন। সংঘর্ষে আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছেন অনেকেই।সংঘর্ষ যাদের মধ্যে সেই ঢাকা কলেজ যেমন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নিউ মার্কেট তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক এলাকা। আর নাহিদ একজন ডেলিভারিবয়, মোরসালিন একজন দোকান কর্মচারী। অল্প আয়ের কর্মচারী তাই এরা দুজনই আর্থিক বিচারে গুরুত্বহীন। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামে সংঘর্ষে প্রাণ দিলেন যে এই দুজন তারা জানতেন না কী তাদের অপরাধ। তবে একটা বিষয় বুঝতেন যে, এখানে যেই বিজয়ী হোক না কেন তাদের কোনো লাভ নেই কিন্তু তাদেরকে হারিয়ে তাদের পরিবারকি অসহায় হয়ে পড়েছে প্রচার মাধ্যমের কারণে সবাই সেটা জেনেছেন।
সবাই দেখলেন, ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ, নিহত দুজন, আহত শতাধিক। সংঘর্ষ চলেছে রাতভর পরবর্তী দিনেও দফায় দফায় হয়েছে সংঘর্ষ। পুলিশ কতখানি দায়িত্ব পালন করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে, নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী নেতারা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখেন, ঢাকা কলেজের ছাত্ররা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত, প্রতিটি ছাত্রাবাসে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য, তাদের নেতারা কেন সংঘর্ষ থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখলেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে একজন বললেন, ঠিক এই কারণেই সংঘর্ষ থামাতে এত দেরি হলো এবং সম্ভবত এ কারণেই পুলিশ ভুমিকা পালন করতে দ্বিধা বা দেরি করেছে।
টিভির খবরে দেখা গেছে, ছাত্রদের দিকে তেড়ে আসছে মার্কেটের কর্মচারীরা আর গুলি করছে, টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে, লাঠিপেটা করছে পুলিশ। ছাত্ররা যেন সবার প্রতিপক্ষ । সবার এত রাগ, ঘৃণা ছাত্রদের প্রতি তৈরি হয়ে হলো কীভাবে? মানুষের ভরসা ও ভবিষ্যৎ যে ছাত্ররা, সেটা পরিবার বা সমাজে সবখানেই তারা কেন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবী ছাত্ররা পড়াশুনা করতে এসে কেন এই অপবাদের বোঝা কাঁধে নিল? বার বার এই ধরনের সংঘর্ষ কেন ঘটছে আর সমাধানইবা কী?
পত্রিকায় এসেছে দুজন কর্মচারী নিজেদের মধ্যে দোকান বসানো, দোকান সাজানো নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল। তাদের একজন আর একজনকে দেখে নেবে বলে কলেজের ছাত্রদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে এসেছিল। যাদেরকে ডেকে এনেছিল তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা। কোন স্তরের নেতা তা স্পষ্ট না হলেও ক্ষমতাসীন দলের সিল থাকলে সবার ক্ষমতার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল তো শুধু ছাত্রদের মধ্যে নয়, ব্যবসায়ীদের মধ্যেও তো আছে। তারাওবা ক্ষমতা দেখাবেন না কেন? ক্ষমতা দেখানোর এই প্রতিযোগিতায় বলি হলো সাধারণ পথচারী আর ধুলিস্যাৎ হলো সাধারণ ছাত্রদের ভাবমূর্তি।
ঢাকা কলেজের ছাত্রদের এত ঐতিহ্য, এত সুনাম ছাপিয়ে কিছুদিন পর পর মার্কেটে চাঁদাবাজির ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাদের নাম। কিন্তু কেন এমন হলো, কেন এমন হচ্ছে? ক্ষমতার স্বাদ পেলে কেন ছাত্রদের মধ্যে চাঁদাবাজি নামক এই দুরারোগ্য ব্যাধির সংক্রমণ হয়? ঈদের আগে প্রায় প্রতিবার কোনো না কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে গাউছিয়া, চন্দ্রিমা, নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর কারণ প্রায় সবাই জানলেও দূর করার উদ্যোগ তো দেখা যায় না।
নিউ মার্কেট অঞ্চলে ছোট বড় মিলিয়ে ২৯টি মার্কেট। নিউ মার্কেটের ভিতরে দোকান আছে প্রায় ৫০০টি। বাইরে ফুটপাত ঘিরে ছোট দোকান যেগুলোর আইনগত বৈধতা নেই কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন এমন দোকানের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। আর পুরো এলাকা ঘিরে হকার আছে প্রায় ৫ হাজার। এদেরকে ব্যবসা করার জন্য এককালীন এবং প্রতিদিন টাকা দিতে হয়। টাকা কারা তোলে, এই টাকা কীভাবে ভাগাভাগি হয় তা নিয়ে প্রকাশ্য এবং গোপন অনেক কথা আছে। ব্যবসার জন্য বসার অনুমতি পেতে জায়গাভেদে ১ লাখ থেকে ২ লাখ টাকা এবং দৈনিক ৬শ থেকে ৮শ টাকা যে দিতে হয় তা এই অঞ্চলের সবাই জানে। মাসে ১০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা দিয়ে থাকে এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ক্ষমতার সঙ্গে এই টাকার সম্পর্ক খুব নিবিড়। তাই ক্ষমতা তা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং পুলিশি ক্ষমতা খুবই প্রয়োজন এই আর্থিক লেনদেনের জন্য।
সংঘর্ষের এলাকায় যে সংসদ সদস্য, মেয়র, কাউন্সিলর ছিলেন তারা তো নিজেদেরকে জনপ্রতিনিধি বলেন। ধানমণ্ডি এলাকাতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রায় ৩০ জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতা বসবাস করেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনেকের স্ত্রী এই কলেজের শিক্ষক। কিন্তু তাদের কী ভূমিকা ছিল এই সংঘর্ষ থামাতে কিংবা কী ভাবনা বা পদক্ষেপ আছে ভবিষ্যতে যেন এমন ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে ব্যাপারে? এলাকার কর্তৃত্ব আর আর্থিক-সুবিধার বাইরে কি কোনো ভাবনা আছে? ঢাকা কলেজ কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ব্যবসায়ীদের উপর কার প্রভাব থাকবে, হকারদের চাঁদা কত উঠবে আর কীভাবে ভাগ হবে এসব বিষয় নিয়েই তো সংঘাত হচ্ছে বার বার। গত কয়েক বছরে ছোট বড় ১০টির বেশি সংঘাত হয়েছে এই অঞ্চলে। তার পরও সমস্যার গোড়ায় হাত পড়ছে না কেন?
নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চন্দ্রিমা, চাঁদনী চক, নুরজাহানসহ এই এলাকার মার্কেটের ক্রেতা কারা? মধ্যবিত্তের নিচের অংশ যারা দরদাম করে জিনিস কেনে, ছাত্রছাত্রীদের বিরাট অংশ যারা একটু কম দামে জিনিস পাওয়ার জন্য দোকানে দোকানে জিনিস যাচাই করে, দাম নিয়ে দরকষাকষি করে। সেখানে বিক্রেতাদের আচরণ এবং ব্যবহার যে কতটা অপমানজনক ও তাচ্ছিল্যের সে কথাও উল্লেখ করেন অনেক ভুক্তভোগী। এসব মার্কেটের ব্যবসায়ীরাও কি এর দায় নেবে না? একজন নারী ক্রেতা লিখেছেন, তিনি প্যান্ট কেনার জন দরদাম করছিলেন, তাঁকে এক পর্যায়ে বলা হলো এই দামে প্যান্ট পাবেন না, প্যান্টি কিনে নিয়ে যান। তার লজ্জার সঙ্গে অপমান যুক্ত হলো যখন তিনি দেখলেন পাশের দোকানের বিক্রেতারাও দাঁত বের করে হাসছে। এদের আচরণ এবং কথাবার্তা শুনে যে কেউ বলবে যে এসব বিক্রেতারা বেয়াদব!
ছাত্রদের ‘চাঁদাবাজ’ আর বিক্রেতাকে ‘বেয়াদব’ বলার আগে কি ভাববেন কেন এবং কারা এসবের সঙ্গে যুক্ত? গড়ে সবাইকে দায়ী করে সমস্যার সমাধান মিলবে না বরং শত্রুতা স্থায়ী হবে। সমাজে গণতন্ত্র না থাকলে, জবাবদিহি না থাকলে, অপরাধ করেও ক্ষমতার সঙ্গে থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না এই মনোভাব থাকলে শুধু ভোটের অধিকার নয় সব ক্ষেত্রেই যে ধস নামে তা উপলব্ধি করার সময় কি এখনও আসেনি?
ঈদবাজার সরগরম হয়ে উঠছে। সারা দেশে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার রমজান ও ঈদবাণিজ্য হবে। ক্রেতারা ভাবছেন কী কিনবেন, কত দামে কিনবেন, ব্যবসায়ীরা ভাবছেন তাদের বিক্রি এবং লাভ নিয়ে, ক্ষমতার আশেপাশে যারা, তারা হিসাব করবে তাদের বখরার পরিমাণ, নতুন পোশাক এবং নগদ টাকা দেবেন বড় ভাইয়েরা আর তাদের পেছনে থাকবে একদল ছাত্র কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল সময়, তারা হারালো সম্মান ও মর্যাদা। আর দোকান কর্মচারীরা? তারা দিনরাত বিক্রি করেও যে আয় করবেন তাতে কি পারবেন ঈদের খরচ তুলতে? সাধারণ ছাত্র আর সাধারণ কর্মচারী- পরস্পর মুখোমুখি হয়, মারামারি করে, মরে, আহত হয় কিন্তু দেখে না পিছনে কলকাঠি নাড়ে যারা তাদের লোভাতুর মুখ।
ঈদ আসবে না নাহিদ, মোরসালিনের ঘরে। তাদের বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তানদের দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে যাবে উৎসবের উচ্চশব্দে। দেড় হাজারের মতো অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে মামলা, ফলে গ্রেপ্তার আতংকে থাকবে অনেকেই। দখলের রাজনীতি আর মুনাফার লালসার কাছে স্বজন হারানোর কান্না কিংবা বেদনা বিরক্তিকর। ইতোমধ্যেই সন্তানহারা মা বলেছেন তিনি বিচার চান না। কার কাছে চাইবেন? নিম্ন আদালতে ভরসা নেই আর উচ্চ আদালতে যাওয়ার সামর্থ্য নেই।
সবাই দেখছেন সংঘর্ষ এবং লাশ, কিন্তু এর পেছনে যে লুটপাট আর ক্ষমতার সংঘাত তা কি দেখা যায়? সংঘাতের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ, লুটপাটের শিকার হবে সাধারণ মানুষ, চাঁদাবাজির নামে যে কলঙ্ক তাও বহন করছে সাধারণ ছাত্ররা। মার্কেটের ব্যবসায়ী নেতা, কলেজের ছাত্রনেতা, আর শিক্ষক হিসেবে যারা আছেন তারা সবাই তো ক্ষমতার বলয়ের মানুষ। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রাণহারানো মানুষেরা শুধু কি সংখ্যা হয়েই থাকবে?
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।