মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয়চন্দ্র মণ্ডলকে নিয়ে মাসাধিক সময় ধরে যা কিছু ঘটেছে, তেমন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, কোনো বিজ্ঞানশিক্ষক বা যেকোনো উদার মনের মানুষকে আর ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে নাজেহাল হতে হবে না- তেমন নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? আমার মনে হয়, তেমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন না। কারণ গত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখে আসছি, আমাদের দেশে একই ধরনের ঘটনা প্রায় নিয়মিতভাবেই একের পর এক ঘটেই চলেছে। একই ঘটনা একাধিকবার ঘটলে তাকে আর ‘বিচ্ছিন্ন’ বা পরিকল্পনাহীন বলা যায় না।
একই চিত্রনাট্য, নির্দিষ্টসংখ্যক চরিত্র, অভিন্ন দৃশ্যপট বা মঞ্চসজ্জায় সাজানো অভিনয় বার বার দেখতে বিরক্ত লাগে। অভিযোগ ওঠানো হয় ধর্ম অবমাননার। তারপর সেটা নিয়ে শুরু হয় ধুমধাড়াক্কা কাণ্ড। মানুষের জীবন ও সম্পদ বিনাশ হয়। কয়েকদিন এসব নিয়ে কেউ কেউ সরব থাকেন। তারপর আবার অপেক্ষা নতুন কোনো অঘটনের। প্রথমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সংখ্যাগুরুর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়েছেন বলে গুজব ছড়ানো হবে, সেই গুজবের সত্যমিথ্যা যাচাই না করে একদল হৃদয়বান ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ধর্মরক্ষার মহান ব্রত নিয়ে মার মার কাট কাট করে মাঠে নামবেন, একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠিয়ে অনেকের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ে হামলা করা হবে।
যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে গ্রেপ্তার করা হবে নিরাপত্তা বা উত্তেজনা প্রশমনের অজুহাতে। কিন্তু যারা সত্যি সত্যি মিথ্যা বলে উত্তেজনা ছড়িয়ে মারমুখী আচরণের মাধ্যমে অনিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করে তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয় না। ফলে আক্রান্তদের মধ্যে অসহায় বোধ তীব্র হয়ে ওঠে। প্রতিকার না পেয়ে হতাশা থেকে একসময় দেশ থেকে পালিয়ে স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করে। দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা আরও কমতে থাকে।
শ্রেণিকক্ষে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হৃদয়চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে গত ২২ মার্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ বাদী হয়ে মামলা করেন। ওই দিনই হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ ও ২৮ মার্চ আদালতে তার জামিন চাওয়া হয়েছিল। সে সময় আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছিলেন। এ নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর ১৯ দিন পর ১০ এপ্রিল জামিন মঞ্জুর হওয়ায় কারামুক্ত হন হৃদয়চন্দ্র মণ্ডল। আর ২৯ দিন পর ১৯ এপ্রিল তিনি শ্রেণিকক্ষেও ফিরেছেন।
নিজ বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতি সমাবেশ শেষে তিনি দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান করেন। তিনি আবার শিক্ষার্থীদের মনে তার মতো করে আলো ছড়ানোর চেষ্টা করবেন কিন্তু তার জীবনে যে অন্ধকার একটি অধ্যায় যুক্ত হলো, তার স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যের যে আতঙ্কিত সময় কাটাতে হলো, তার কি কোনো প্রতিকার হলো বা হবে?
হৃদয়চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার যে অভিযোগ ওঠানো হয়, তা প্রমাণ হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, হৃদয়চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তদন্ত কমিটির প্রধান গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ছাত্ররা গোপনে ক্লাসে মুঠোফোন নিয়ে হৃদয় মণ্ডলের বক্তব্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে রেকর্ড করেছিল। এগুলো যে পরিকল্পিত ছিল ছাত্ররা তা স্বীকার করেছে। ছাত্ররা তাদের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছে। হৃদয় মণ্ডল নিজে ছাত্রদের ক্ষমা করার কথা জেল থেকে জামিনে বেরিয়েই বলেছিলেন।
ক্ষমা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ গুণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ছাত্ররা কি নিজের বুদ্ধিতে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে ফাঁসিয়েছিল, নাকি নেপথ্যে থেকে আর কেউ তাদের প্ররোচিত করেছে, নাচিয়েছে? এই বিষয়গুলো অনুসন্ধান করা জরুরি। এটা না করা হলে হৃদয় মণ্ডলের যারা ক্ষতি চেয়েছে, তারা আবারও একই পথে হেঁটে তাকে হেনস্তা করতে চাইবে। তার জীবনে ‘ভয়’ একটি স্থায়ী উপাদান হয়ে থাকবে। ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধের জন্যই প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত করে তার বা তাদের মুখোশ খুলে দেয়া দরকার।
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল স্কুলে ফেরায় শিক্ষার্থীরা খুশি বলে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে। আকাশ নামের দশম শ্রেণির একজন ছাত্র বলেছে, হৃদয় মণ্ডল খুব ভালো একজন শিক্ষক। তার পাঠদান অন্য সবার চেয়ে আলাদা। ভুল–বোঝাবুঝির কারণে মাঝখানে কিছু খারাপ সময় পার হয়েছে। স্যার আবার ক্লাসে ফিরে আসায় তারা খুব খুশি।
হৃদয় মণ্ডলের একজন সহকর্মী, একই বিদ্যালয়ের শিক্ষকও বলেছেন, হৃদয় স্যারের পাঠদান চমৎকার। তিনি বিজ্ঞান ও গণিত বিষয় খুব ভালো বোঝান। তিনি কয়েকদিন না থাকায় বিদ্যালয়ে একটা শূন্যতা ছিল। পুনরায় যোগ দেয়ার পর আবার সবকিছু পূর্ণ হলো।
১৯ এপ্রিল সকালে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির আয়োজনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে হৃদয়চন্দ্র মণ্ডলকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। পরে আলোচনা সভা হয়। এ সব কিছুই অবশ্যই ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়। শিক্ষক হৃদয়চন্দ্র মণ্ডল নিজেও বলেছেন, তার ক্লাসে ফেরা নিয়ে শঙ্কা ছিল। সব শঙ্কা কেটে গেছে। অনেক দিন পর নিজের শ্রেণিকক্ষে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে আছে। শিক্ষার্থীরাও তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তিনি আশা করছেন, আর কোনো সমস্যা হবে না। আগের মতোই নিজের পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবেন।
তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিষয়ে বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দীন জানিয়েছেন, বিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করা হবে। এর মধ্যে যে কদিন হৃদয় মণ্ডলকে আদালতে হাজিরা দিতে হবে, সে কদিন বিদ্যালয় থেকে তার ছুটির ব্যবস্থা করা হবে। হৃদয় মণ্ডলের জীবনে যে ঝড় বয়ে গেছে তা কাম্য ছিল না। তাকে যে গ্লানির মুখে পড়তে হয়েছে, সেটাও তার প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু এখন আমরা চাইব, এ ধরনের ঘটনা যেন দেশের আর কোথাও না ঘটে।
প্রসঙ্গত, মনে পড়ছে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা। আইনস্টাইন বলেছেন, তিনটি কারণে মানুষের মনে ধর্মবোধ জাগে। কারণ তিনটি হলো:
১. ভয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-ব্যাধি, পশুদের আক্রমণ, যুদ্ধ, জীবন-জীবিকার মধ্যে যে অনিশ্চয়তা দেখা যায়- এসব ইত্যাদি বিপত্তির কারণে মানুষ অসহায় বোধ করে, ভয় পায়। এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মানুষ মনে করে এসব নিয়ন্ত্রণ করছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি। তাকে খুশি করতে পারলে বিপত্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। সেই অদৃশ্য শক্তির নাম ঈশ্বর, গড বা আল্লাহ বা জিহোভা। তাকে স্তুতির জন্যি তৈরি হয় ধর্ম।
২. সমাজে ন্যায়নীতির একটা মানদণ্ড তৈরি করার জন্য মানুষের মধ্যে ধর্মবোধ তৈরি হয়। যেমন সদা সত্য কথা বলবে। মিথ্যে বললে নরকে যাবে। কাউকে ঘৃণা করবে না। ঈশ্বর ঘৃণাকারীকে পছন্দ করেন না ইত্যাদি। তিনি ঘৃণাকারীকে পাপ দেবেন।
৩. যে বিষয় সম্পর্কে এখনও যুক্তি তৈরি করা যায়নি সেগুলোকে ঈশ্বরের অলৌকিকত্ব হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। ফলে এই অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস না করে উপায় নেই- এই ভাবনা থেকেও মানুষের মনে ধর্মবোধ জাগে।
আইনস্টাইনের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার মতো মানুষের অভাব হবে না।
বিজ্ঞান ভয়ের কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে পারছে- আবিষ্কার করছে তার নিদান। যেমন রোগাক্রান্ত হলে মানুষ যতটা না ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে তার চেয়ে বেশি ছোটে ডাক্তারের কাছে। রাষ্ট্র সব মানুষের জীবন-জীবিকার দায়িত্ব নিলে হয়তো মানুষ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে অসহায় বোধ করবে না।
রাষ্ট্র যদি নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইনের-শাসন কায়েম করে তবে সমাজে ন্যায়নীতির মানদণ্ড তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ধর্মের ওপর পুরোটা নির্ভরশীল না হলেও চলে। কিন্তু তেমন রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান কবে নিশ্চিত হবে আর কবে মানুষের জীবন হবে ধর্মীয় কুসংস্কার মুক্ত?
বিজ্ঞান দিন দিন এই জগতের নানা বিস্ময়ের ব্যাখ্যা আবিষ্কার করতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড় না করিয়ে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও বিজ্ঞানকে নিয়মিত চর্চার বিষয়ে পরিণত করতে পারলে এ নিয়ে বিরোধ এড়ানো সম্ভব।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।