বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কান নিয়েছে চিলে!

  •    
  • ২০ এপ্রিল, ২০২২ ১৬:৩৯

সোমবার রাতের ঘটনার জের যে মঙ্গলবার সকালেও গড়াবে সেটা তো পুলিশের বোঝার কথা। কিন্তু অন্তত তিন ঘণ্টা তারা কেন ঘটনাস্থলেই এলো না, এই রহস্য তদন্তযোগ্য। কেউ কি চেয়েছে, ঘটনাটি চলুক, আরও বড় হোক। তারচেয়ে বড় রহস্য হলো, তিনঘণ্টা পর পুলিশ এসেও তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। কারা তাহলে ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে তুলতে চেয়েছে? বিচার হবে না জানি, তবে সরকারের স্বার্থেই এই প্রশ্নগুলোর জবাব জানা জরুরি।

আমাদের ছেলে প্রসূন আমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সে কলাবাগান এলাকার একটি কোচিং সেন্টারে যায়। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস- শুক্র, শনি ও মঙ্গলবার। প্রথম দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি, আর মঙ্গলবার ওই এলাকার ছুটি। তাই মোটামুটি সহনীয় জ্যামে সে বাসায় ফিরতে পারে। আসাদ গেট থেকে কলাবাগান যেতে ১০/১৫ মিনিট লাগে। কিন্তু এই মঙ্গলবার সব হিসাব উলটে গেল। প্রসূন যথারীতি আগের হিসাবে সাড়ে ১০টায় বাসা থেকে বের হলো। এদিকে আমি তৈরি হয়ে বসে আছি। গাড়ি ফিরলে অফিসে যাব। সাড়ে ১১টার দিকে ফোন করে জানলাম, তারা তখনও সোবহানবাগ।

মঙ্গলবার দিনের অধিকাংশ সময় আমার আর প্রসূনের কাটল রাস্তায়। শুধু আমরা নই, ঢাকার লাখো মানুষ মঙ্গলবার দিনভর অকারণে অসহনীয় পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। যানজটে বসে থাকতে অসহ্য হয়ে প্রসূন আমার কাছে জানতে চাইল, ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে কী নিয়ে ব্যবসায়ীদের ঝামেলা হয়েছে। আমি আমতা আমতা করলাম। তখনও আসল কারণটা জানি না, নিউমার্কেটে খেতে গিয়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা মারধরের শিকার হয়েছে বা ‘চাঁদা চাইতে গিয়ে’ মার খেয়েছে; এমন কথাই শুনছিলাম। পরে শুনলাম ঘটনা তার চেয়েও সামান্য। তিল থেকে তালের প্রকৃত উদাহরণ হতে পারে এই ঘটনাটি। নিউমার্কেটের পাশাপাশি দুটি ফাস্টফুডের দোকানের দুই কর্মচারীর মধ্যে ইফতারের সময় হাঁটার রাস্তায় টেবিল বসানো নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। দুই কর্মচারীর একজন রাতেই প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে ঢাকা কলেজ থেকে তার পরিচিত কয়েকজনকে ডেকে আনে। শায়েস্তা করতে এসে উলটো ধাওয়া খায় তারা, মারও খায়। ঢাকা কলেজে খবর যায়, নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা কলেজের শিক্ষার্থীদের মেরেছে, এমনকি ছুরিকাঘাত করেছে। তাতে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা নিউমার্কেটে হামলা চালায়। ব্যবসায়ীরাও পাল্টা হামলা চালায়।

সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। ঘটনাটি সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে ব্যবসায়ীদের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করলে ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে হামলা চালায়। তারপর বেধে যায় সংঘর্ষ। সেই সংঘর্ষ চলে বিকাল পর্যন্ত। ইফতারের পর আবার সংঘর্ষ বাধে। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। বুধবার এই লেখা পর্যন্ত নিউমার্কেট-ঢাকা কলেজ এলাকা শান্ত, তবে থমথমে। তবে দোকানপাট খোলেনি। দুদিনের এই অচলাবস্থায় কার লাভ হয়েছে, কার ক্ষতি হয়েছে; তা নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা হবে। তবে আমি নিশ্চিতভাবেই লাভের ঘরে শূন্য বসিয়ে হিসাবটা শুরু করতে চাই। কারোই লাভ হয়নি। নিউমার্কেট এবং সংলগ্ন এলাকায় অনেকগুলো মার্কেট। ব্যসায়ীদের হিসাবে ঈদের মৌসুমে এই এলাকা একদিন বন্ধ থাকলে এক হাজার কোটি টাকা বেচাকেনা কম হয়। সে হিসাবে মঙ্গলবার আর বুধবার দুদিনে দুই হাজার কোটি টাকা বেচাকেনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দিনভর ঢাকার যানজটে কত মানুষের কত কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে, তার হিসাব কে করবে? পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্তত ১২ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন।

ঢাকা কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, একজনের অবস্থা গুরুতর। তবে একজনের ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। তার নাম ডালিয়া। আপনারা কেউ তাকে চিনবেন না। এই সংঘর্ষে তার কোনো ভূমিকা নেই। মাত্র সাত মাস আগে বিয়ে হয় ডালিয়ার। তার স্বামী নাহিদ এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যান। মঙ্গলবার সকালেও তিনি কাজের জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। দুই পক্ষের সংঘর্ষে মাথায় আঘাত পেয়ে রাস্তায় পড়েছিলেন নাহিদ। রাতে মারা যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। নাহিদ ঢাকা কলেজের ছাত্র নন, নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী নন। একজন সাধারণ পথচারীমাত্র। তার দায়িত্ব কেউ নেবে না। কেউ ডালিয়ার পাশে দাঁড়াবে না। একটি অর্থহীন সংঘাতে ডালিয়ার সাত মাসের সংসার ও স্বপ্ন তছনছ হয়ে গেল। মেহেদির রং মুছতে না মুছতেই বিধবা হয়ে গেল মেয়েটি। ফোটার আগেই ঝরে গেল ডালিয়ার স্বপ্নফুল। ডালিয়ার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তারপরও দাবি করছি, নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে যেন ডালিয়ার পাশে দাঁড়ানো হয়।

মঙ্গলবার রাতে খাবার টেবিলে প্রসূন জানতে চাইল, এখন তো পুলিশ চাইলে সব ঘটনার দায়ীদের বের করে ফেলতে পারে। ঢাকা কলেজ-নিউমার্কেট এলাকাতে নিশ্চয়ই সিসিটিভি আছে। পুলিশ চাইলে নিশ্চয়ই দায়ীদের খুঁজে বের করতে পারবে। তাদের কি বিচার হবে? প্রসূনের প্রশ্নটি খুবই যৌক্তিক। হাজার কোটি টাকার ক্ষতি, লাখো মানুষের ভোগান্তি, সম্পদহানি, সবচেয়ে বড় কথা হলো একজন নিরীহ মানুষের প্রাণহানী। দায়ীদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমি তাকে বলেছি, এই ঘটনার কোনো বিচার হবে না।

এটা ঠিক, এবারের সংঘর্ষের শুরুর জন্য ঢাকা কলেজের ছাত্রদের কিছুটা দায় দেয়া যায়। তারা ঠিকমতো খবর না জেনে ‘চিলে কান নিয়েছে’ শুনেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু দুদিনের ঘটনায় নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা বরাবরই আক্রমণাত্মক ছিল। তারা ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে তো সংঘর্ষে জড়িয়েছেই, সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে, এমনকি তাদের হামলা থেকে অ্যাম্বুলেন্সও রেহাই পায়নি। সংঘর্ষ প্রলম্বিত করতে একটি মহল ছাত্রদের উস্কানি দিয়েছে। আগুন লাগলে তাতে আলু পুড়ে খাওয়ার লোকের অভাব নেই দেশে। তবে ব্যবসায়ীরা এই ঈদের মৌসুমে কেন এভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারল, কেন তারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ মনে করল, কেন অ্যাম্বুলেন্সও তাদের হামলার মুখে পড়ল; এই প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব নেই আমার কাছে। তবে তারচেয়েও রহস্যজনক পুলিশের ভূমিকা। ঘটনা যত সামান্য, পুলিশ চাইলে ব্যবসায়ী এবং ছাত্রদের নিয়ে বসে সোমবার রাতেই বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে পারত।

তারচেয়ে বড় কথা হলো, মেটানো না হলে, সোমবার রাতের ঘটনার জের যে মঙ্গলবার সকালেও গড়াবে সেটা তো পুলিশের বোঝার কথা। কিন্তু অন্তত তিন ঘণ্টা তারা কেন ঘটনাস্থলেই এলো না, এই রহস্য তদন্তযোগ্য। কেউ কি চেয়েছে, ঘটনাটি চলুক, আরও বড় হোক। তারচেয়ে বড় রহস্য হলো, তিনঘণ্টা পর পুলিশ এসেও তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। কারা তাহলে ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে তুলতে চেয়েছে? বিচার হবে না জানি, তবে সরকারের স্বার্থেই এই প্রশ্নগুলোর জবাব জানা জরুরি।

দুদিনের এই সংঘর্ষের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। সোমবার আর মঙ্গলবারের ঘটনায় ব্যবসায়ীরা মাস্তানের মতো আচরণ করেছে। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই এলাকার ব্যবসায়ীরা বরাবরই মাস্তানের মতো আচরণ করে। ক্রেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, জিনিস কিনতে বাধ্য করা, নারীদের হেনস্থা করা, লোক ঠকানো- তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা অনেক লম্বা। ব্যক্তিগতভাবে কেনাকাটা করতে গিয়ে অনেককেই ব্যবসায়ীদের মাস্তানি মুখ বুজে সয়ে আসতে হয়।

প্রতিবাদ করার সাহস বা সুযোগ থাকে না। কিন্তু ঢাকা কলেজের ছাত্ররা তো আর আমাদের মতো ভীরু আমজনতা নয়। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। তাই বিভিন্ন সময়ে এই এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের লেগে যায়। আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গেলে ছাত্ররা সবসময়ই সাধারণ মানুষের নৈতিক সমর্থন পান। কারণ সাধারণ মানুষ তার অবদমিত ক্ষোভের প্রকাশ দেখতে পায় ছাত্রদের প্রতিবাদে।

আগেই বলেছি, ব্যবসায়ীরা এবার শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ছিল। তাদের ক্ষমতার উৎসটা জানি না। হতে পারে, এখন রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বেশি। তাই ব্যবসায়ীরা নিজেদের ক্ষমতাশালী মনে করেন। পুলিশও ব্যবসায়ীদের পক্ষে ছিল, কারণ পুলিশ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পায়, ছাত্রদের কাছ থেকে পায় না। তবে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ দাবি করেছে, এই এলাকা থেকে ঢাকা কলেজ সরিয়ে নিতে। তাদের এই ঔদ্ধত্য আমাকে বিস্মিত করেছে। তারা বোধহয় ‘ঢাকা কলেজ’ বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি।

ঢাকা কলেজ ঢাকার ঐতিহ্য, বাংলাদেশের গর্ব। দেশের সেরা মনীষীরা এখানে পড়াতেন, পড়ান। দেশের সেরা মেধাবীরা ঢাকা কলেজে পড়েন। ঢাকা কলেজের পাশে তারা ব্যবসা করছেন, এটা নিয়ে ব্যবসায়ীদের গর্ব করা উচিত। এটা ঠিক, ঢাকা কলেজের অল্পকিছু ছাত্রের বিরুদ্ধে এই এলাকায় চাঁদাবাজি, পণ্য কিনে টাকা না দেয়া বা কম দেয়া, বলাকায় বিনা টিকেটে সিনেমা দেখার অভিযোগও আছে। কিন্তু এটা নিতান্তই অল্পকিছু মাস্তানের। সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসবে জড়িত নয়। তবে অন্যায় হলে, আক্রান্ত হলে তারা কখনও পিছপা হয় না। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামেও ঢাকা কলেজ সবসময় সামনের কাতারেই ছিল। তাই ঢাকা কলেজকে প্রতিপক্ষ বা প্রতিবন্ধকতা ভাবলে ব্যবসা করা যাবে না।

তবে এই ঘটনায় আমাকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছে, আমাদের অসহিষ্ণুতা। এখন রমজান মাস চলছে। সংঘর্ষে যারা জড়িত ছিলেন, তারা বেশিরভাগই মুসলমান, অনেকে নিশ্চয়ই রোজাও রেখেছিলেন। রমজান আমাদের সংযম শেখায়। কিন্তু রোজাদারদের কাছ থেকে এতটা অসহিষ্ণুতা অপ্রত্যাশিত। ধর্মটা ঠিকমতো মানলেও রমজানে এত ছোট ঘটনায় এত বড় সংঘর্ষ হওয়ার কথা নয়। ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা নিজেদের মাস্তান ভাববেন না, শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ ভাববেন না, যৌক্তিক আচরণ করে ব্যবসায়িক পরিবেশ বজায় রাখুন। ছাত্রদের প্রতিও অনুরোধ, অন্যায় হলে অবশ্যই প্রতিবাদ করবেন। তবে তার আগে জেনে নিন, প্রকৃত ঘটনা। চিলে কান নিয়েছে শুনেই দৌড়ে যাবেন না। অল্প কিছু মাস্তান বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছাত্ররা যেন আপনাদের মতো মেধাবী ছাত্রদের লাঠিয়াল বানিয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে না পারে।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর