বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‘নব আনন্দে জাগো’

  • লাভা মাহমুদা   
  • ১৪ এপ্রিল, ২০২২ ১৬:১৪

এ দেশ ধর্মের ভিত্তিতে নয়, গড়ে উঠেছে সংস্কৃতির ভিত্তিতে। যার প্রথম সোপান ভাষা আন্দোলন। প্রথমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভাষার ওপর আঘাত করল। তারপর আঘাত করল মর্যাদা, অর্থনীতি এবং স্বাধিকারের ওপর। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলে আজও সেই পাকিস্তানেই থাকতাম। আমরা যে স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্ববোধ করি, তার ভিত্তিমূল আমাদের সংস্কৃতি।

বাঙালির প্রাণে অনুরণন জাগিয়ে আবার এসেছে উচ্ছ্বাসের বৈশাখ। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এ অঞ্চলে বৈশাখ আসে ঠিক মোহনীয় আমেজে নয়, অনেকটা রুক্ষ উত্তাপে। মাঝে মধ্যে ঝড়বৃষ্টি হয়, কখনও কালবোশেখির প্রলয় নৃত্যে মানুষকে জানান দেয় তার আগমনী বার্তা। ফুল-ফলের ঘ্রাণে ভরে ওঠে বাতাস। জীর্ণ পাতা ঝরে জায়গা করে নেয় নতুনেরা। এই বৈশাখের প্রথম দিনটিই ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন, নববর্ষ। যা শুধু বাঙালিই নয়, এই অঞ্চলে জন্ম নেয়া সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের প্রতিটি মানুষকে একসূত্রে যুক্ত করতে সর্বজনীন আবেগের ঝরনাধারায় উৎসারিত একমাত্র চিরায়ত লোকজ উৎসব।এই অঞ্চলে নববর্ষ একেক জায়গায় একেক নামে পরিচিত। আদিবাসী জনগোষ্ঠী ‘বৈসাবি’ নামে নববর্ষ উদ্‌যাপন করে। ত্রিপুরারা বৈসুব বা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা বিজু নামে যে উৎসব উদ্‌যাপন করে তারই প্রথম তিন অক্ষর মিলে ‘বৈসাবি’ যা পাহাড়ে তুমুল জনপ্রিয়। আবার উত্তর ও মধ্য ভারতে বৈশাখী, আসামে রঙ্গালি বিহু, তামিলনাড়ুতে তামিল পুঠান্ডু, কেরালায় বিশু, ওড়িশায় বিশুব-সংক্রান্তি এবং পশ্চিমবাংলায় পরিচিত নববর্ষ নামে।ষোলো শতকের মাঝামাঝি মোঘল সম্রাট আকবর অনেকটা দায়ে পড়ে বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন করেন। সে সময় হিজরি ক্যালেন্ডার ধরে রাজকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। সৌরবর্ষের তুলনায় ১০/১১ দিন কম থাকায় চন্দ্রবর্ষ কখনই পরের বছর একই দিনে আসে না। আবার দৈবদুর্বিপাকে ফসলহানি ঘটলে দিল্লি পর্যন্ত খাজনা পৌঁছত না। তাই সম্রাট আকবর ‘ফসলি সন’ তৈরির দিকে নজর দেন।

এর প্রেক্ষিতে নতুন ফসল উঠলে প্রজাদের কাছ থেকে জমিদারদের খাজনা আদায়ের জন্য বৈশাখের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ ঘোষণা দেয়া হয়। ফসলের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দ ব্যবহারের আগে বাংলা সনকে ‘ফসলি সন’ বলা হতো। মোঘলেরা দায়ে পড়ে নববর্ষের প্রচলন করলেও সময়ের বাঁক পেরিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনটিই আমাদের সর্বজনীন বৈষম্যহীন আনন্দ আয়োজনের সবচেয়ে বর্ণিল সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।বাঙালি জাতির জন্যও এ এক আত্মিক বন্ধনের উৎসব। আত্মপরিচয়ের খোঁজে বাঙালি যে শেকড়ের সন্ধান করে, বৈশাখ সে পথই দেখায়। বাঙালির সাংস্কৃতিক পথপরিক্রমায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিনি সুতোর মালা গেঁথে যোগসূত্র স্থাপন করে, সেতো বৈশাখই। সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে ঐতিহ্যের কথা বৈশাখ বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়।

বর্তমান সময়টা এখন আর সম্প্রীতির নেই। চিরায়ত এই লোকজ উৎসবকে সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে ঢেকে দেয়া হয়েছে। যে বৈশাখের আবাহনে, নববর্ষের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল জাতি, তা আজ স্তিমিত হতে চলেছে।

একদিকে পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে কর্পোরেট ফ্যাশন হাউসগুলো থেকে শুরু করে ফুটপাত পর্যন্ত রমরমা ব্যবসা, নানান পণ্যে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। শ্রেণি-পেশা-বয়সভেদে সবাই সেই কেনাকাটায় শামিল।

অপরদিকে নববর্ষ পালন নিয়ে আছে বিস্তর নেতিবাচক প্রচারণা। বাঙালির এই দ্বিচারিতা বেশ আগেই শুরু হলেও বর্তমানে তা মাত্রা ছাড়িয়েছে।এ দেশ ধর্মের ভিত্তিতে নয়, গড়ে উঠেছে সংস্কৃতির ভিত্তিতে। যার প্রথম সোপান ভাষা আন্দোলন। প্রথমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভাষার ওপর আঘাত করল। তারপর আঘাত করল মর্যাদা, অর্থনীতি এবং স্বাধিকারের ওপর। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলে আজও সেই পাকিস্তানেই থাকতাম। আমরা যে স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্ববোধ করি, তার ভিত্তিমূল আমাদের সংস্কৃতি।ধর্ম ব্যবসায়ীরা অহেতুক বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে ধর্মকে। কৌশলে-অপকৌশলে বিজ্ঞান-রাজনীতি, অর্থনীতি-সংস্কৃতি সবক্ষেত্রেই ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে। অথচ ধর্ম প্রতিটি মানুষের অন্তরের সাধনার পবিত্র বিষয়।১৯৭২-এ এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-

“আমার বাংলাদেশে, আমার মানুষরা তার তার ধর্ম নিঃশঙ্কচিত্তে, নির্বিঘ্নে, আনন্দের সাথে পালন করবে। আমি ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার’ একটি চারা বাংলাদেশে রোপণ করেছি। এই চারা যদি কেউ ছিঁড়ে ফেলতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায়; বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।”আজ বঙ্গবন্ধু নেই, তার স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ সংকটে। নিজেদের কৃষ্টিকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের ভূত ঘাড়ে চেপে বসেছে প্রবলভাবে। যে সংস্কৃতি আমাদের নয় বলে পরিত্যাগ করেছি বহু আগে, সেটাই আবার দৈত্য হয়ে ফিরে আসছে।বর্ষবরণ আমার কাছে যত না উদ্‌যাপনের, তার চেয়েও বেশি উপলব্ধির; হৃদয় মন ও মননে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া অসাম্প্রদায়িক চেতনার আরেক নাম নববর্ষ। রঙিন শাড়ি, রেশমি চুড়ি পরে রমনার বটমূলে বা মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাওয়াই নয়, আমার নাভিমূলে টান দিয়ে যাওয়া অনুভূতিরও অধিক এই বৈশাখ, এই নববর্ষ।“হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ॥উজ্জ্বল হোক জ্ঞানসূর্য-উদয়সমারোহ-প্রাণ লভুক সকল ভুবন, নয়ন লভুক অন্ধ।শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,করুণাঘন, ধরণীতল কর কলঙ্কশূন্য।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

অন্ধকার ভেদ করে আলো আসবেই। অনেক প্রাণের বিনিময়ে যেমন দেশ স্বাধীন হয়েছে, অনেক প্রাণের বিনিময়ে যেমন করোনা বধ হয়েছে, তেমনি সাম্প্রদায়িকতারও বিনাশ হবেই। বাঙালি সংস্কৃতির অন্তর্গত দর্শনচর্চাই হতে পারে বিনাশের হাতিয়ার। এ হাতিয়ার আজ ছড়িয়ে পড়ুক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি বাঙালির মনন ও হাতে। শুভ হোক নতুন বছর; বয়ে আনুক শান্তি-সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য-সমৃদ্ধি। মায়া ছড়িয়ে পড়ুক মানুষ থেকে মানুষে। সবার মঙ্গল হোক। শুভ নববর্ষ ১৪২৯!

লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

এ বিভাগের আরো খবর