করোনা যখন দোর্দণ্ড প্রতাপে, বাংলাদেশে তখন সব কিছু খোলা থাকলেও বন্ধ ছিল স্কুল। আবার এখন, এই প্রচণ্ড গরমে, রমজানের আবহে অন্য সব সেক্টরে যখন ঢিলে-ঢালা ভাব, তখন কেবল স্কুলের ব্যাপারে আমরা খুব কঠিন-কঠোর, ছুটি দেয়া যাবে না সহসাই। মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তবু একটু শিথিল, কিন্তু প্রাথমিকে আমরা আরও কড়া। এক দেশের এই দুই নীতি, স্কুল শিক্ষা নিয়ে তো এখন আলোচনা হওয়ারই কথা।
হচ্ছেও। কিন্তু সেটা হচ্ছে সম্পুর্ণ ভিন্ন কারণে! হঠাৎ করেই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছেন দেশের দুই অঞ্চলের দুজন স্কুল-শিক্ষক। ঘটনাচক্রে দুজনই সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মাবলম্বী, আর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীরটাকে শানানো হয়েছে সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় অনুভূতির পাথরে ঘষে। মুন্সিগঞ্জের হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিজ্ঞান ক্লাসে তিনি ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করেছেন, তাতে এমনই আঘাত পেয়েছে সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় অনুভূতি যে তাকে জেলখানাতেই পুরতে হয়েছে! আর নওগাঁর আমোদিনি পালের বিরুদ্ধে গুজব: ‘হিজাব পরার কারণে’ তিনি পিটিয়েছেন স্কুলের মেয়ে শিক্ষার্থীদের। কপাল ভালো, তাকে এখনও কারাদর্শন করতে হয়নি, তবে কারণ দর্শানোর একখানা নোটিশ পেয়েছেন তিনি।
এ নিয়ে ব্যাপক সরগরম গণমাধ্যম। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কাঁটা-ছেঁড়া চলছে, তারা আসলেই এমন কিছু করেছেন কি না তা নিয়ে। বিশেষ করে হৃদয় মণ্ডল কারো হৃদয়ে সত্যিই আঘাত করেছেন কি না সেটা নিয়ে।
অন্তর্জালের জগতে উড়ে বেড়ানো দশম শ্রেণির ক্লাসে তার সঙ্গে জনৈক ছাত্রের কথোপকথন শুনে আমি তো রীতিমতো বিস্মিত! দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী যে ভাষায় তার শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলছেন, সেটা বিস্ময়কর বটে। আমিও ছাত্র পড়াই এবং পড়ানোর সময় আমি আমার ছাত্রদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করি, কারণ আমি মনে করি প্রশ্ন করতে না পারলে ঠিক ঠিক শেখাটা হয়ে ওঠে না। সে হিসেবে ওই ছাত্রের প্রশ্ন করার ধরনটাকে আমার ভালো লাগারই কথা। কিন্তু না, কোনোভাবেই সেটা ভালো লাগাতে পারছি না। বরং হৃদয় স্যার যেমন ধৈর্যের সঙ্গে এই সব অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, সেটাই আমাকে মুগ্ধ করছে; আমার মনে হচ্ছে, এমন শিক্ষক প্রত্যেকটা স্কুলে থাকা দরকার!
এই ভাবনা আরও অনেকেরই মনে জাগছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ভিন্নমতটাও যে শুনতে পাচ্ছি! আমার কর্মস্থল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির একজন নেতার বক্তব্য শুনলাম, তিনি বলছেন, নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে ক্লাসে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা নাকি ঠিক হয়নি হৃদয় মণ্ডলের। হ্যাঁ, এটি তার ব্যক্তিগত মত; কেননা পরে সমিতির পক্ষ থেকে দেয়া আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ভিন্ন কথাই বলেছেন তিনি। কিন্তু তার ওই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটি উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
তার বক্তব্যে উদ্ধৃত ওই নব্বই শতাংশের পাটিগণিতটাই আসলে সব সর্বনাশের মূল। নইলে একেবারে সাদাচোখে দেখলেই এই মামলা টেকে না! মামলাটি করা হয়েছে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারায়। মনে রাখা দরকার, ব্লাসফেমি বিষয়ে এই আইনের মূলধারা, অর্থাৎ ২৯৫ নম্বর ধারায় মামলা যে কেউ করতে পারে না; তবে ২৯৫ (ক) ধারায় পারা যায়। কিন্তু সেই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিকদের কোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাকৃতভাবে ও বিদ্বেষাত্মক কথিত বা লিখিত শব্দাবলীর সাহায্যে বা দৃশ্যমান কল্পমূর্তির সাহায্যে উক্ত শ্রেণির ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমান করে বা করার উদ্যোগ করে, তবে উক্ত ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে (যাহার মেয়াদ দুই বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে) বা অথর্দণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’
এই ধারা অনুসারে ‘স্বেচ্ছাকৃতভাবে’ ধর্ম অবমাননা অপরাধ, কিন্তু যে তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে এই মামলাটি দাঁড়িয়ে, সেই কথোপকথন শুনলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে হৃদয় স্যার তার ক্লাসে বিজ্ঞান নিয়েই কথা বলছিলেন, ধর্ম নিয়ে কোনো কথা তিনি স্বেচ্ছায় বলেননি। বরং অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে ছাত্রটি বার বার সেই প্রসঙ্গ তোলায় বাধ্য হয়ে তিনি কিছু জবাব দিয়েছেন মাত্র। জবাবে ধর্ম সম্পর্কে তিনি অবমাননাকর কিছু বলেছেন কি না, এই প্রসঙ্গটিই তাই এখানে অবান্তর।
আমার চিন্তার বিষয় তাই হৃদয় স্যার ধর্ম অবমাননা করেছেন কি না বা তিনি বিজ্ঞানের পক্ষে যৌক্তিক অথবা অবান্তর কথা বলেছেন কি না, সেটা নিয়ে নয়। আমাকে ভাবাচ্ছে এই প্রক্রিয়াটি, যেখানে দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী, যে কি না বাণিজ্য শাখায় অধ্যয়নরত, সে তার বিজ্ঞান শিক্ষককে বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছে। কোন কোন বই পড়তে হবে সেটাও বলে দিচ্ছে। ক্লাস চলাকালে তার হাতে আছে ডিজিটাল ডিভাইস, যা দিয়ে শিক্ষকের অজান্তে তার কথাবার্তা রেকর্ড করছে, করে সেটির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে অভিযোগ করছে। প্রতিষ্ঠান প্রধান সেটা আমলে নিয়ে শিক্ষককেই কারণ দর্শানোর নোটিশ দিচ্ছেন; অভিভাবকসহ স্থানীয় লোকজন স্কুল ঘেরাও করে এমন পরিস্থিতি তৈরি করছেন যে শিক্ষককে কারাগারে নিতে হচ্ছে!
কথোপকথনটি শুনছি, আর মনে মনে কল্পনা করছি, আমার ছেলেবেলার স্কুলে এ রকম কিছু ঘটলে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারতো! প্রথম প্রতিক্রিয়া- আমাদের বিজ্ঞানশিক্ষক, প্রবল ধর্মানুরাগী মোজাম্মেল স্যার নিশ্চিত কানের নিচে এমন একটা চটকানা দিতেন যে পরের প্রশ্ন করার শখই উবে যেত। তর্কের খাতিরে ধরা যাক সেটা না ঘটে পরের ধাপটা পর্যন্ত গেলাম। হেড স্যার, যিনি এমন ধর্মানুরাগী ছিলেন যে টিফিন পিরিয়ডে মসজিদে যাওয়ার বাধ্যতামূলক আদেশ জারি করেছিলেন, তার কাছে যদি এমন একটা দরখাস্ত নিয়ে যেতাম, তিনি দরখাস্ত পড়ার ধার না ধেরে অভিযোগটা মুখে শোনামাত্র কাঁচা বেত দিয়ে পেটানো শুরু করতেন। আর কোনো কারণে যদি এই অভিযোগের কথা বাড়িতে তুলতাম, তাহলেও একই প্রতিক্রিয়া হতো, পিতার হাতেও খেতে হতো বেত্রাঘাত। তখনকার শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কটাই ছিল এমন, শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আর ছাত্রের ভালো-মন্দের দায়িত্ব নেয়া ছিল যে সম্পর্কের ভিত্তি।
এখন তো আর বিষয়টা সে রকম নেই। এখন ছাত্র পেটালে সেটা অন্যায়, আমোদিনি পাল যে অন্যায়ের কারণে অপরাধী। কিন্তু সেই অপরাধ ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে তার ধর্মীয় পরিচয়, ফেসবুকে মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে তারই ছাত্রীরা স্কুল ইউনিফর্ম না পরার বিষয়টিকে আড়াল করে নিয়ে আসছে হিজাব পরার প্রসঙ্গ, আর মুহূর্তেই সেটা ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে; স্কুলের বাইরে থেকে উত্তেজিত জনতা এসে হামলা করছে স্কুলে।
হৃদয় মণ্ডলের ক্ষেত্রেও ঘটনা একই, ধর্মের প্রসঙ্গটি যেন স্ফুলিঙ্গের মতো আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, আর সে আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে দাউ দাউ করে। এই প্যাটার্নটাই সবচেয়ে বেশি ভাবনার কারণ। কেন ধর্ম নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলেই উত্তেজিত হয়ে উঠছে এত মানুষ? কেন মসজিদের মাইকে একটা ঘোষণা শুনে হিন্দু পাড়ায় আগুন লাগাতে ছুটে যাচ্ছে মানুষ, বৌদ্ধ মন্দিরে ভাঙচুর করছে, এমনকি স্কুল পর্যন্ত ঘেরাও করছে? একটা ভালো কাজে ডাক দিলে তো এভাবে এগিয়ে আসে না কেউ!
গণমানসের এই পরিবর্তনটা দিন দিন এমনই জোরালো হয়ে উঠছে বলেই স্কুলের ছাত্রকে দিয়ে শিক্ষকের কথোপকথন রেকর্ড করার দুর্বুদ্ধিটা মাথায় আসছে কারো; অ্যাসেম্বলিতে স্কুল-পোশাক না পরার কারণে মার খেয়ে তাতে হিজাবের গল্প যোগ করে ফেসবুকে পোস্ট করছে শিক্ষার্থী। ওই নব্বই শতাংশের পাটিগণিত এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তার সামনে তুচ্ছ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, শিক্ষকের মর্যাদা, এমনকি নিরাপদ দূরত্বে বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতাদেরও বুক কাঁপে তার বিরুদ্ধে যেতে।
এই পাটিগণিতটাই বদলাতে হবে সবার আগে! কেন এমন পরিবর্তন হচ্ছে, কীভাবে সেটা ঠেকানো যায়, সেটা নিয়ে সত্যিকারের গবেষণা হওয়া দরকার; সেই গবেষণার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। না হলে এক হৃদয় মণ্ডল-আমোদিনি পালদের মতো আরো অনেকেই বলির পাঁঠা হবেন, নিশ্চিত।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়