বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল ও কিছু ধর্মান্ধ সংকীর্ণ হৃদয়  

  •    
  • ৯ এপ্রিল, ২০২২ ১৭:৫৫

মুন্সিগঞ্জের হৃদয় মণ্ডল, নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তি, নাসির নগরের রসরাজ, সুনামগঞ্জের ঝুমন দাস, ভোলার বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য, রংপুরের টিটু রায় এমন যত ঘটনা এবং যত নাম তার কি কোনো যোগসূত্র নেই? আপাত সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে স্বার্থ-সুবিধা ও সম্পত্তি এই তিন ‘স’ কি যুক্ত নেই? প্রতিটি ক্ষেত্রেই উত্তর হচ্ছে, আছে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? তথ্য এবং জ্ঞানের পার্থক্য কী? যা যাচাই করা যাবে না তা নিয়ে তর্ক করা কি যাবে? দীর্ঘদিন ধরে যা জেনে এসেছি তার সঙ্গে নতুন জ্ঞানের বিরোধ হলে করণীয় কি? নতুন কিছু হলেই কি তা গ্রহণ করতে হবে নাকি পরীক্ষায় প্রমাণিত হলে গ্রহণ করা যাবে? পরিবর্তনশীল প্রকৃতিজগৎকে জানার উপায় কি বিজ্ঞান না অতীত থেকে পাওয়া বিশ্বাস? এমনি অনেক প্রশ্নের উত্তর মানুষ পাবে কীভাবে এবং কোথা থেকে?

অতীতের ইতিহাস বলে প্রশ্ন করা কঠিন এবং তার চেয়েও কঠিন উত্তর খোঁজার কাজ। মিথ্যা কথা বলার দায়ে কাউকে খুব বেশি শাস্তি পেতে হয়েছে কি না তা আমাদের জানা নেই। যদি মিথ্যা বলার শাস্তি থাকত তাহলে কি মানুষ এত নির্বিবাদে এবং অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারত? কিন্তু সত্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে এবং সত্য প্রচারের দায়ে কত বড় বড় মানুষকেও যে শাস্তি দেয়া হয়েছে, তাদের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে। কিন্তু তারপরও সত্যের সন্ধানে মানুষ ছোটে, কখনও নিজের জীবন বিপন্ন করেও। আর কখনও কখনও নিরীহ সত্যকে শক্তিশালী মিথ্যা দিয়ে পরাজিত করা হয়, অপমানিত করা হয় তার নজির অসংখ্য।

আরজ আলী মাতব্বর তার স্নেহময়ী ও দুঃখিনী মায়ের মৃত্যুর পর তার একটা ছবি তুলে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। এলাকার ধর্মীয় নেতারা ছবি তোলার অপরাধে তার মায়ের জানাজা করতে দিলেন না। মনে প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে আরজ আলী মাতব্বর বিজ্ঞানচর্চা শুরু করলেন, শুধু উত্তর পাওয়া নয় সত্যের সন্ধানে লিপ্ত থাকলেন সারাটা জীবন। শত আঘাত, অপমান, মৃত্যুর হুমকি, আক্রমণ মোকাবিলা করেও তিনি সত্য সাধনার পথে অবিচল হেঁটেছেন। আজ যখন ছবি তুলে পাসপোর্ট করে হজব্রত পালন করতে যাওয়া, টিভিতে, ফেসবুকে, ইউটিউবে ধর্মীয় প্রচার করা হয় তখন কি দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে এই প্রশ্নটি কেউ করেন, তাহলে তখন ছবি তোলার অপরাধে এই শাস্তি কি ন্যায়সংগত হয়েছিল?

ধর্ম বিশ্বাস এবং বিজ্ঞান যাচাই-বাছাই পরীক্ষা করে গ্রহণ করার বিষয় এই কথাকে নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। একজন বিজ্ঞান ও অংকের শিক্ষক ধর্ম অবমাননার কথিত অপরাধে জেল খাটছেন। ছাত্র এবং এলাকাবাসী উত্তেজিত হয়েছে, তার ওপর হামলার চেষ্টা হয়েছে, স্কুলের অফিস সহকারী বাদী হয়ে মামলা করেছেন, পুলিশ মামলা নিয়েছে এবং আদালত তার জামিন দেননি। গত কদিনের এসব খবর আলোড়িত করেছে মানুষের হৃদয়। বেদনায় অনেকে বলেছেন, এ কেমন সমাজ আমাদের? জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির যুগে কীভাবে সমাজটা এ জায়গায় এলো?

মুসলমানদের করোনা হবে না, গোমূত্র পান করলে করোনা থেকে মিলবে মুক্তি, প্রকাশ্য সমাবেশে এসব কথা বলার জন্য কাউকে তিরষ্কৃত হতে কি দেখেছি আমরা? কিন্তু করোনার রূপান্তর যে বিবর্তনবাদকে সুপ্রমাণ করে, ভ্যাকসিন আবিষ্কার যে জীববিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই হয়েছে তা বলার মতো মুক্ত পরিবেশের বড় অভাব। আর অবরুদ্ধ চিন্তার জগতে মুক্তচিন্তা করতে গেলে আঘাত তো পেতেই হবে। আঘাত যারা করছেন বা করবেন কিংবা অতীতে করেছেন তারাও কি বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে পেরেছেন? তারা কি তাদের পুরোনো চিন্তাকে কিছুটা হলেও পরিত্যাগ করেননি? তারপরও মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়ে এই উত্তেজনা কেন করেন তাঁরা? কী লাভ আছে এতে?

‘গণিত শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল স্যারকে আমার চাকরিজীবনে ধর্ম নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে শুনিনি। তিনি একজন ভালো শিক্ষক’– কে বলেছে এই কথা? বলেছেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী মো. আসাদ মিয়া। আসাদ মিয়া গত ১০ বছর ধরে ওই স্কুলে অফিস সহকারী পদে কর্মরত আছেন।

গত বৃহস্পতিবার একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে উল্লিখিত কথাগুলো বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘মামলার বাদী হতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন এবং আমি তাতে রাজি হই।’ আসাদ বলেছেন, 'তবে আমার সঙ্গে ঘটনার ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ কোনো আলোচনা করেনি। শুধু মামলার বাদী হতে সদর থানায় ডাকা হয়েছিল।’ সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার আসাদ যখন বলেন, ‘আমারও প্রশ্ন আমিই কেন মামলার বাদী? স্কুলে তো আরও অনেক মানুষ ছিলেন।’

আইনজীবীদের মতে, এই মামলা নেয়ার এখতিয়ারই মুন্সীগঞ্জ থানা পুলিশের ছিল না। তারা প্রশ্ন তুলেছেন যে, জামিন কেন হলো না? তাদের কথা অনুযায়ী শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় মামলা করার আগে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারার বিধান মতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল, যা মানা হয়নি। ফলে মুন্সীগঞ্জ সদর থানা মামলা গ্রহণ করারই কোনো এখতিয়ার ছিল না। এ বিষয় কি পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানতেন না? আবার যে অভিযোগে মামলা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। এমন এক মামলায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিলেন না কেন, তাও অনেকের কাছে বোধগম্য নয়।

হৃদয় মণ্ডল নাম অনুযায়ী ধর্মে হিন্দু। শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত ভালো। অনেক ছাত্র তার কাছে প্রাইভেট পড়ে, নিয়- কানুনের ব্যাপারে খুব কড়া, কোনো অন্যায় সুবিধাকে প্রশ্রয় দেন না, দেরি করে ক্লাসে আসাকে সহ্য করেন না, পাস নম্বর না পেলে কোনো সুপারিশেই পাস করান না এসব কথা তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে সহকর্মীরা সবাই বলছেন। এগুলো তো যেকোনো শিক্ষকের জন্য একটি মহৎ গুণ এবং যোগ্যতা বলে বিবেচিত হতে পারে এবং তিনি হতে পারেন প্রশংসিত। কিন্তু তিনি আজ ছাত্রদের কাছে অপমানিত, জীবন ও মর্যাদা নিয়ে শঙ্কিত।

মুন্সিগঞ্জের হৃদয় মণ্ডল, নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তি, নাসির নগরের রসরাজ, সুনামগঞ্জের ঝুমন দাস, ভোলার বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য, রংপুরের টিটু রায় এমন যত ঘটনা এবং যত নাম তার কি কোনো যোগসূত্র নেই? আপাত সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে স্বার্থ-সুবিধা ও সম্পত্তি এই তিন ‘স’ কি যুক্ত নেই? প্রতিটি ক্ষেত্রেই উত্তর হচ্ছে, আছে। তাহলে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা কেন এসব স্বার্থবুদ্ধি তাড়িতদের দ্বারা এত দ্রুত প্রভাবিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন? এর উত্তর পেতে হবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্যে এবং প্রতিকার করতে হবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি শক্তিশালী করার মাধ্যমে।

অনেক দুঃখে নজরুল লিখেছিলেন, ‘‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে/ আমরা তখনও বসে/ বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি/ ফিকাহ হাদিস চষে।” আজ হাতে হাতে মোবাইল ফোন পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে, আমরা মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করছি কিন্তু যুক্তি করার মন তৈরি করতে পারছি না। সাম্প্রদায়িক মনন আর প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা আর কূপমণ্ডূক চিন্তা কি সমাজকে এগিয়ে নেবে নাকি ঘোর অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে তা ভাবার সময় কি এখনও আসেনি? ভোটের স্বার্থে ভবিষ্যৎকে কি বিসর্জন দেবে ক্ষমতাসীনরা?

দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে মাথা নিচু করে গ্যালিলিও বলেছিলেন, তবুও পৃথিবী ঘুরছে। তাকে বন্দি করা হয়েছিল কিন্তু বিজ্ঞানচিন্তাকে বন্দি করা যায়নি। আজ একজন বিজ্ঞান শিক্ষক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে। যে ছাত্ররা গোপনে রেকর্ড করেছে, উত্তেজিত হয়ে অপমান করেছে তারা ভুল করেছে কিন্তু যারা তাদেরকে ব্যবহার করেছে তারা তো অপরাধী।

রাষ্ট্র-সমাজ ও যুক্তিবাদী বিবেক সবখানেই তারা অপরাধী। তাদেরকে খুঁজে বের না করা রাষ্ট্রের অপরাধ। আর যারা বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করেন, নিজেদেরকে বিজ্ঞানমনস্ক মনে করে একটু তৃপ্তি লাভ করেন তারা কি আত্মজিজ্ঞাসা করবেন না, কী দায়িত্ব পালন করেছেন তারা? হৃদয় মণ্ডলের উপর অত্যাচারে তাদের হৃদয়ে কি বেদনার আলোড়ন ওঠেনি। হৃদয় মণ্ডল একা হয়ে গেলে সমাজের মানুষেরাও যে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। যুক্তিহীন নিঃসঙ্গতার এই অশনিসংকেত কি উপেক্ষা করা যায়?

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর