গত দুই বছরে করোনা মহামারির প্রবল দাপটে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেছে। আয়-রোজগার হারিয়ে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। সম্প্রতি মহামারির দাপট কমলেও এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অসহায় মানুষগুলো। এমনই বাস্তবতায় এসেছে পবিত্র রমজান মাস।রোজার অর্থ সংযম হলেও এ সময়টায় সুযোগ সন্ধানীরা চরম অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। প্রতি বছর রোজা এলেই নিয়ম করে বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে এখন আর শুধু রমজানে দাম বাড়ে না, সারা বছরই বাড়ে। একবার বাড়লে আর কমে না। চাল-ডাল, ছোলা-চিনি, আটা-গুঁড়ো দুধ থেকে শুরু করে এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম নিয়মিত বাড়ছে না।
আর প্রতি বছরের মতো এবারও রোজায় দাম বেড়েছে লেবু-বেগুন, শসা-খেজুর, কলা-ফলমূলের মতো ইফতারের আনুষঙ্গিক পণ্যের। ফলে বেগুনির বিকল্প হিসেবে মিষ্টি কুমড়া বা পেঁপে খাওয়ার চেষ্টা করছে মানুষ। বেগুনের বিকল্প মিষ্টি কুমড়া অবশ্য মন্দ নয়। তবে ভোজ্যতেলের বিকল্প না থাকায় তেল নিয়ে নিদারুণ তেলেসমাতিতে মানুষ ইতোমধ্যে তেলের ব্যবহার কমিয়েছে অস্বাভাবিক হারে।রপ্তানিকারক দেশগুলোয় উৎপাদনের ঘাটতির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং জাহাজে পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়াকে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়ার জন্য দায়ী করেছেন।আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বাড়ার এই অজুহাতে ব্যবসায়ীরা প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে জীবনযাত্রাকে কষ্টকর করে তুলেছে।আন্তর্জাতিক বাজার বাদ থাকুক। আমাদের দেশজ পণ্যের দামও বাড়ে কারণে-অকারণে। বৃষ্টি হলে দাম বাড়ে, বৃষ্টি না হলেও দাম বাড়ে। খরায় বাড়ে, বাড়ে বন্যায়, ঝড় হলে বাড়ে, গরমে বাড়ে, বাড়ে শীতেও। দাম বৃদ্ধিকারীদের থলেতে এমন অসংখ্য যুক্তি জমা আছে। এবার অবশ্য আরও গুরুতর যুক্তি রয়েছে- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।করোনাকালের বেকারত্ব কিছুটা কমলেও আয়–রোজগারও কমেছে বহুলাংশে। খোদ সরকারি জরিপই বলছে, ২০২০ সালের শেষে করোনা মহামারিতে গড় আয় কমেছে ২০ শতাংশ, বেসরকারি জরিপে অবশ্য এই হার ৪০ শতাংশের কাছাকাছি।মহামারি শুরুর পর বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসে দেশে দারিদ্র্য বাড়ার বিষয়টি। ২০২০ সালের জুনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ সমীক্ষার গবেষণায় বলা হয়েছিল, দেশের দারিদ্র্য বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। সিপিডি বলেছিল, দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশ। সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, এই হার ২৯ শতাংশ। শতাংশের হিসাবে গরমিল থাকলেও দারিদ্র্য বাড়ার হিসাবটি সব গবেষণাতেই বেরিয়ে এসেছে।ফলে স্বাভাবিক বাজারমূল্যেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রহিত হয়ে গেছে। তার ওপর দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। জনসংখ্যার বড় একটা অংশ মূল্য বাড়ার এই চাপ আর নিতে পারছে না। ফলে টান পড়েছে প্রোটিনে, ভিটামিনে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে তো বটেই।সারা বিশ্বে ধর্মীয় উপলক্ষ বা উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমে যায়, উৎসব ঘিরে ‘মূল্যছাড়’-এর হিড়িক পড়ে। মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসবকেন্দ্রিক ‘ছাড়’। অনেকে বছরভর এ সময়টার অপেক্ষায় থাকে। সারা বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখে তারা। ছাড় আর সেলের এ রীতি দুনিয়াজোড়া, ব্যতিক্রম শুধু আমাদের বাংলাদেশে। এখানে উৎসবের আগে পণ্যের দাম না কমে বরং বাড়ে।টিসিবির লম্বা লাইন আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ট্রাকের পেছনে লাইনে হাতাহাতি-মারামারি হচ্ছে, জ্ঞান হারাচ্ছে, অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। এসব কোনো সুস্থ বাজার ব্যবস্থাপনা নয়। রমজানে পণ্যের চাহিদা কী পরিমাণ বাড়বে, সেই হিসাবটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অবশ্যই আগে থেকে জানা থাকার কথা। তাহলে আগেভাগেই কেন আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না?
সব মিলিয়ে মানসম্মত একটা বাজারব্যবস্থা অনেক আগেই গড়ে ওঠার প্রয়োজন থাকলেও কার্যত তা হয়ে ওঠেনি। কর্তাব্যক্তিরা বলছেন- শুধু নিম্নবিত্তই নয়, এখন সাশ্রয় পেতে মধ্যবিত্তরাও টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনছে। যারা বলছেন, তারা বিচিত্র কারণে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেন। কিন্তু শ্রমঘণ্টা নষ্ট করে, তীব্র গরমে সব কাজ বাদ দিয়ে কেন মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে হবে? এ দেশে তো যুদ্ধ হচ্ছে না। যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনে।দেশের সাধারণ মানুষ একটা সহজ-স্বাভাবিক বাজারের প্রত্যাশা করতেই পারে; যে বাজারে কালোবাজারিদের তৎপরতা থাকবে না, ধর্মের নামে অধর্ম হবে না, পণ্যের লাগামহীন দাম বাড়বে না । মানুষ শান্তিতে অন্তত নিজের ধর্ম পালনে মনোনিবেশ করতে পারবে।দুষ্টচক্রের হাতে বাজারের লাগামটা থাকায় সাধারণ মানুষের তেলের বোতলটা যেমন শিশি হয়ে গেছে, তেমনি বাজারের ছোট থলেটা আরও ছোট হয়ে গেছে।অর্থনীতির এই দমবন্ধ অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি চায়।কিন্তু কীভাবে মুক্তি মিলবে এই প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তরও নেই।
লেখক: শিক্ষক, প্রবন্ধকার।