বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হৃদয় মণ্ডলের জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ৮ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:৪০

আজ টিপ পরা যাবে না, কাল লিপস্টিক পরা যাবে না, পরশু পরা যাবে না শাড়ি, স্কুলে বিজ্ঞান পড়া যাবে না। এর পর হয়তো আসবে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে না। বাংলাদেশ নীরবে আফগানিস্তানে পরিণত হবে!

বিখ্যাত নাট্যকার ব্রেটল্ট ব্রেশটয়ের ‘গ্যালিলিওর জীবনী’ নাটকের একটি দৃশ্যে এক তাৎপর্যময় বর্ণনা রয়েছে। চার্চের প্রচণ্ড চাপে পড়ে শেষ বয়সে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এই মর্মে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, “আমি এতদিন যা বলেছি౼অর্থাৎ সূর্য স্থির এবং পৃথিবী ঘূর্ণমান౼ এ মতবাদ ভুল, অসার, হাস্যস্পদ এবং ধর্মবিরোধী!”

গ্যালিলিওর এই ঘোষণা শুনে তার দীর্ঘদিনের পুরোনো ছাত্র আন্দ্রিয়া চিৎকার করে বলেছিলেন, “অভাগা সে দেশ, যার বীরপুত্র নেই!”

গ্যালিলিও আন্দ্রিয়ার বক্তব্য শুধরে দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি ভুল বললে আন্দ্রিয়া, অভাগা আসলে সেই দেশ, যার বীরপুত্রের প্রয়োজন!”

হ্যাঁ, আমরা সত্যিই অভাগা যে আমাদের দেশে বীরপুত্রের অভাব রয়েছে। আমরা আরও বেশি অভাগা যে আমরা কেবল বীরপুত্রেরই প্রয়োজন অনুভব করি!

উল্লিখিত কথাগুলো মনে পড়ল মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয়চন্দ্র মণ্ডলের ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার’ মামলায় দুই সপ্তাহ ধরে কারাগারে আটক থাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হৃদয় মণ্ডলের অপরাধ কী? তার অপরাধ তিনি ধর্মকে বিশ্বাসের জায়গায় এবং বিজ্ঞানকে যুক্তি-প্রমাণের জায়গায় থাকার এই চিরন্তন সত্য কথাটি বলেছেন। এই কথোপকথনটি শিক্ষার্থীরা রেকর্ড করেছে। তারপর সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। এই অডিও রেকর্ড নিয়ে তারা হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে। তার শাস্তি দাবি করেছে।

উল্লিখিত ঘটনায় শিক্ষার্থীর প্রশ্ন করার ধরন দেখে মনে হয়েছে, এই ধরনের প্রশ্ন করা, প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা কী প্রশ্ন করতে হবে, সেগুলো গুছিয়ে বলা এবং সব কিছু রেকর্ড করা౼ প্রতিটি বিষয় পরিকল্পিত।

টানা তেরো মিনিট হৃদয় মন্ডলের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। এই তেরো মিনিটে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বার বার হৃদয় মন্ডলকে উসকে দেয়া হয়েছে। রেকর্ড করার কারণ এটাই। যেকোনোভাবে হৃদয় মণ্ডলকে প্রভাবিত করে ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু বলানো। এতে শিক্ষার্থীরা সফল হয়েছে। ক্লাস-টিচারকে অপদস্ত করে, হেনস্তা করে, জেলে পাঠিয়েছে। এই অল্পবয়সী শিক্ষার্থীদের এমন ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত হতে কে সাহায্য করল? কে প্ররোচনা জোগালো? প্রশাসন এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে কেন সবার আগে হৃদয় মণ্ডলকে জেলে পুরলো?

একজন বিজ্ঞানশিক্ষক হিসেবে বিজ্ঞানের দর্শন ঠিকমতো জানা এবং শিক্ষার্থীদের আগে থেকে শিখে আসা প্লটের মুখেও একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে তার চর্চিত বিষয় সম্পর্কে অবিচলভাবে উত্তর দেয়াই কি তার অপরাধ?

যেকোনো বিবেচনায় হৃদয় মণ্ডল বরং প্রকৃত শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। শিক্ষকতার কাজই হলো শিক্ষার্থীর চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করতে সাহায্য করা, তার মধ্যে জানার কৌতূহল সৃষ্টি করা, প্রশ্ন করার সাহস সৃষ্টি ও অনুসন্ধিৎসু মন তৈরি করা। তিনি তার বুঝমতো সেই চেষ্টাই করেছেন। কারো দ্বিমত থাকলে তর্ক-বিতর্ক হবে, সহনশীলতার মধ্যে যুক্তি পাল্টা যুক্তির মধ্যে দিয়ে জ্ঞানের জগৎ সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু সত্য ও নির্ভীক মতামতের জন্য জেলে যেতে হবে কেন?

আমাদের প্রিয় স্বদেশ এখন যেন অন্ধকারময়, অকৃতজ্ঞ, নির্লজ্জ, নির্লিপ্ত এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখানে ক্রমেই ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি শ্রেষ্ঠত্বের আসন দাবি করছে। আমাদের চিন্তা-চেতনাকে চালিত করছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসন। এতে করে আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ধর্মান্ধরা জোর করে তাদের পছন্দ ও ধর্মমত চাপিয়ে দিচ্ছে অন্যদের উপরে। অথচ এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না। রাষ্ট্রশক্তি নানাভাবে এই ধর্মান্ধদেরই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে আজ্ঞাবহে পরিণত হচ্ছে।

দেরিতে হলেও হৃদয় মণ্ডলকে অন্যায় ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গ্রেপ্তারের ঘটনার বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এ ব্যাপারে শিক্ষক সংগঠনগুলো এখনও নির্লিপ্ত রয়েছে। যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। একজন বিজ্ঞানশিক্ষক ক্লাসে বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তার সেই পেশাদারি ভূমিকার প্রশংসা করা, তার পক্ষে দাঁড়ানো যখন একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব, তখন শিক্ষদের সংগঠনগুলো ক্ষমাহীন নীরবতা প্রদর্শন করছে।

তাদের এই নীরবতা ধর্মান্ধদেরই আশকারা দেবে। পক্ষান্তরে যারা যুক্তিবুদ্ধি মেনে পড়ানোর দায়িত্ব পালন করেন, তারা হয়তো খোলা মনে পড়ানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সবাই সতর্ক থাকবেন, যেন কোনো উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে না হয়। তাতে করে শিক্ষার্থীরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা থেকে বঞ্চিত হবে। তাদের ধর্মান্ধ মানসিকতা আরও পুষ্ট হবে।

এমনিতেই আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমছে। দক্ষ শিক্ষকের অভাব, ল্যাবের অপ্রতুলতা, অতিরিক্ত খরচ, পড়াশোনা শেষে বিষয়ভিত্তিক চাকরির অনিশ্চয়তা ইত্যাদি এর প্রধান কারণ। হৃদয় মণ্ডলের ঘটনার কারণে ভবিষ্যতে দেশের অনেক বিজ্ঞানশিক্ষক বিজ্ঞান পড়াতে নিরুৎসাহী হবে বলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

কারণ সামাজিক কোনো সূত্রকে নির্মোহভাবে আলোচনা করতে গেলে কোনো শিক্ষকের দুই গালে তালে তালে জুতা মারার মিছিল হবে না, এবং সেই মিছিলের সূত্রে সে শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? এটা মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন অনেক শিক্ষকের জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন। একজন বিবেকবান আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকের জন্য নিঃসংশয়ে ক্লাস করতে পারার অধিকার ও নিশ্চয়তাটা অত্যন্ত জরুরি।

এই ঘটনায় সবচেয়ে হতাশাজনক ভূমিকা লক্ষ করা গেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি থেকে শুরু করে বাঙালির সমাজ বিকাশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কাছে। তারা এই অন্যায়ের প্রতিবাদে কোনো ভূমিকা তো পালন করেইনি, উল্টো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া বলেছেন, “আমাদের ৯০ শতাংশ মানুষ যেহেতু মুসলিম, সেখানে ধর্ম নিয়ে কন্ট্রাডিকটরি বক্তব্যটা দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয় বলে আমি মনে করি।”

যেখান থেকে হৃদয় মণ্ডলকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ আসার কথা, একজন বিজ্ঞানশিক্ষকের অবস্থানের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি আসার কথা, সেখানকার শিক্ষকনেতাই ‘ধর্মবিদের’ মতো কথা বলেছেন! অপযুক্তি দিয়েছেন। প্রথমত, হৃদয় মন্ডল কোনোভাবেই ‘কন্ট্রাডিক্টরি’ বক্তব্য দেননি, তিনি অর্থহীন কুযুক্তি খণ্ডন করেছেন মাত্র। আর ভুঁইয়া সাহেব বলেছেন যে, আমাদের ৯০ শতাংশ মানুষ যেহেতু মুসলিম সেহেতু ধর্ম নিয়ে কন্ট্রাডিক্টরি বক্তব্য দেয়া সমীচীন নয়। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? অন্যধর্মের লোক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে কি কন্ট্রাডিক্টরি বক্তব্য দেয়া সমীচীন হতো?

এই শিক্ষকনেতার বক্তব্য তো প্রকারান্তরে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে অসহিষ্ণু প্রতীয়মান করে। একজন শিক্ষকনেতার এ ধরনের মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। জামায়াত ও হেফাজত নেতা সাঈদী ও মামুনুল হকের মনমানসিকতার সঙ্গে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও শিক্ষকনেতার কোনো পার্থক্য না থাকে, তাহলে এদেশে প্রগতির চাকা সামনে এগোবে কীভাবে? তাহলে কি শিক্ষিতজনের সঙ্গে মূর্খ-ধর্মান্ধের কোনো পার্থক্য থাকবে না? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মের দোহাই দিয়ে সব অপকর্ম, অপযুক্তিকেই মেনে নিতে হবে?

আসলে আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতায় পুরো দেশ রসাতলে যেতে বসেছে। রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে আমরা এখন আর আগের মতো গর্জে উঠি না। আমাদের প্রতিবাদগুলো যেন নিয়ম রক্ষার প্রতিবাদ।

এই প্রতিবাদহীনতার কারণেই আমরা একটু একটু করে ধর্মান্ধদের আধিপত্যের শিকার হয়েছি। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে জন্ম নেয়া দেশকে এখন পুরোপুরি ধর্মীয় পরিচয়ে মুড়ে দেয়ার আয়োজন চলছে। ১৯৭৫ সালে যেদিন সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো তখন ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা ‘বিশ্ব জয়ের’ আনন্দে শামিল হলো।

এরপর থেকে চলছে ধর্মমুখী বাংলাদেশের যাত্রা। ধারাবাহিকভাবে মেজর জিয়া সংবিধানে একটি বিশেষ ধর্মের বাণী সংযুক্ত করে দিলেন, স্বৈরাচার এরশাদ সংবিধানে রাষ্ট্রের একটা ধর্মীয় পরিচয় খোদাই করে দিলেন, আদালতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সেই ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ খোদাইকৃত পাথরকে রাষ্ট্রের বুক থেকে নামানোর চেষ্টা না করে সেটাকেই নিশানের মতো ঊর্ধ্বে তুলে ধরল, তখন থেকেই পেছনযাত্রায় গতি এলো।

গোঁজামিল ও স্ববিরোধিতায় পূর্ণ এক সংবিধানে নিয়েই দশকের পর দশক ধরে রাজনীতিবিদরা রাজত্ব চালাচ্ছেন। তাদের সম্মিলিত অবদানে একটু একটু করে সব কিছুর দখল নিয়েছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। আমাদের বহু সাধনার অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ ধর্মান্ধ মৌলবাদের কাছে নতজানু হতে হতে আজ মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

এই বাংলাদেশে পৌঁছে আজ একজন মুক্তমনা লেখক তার মুক্ত মত প্রকাশের জন্যে মৌলবাদীদের চাপাতির কোপ খাবেন, ভিন্নমতের জন্য দিনে-দুপুরে ঘর-কার্যালয় থেকে নিরীহ মানুষেরা গুম হয়ে যাবেন, ভিন্নধর্মীয় বিশ্বাসের জন্যে অপমানিত, নিগৃহীত হবেন, শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে ‘এটা বিজ্ঞানের ক্লাস, ধর্মের ক্লাস নয়। বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। আর ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস।’ এ কথাটা ছাত্রদেরকে বলবার জন্য শিক্ষক জেল খাটবেন, এটাই স্বাভাবিক! হচ্ছেও তাই।

আজ টিপ পরা যাবে না, কাল লিপস্টিক পরা যাবে না, পরশু পরা যাবে না শাড়ি, স্কুলে বিজ্ঞান পড়া যাবে না। এর পর হয়তো আসবে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে না। বাংলাদেশ নীরবে আফগানিস্তানে পরিণত হবে!

এরপরও কি আমরা সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াব না? গর্জে উঠব না?

লেখক: প্রবন্ধকার, সাবেক ছাত্রনেতা

এ বিভাগের আরো খবর