টিপ।
নারীর সাজসজ্জার জড় অথচ মূর্ত উপকরণ। তবে জড় বলে টিপকে নিরীহ এক সজ্জাসামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করর বিষয়টি আপাত সমস্যাজনক, কেননা প্রেক্ষিতভেদে টিপসংক্রান্ত ধারণা বদলায়।
কবির কবিতায় প্রিয়ার কপালের টিপ কিংবা শিশুতোষ ছড়ায় ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ যতটা প্রেমময়, আবেগী ও মমতামাখা; বাস্তবে নারীর কপালের টিপ ততটা নয়।
শিশুর কপালে টিপ ব্যবহৃত হয় বদনজর এড়ানোর ধারণা থেকে, ফলে একে নজর টিপও বলে থাকে অনেকে। এই টিপ সাধারণত কালো রঙের হয়। কুপি জ্বালিয়ে কাজলদানিতে তেল মেখে নানি/দাদিদের কাজল তোলার রেওয়াজ এখনও দেখা যায়। অন্যদিকে বাঙালি নারীর সাজসজ্জার উপকরণ হিসাবে টিপ ব্যবহৃত হয়ে এলেও সিঁদুরের লাল টিপ হিন্দু সধবা নারীর প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। সিঁদুরের বাইরে অন্য লাল টিপ মুসলিম নারীর কপালে থাকলে কেউ কেউ ‘হিন্দুয়ানি প্রতীক’ বলেও চিহ্নিত করেন।
আবার টিপের আকারভেদেও ভিন্ন ভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে, যেমন- আকারে বড় টিপ পরিহিতা নারী ছোট টিপ পরিহিতার চাইতে অপেক্ষাকৃত বেশি ‘সমস্যাজনক’! তাই শাড়ি/সালোয়ার কামিজ/জিন্স প্যান্ট বা শার্টের সঙ্গে বড় টিপ পরা নারীর মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য করা হয় এই বলে যে, ‘ওরা নারীবাদী’, ছোট টিপ পরারা এই কাতারে পড়েন না খুব একটা।
সম্প্রতি টিপ পরায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর এক সদস্যের হয়রানির শিকার হয়েছেন একজন কলেজশিক্ষক। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে প্রতিবাদ চলছে। নারীরা টিপ পরে প্রতিবাদ করছেন। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ‘আমার টিপ আমার প্রতিবাদের ভাষা।’ অনেকেই একে ‘টিপ প্রতিবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। তবে আমি একে দেখতে চাই নারীর শরীর ও পোশাকের ওপর পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসনের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে।
পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় নারী মানেই শরীর আর নারীর শরীর মানেই অবদমন, আরোপণ। যুগে যুগে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে এমন কোনো ব্যবস্থা বা পরিসর নেই যেখানে নারীদের ঘিরে এই শরীর ধারণা অনুপস্থিত। খুব সাধারণ একটি উদাহরণ হলো কোনো মেয়ের রং কালো হলে তার কোনো কিছু পছন্দ না হলেই বলা হবে- ‘যেমন চেহারা তেমন ব্যবহার’। আবার কোনো মেয়ের ব্যবহারে তুষ্ট হলে বলা হবে, ‘যেমন সুন্দর চেহারা তেমন সুন্দর তার ব্যবহার।’ যেন আর কোনো পরিচয় এখানে মুখ্য নয়। কোনো একটি মেয়ে হতে পারেন মেধাবী ছাত্রী, গুণী শিল্পী, অভিনেত্রী, নামকরা বিজ্ঞানী, গবেষক’ কিন্তু সব ছাপিয়ে তার মুখ্য পরিচয় হয়ে ওঠে শরীরী বৈশিষ্ট্য।
শুধু টিপই নয়, সাম্প্রতিককালে নারীর বেশভূষা, আচার-আচরণবিষয়ক বেশ কিছু ঘটনা বেশ জোরালোভাবে সামনে এসেছে। অল্প কিছুদিন আগেই টি-শার্ট পরে বাসে ভ্রমণ করার সময় এক তরুণী সহযাত্রী এক নারীর দ্বারাই আক্রোশ ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ময়মনসিংহে এক কিশোরী আত্মহত্যার নোটে লিখে রেখে গেছে, ইচ্ছামতো পোশাক পরতে পরিবারের বাধা দেয়ায় কতটা বিপর্যস্ত ছিল সে। এরই ধারাবাহিকতায় টিপ পরায় হেনস্তার মুখোমুখি হলেন কলেজশিক্ষক।
শরীর যার সিদ্ধান্ত তার, দুর্দান্ত এই নারীবাদী স্লোগানটি সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানাশোনার সুবাদে অনেকেরই হয়তো জানা আছে, এই দৃষ্টিভঙ্গির মূলে আছে শরীরের (বিশেষ করে প্রজনন স্বাস্থ্য) ওপর নারীর নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছার প্রাধান্য। ছোট থেকে বড় হতে হতে নারীরা যত রকম হেনস্তা, নির্যাতন ও আক্রোশের শিকার হন, তার বেশির ভাগই হয় শরীরী নিয়ন্ত্রণের ওপর ভিত্তি করে।
নারীর পোশাক-আশাক, চলাফেরা, হাঁটাচলা থেকে শুরু করে এমনকি নারীকে যে দুই পা চেপে বসতে হবে, এসবই এই নিয়ন্ত্রণের অধীন। কনে দেখতে গিয়ে হাঁটতে বলা বা চুল দেখতে চাওয়ার রেওয়াজ এখনও প্রচলিত। নারীর চুল ছোট করা, কামিজ বা ব্লাউজের স্টাইলিশ কাট নিয়ে মুখের ওপর ঝামা ঘষে নিন্দা করা এবং নির্দ্বিধায় হিজাব করার পরামর্শ দেয়া- এসবই ঘটে নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা থেকেই।
ফলে নারীর জন্য যা কিছু ভালো বা মন্দ তার বেশির ভাগই শরীরকেন্দ্রিক। ভালোর একটু জনপ্রিয় উদাহরণ হলো beauty with brain। করপোরেট জগতে ইদানীং এটা প্রায়ই শোনা যায়। এটি স্পষ্টতই beauty without brain অথবা brain without beauty-কে বিপরীতে দাঁড় করায়।
আবার সতী-অসতী এই বিপরীত জোড় দিয়ে বিষয়টি বোঝা সম্ভব। যেমন- একদিকে ‘সতীত্বের’ লেবেল সেঁটে দিয়ে নারীকে শেখানো হয় ‘শরীর আমার সোনার মন্দির!’ নারী শেখে একে কীভাবে পবিত্র জ্ঞান করতে হয়, অন্যদিকে নানা অনুশাসন ও আরোপনের মাধ্যমে একে ব্যবস্থার অধীন করতে হয়। অসতী না হওয়ার যে তাগিদ পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর ওপর জারি আছে তাতে নারীর শরীর-পোশাক-চলাফেরা সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। মানুষ, পরিবার, সামাজের অনাবশ্যক অভিভাবকত্ব, মোরাল পোলিশিং সবকিছুই চলে সেই নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে। পোশাক ও শরীর নিয়ে কথা শুনতে হয়নি এমন নারী খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। এই রোজার সময়ে ‘মাথায় ঘোমটা দাও’ এমন অনাবশ্যক হুকুম দিতে থাকবেন পথচলতি অসংখ্য ‘অভিভাবক’!
এভাবে সমাজ পারিপার্শ্বিকতা থেকে বড় হতে হতে মেয়েরা জেনে যায় তার শরীর ছোঁয়াচ এড়ানোর ‘কৌশল’। একে রক্ষা করতে না পারা তারই ব্যর্থতা। কেউ ধরে ধরে এসব শিখিয়ে দেয় না, কিন্তু মেয়েরা শেখে ‘শরীর তার সর্বশ্রেষ্ঠ ধন! একে ধুয়ে-মুছে ধুপ কর্পূর মেখে পবিত্র রাখার মধ্যেই নিহিত তার মর্যাদা’। তাই ছোট্ট আশা সুইসাইড নোটে লিখে রেখে যায়, সতিত্ব চলে গেছে বলে তার আর বেঁচে থেকে লাভ নেই।
নারীর শরীর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একদিকে একে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা যেমন আছে, তেমনি আছে নারীর শরীরের ওপর জবরদস্তির নমুনা। আশপাশে এর উদারহণ অজস্র । সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ, যেমন: ১. ধর্ষণ। একটি মেয়ে কার সঙ্গে যৌন সংসর্গে যাবে সেটি তার সিদ্ধান্ত নয়, কোন পুরুষ তাকে শরীরীভাবে পুরুষ আকাঙ্ক্ষা করে সেটিই মুখ্য। এর সঙ্গে আছে পুরুষালি শক্তি প্রদর্শন ও বলপ্রয়োগ। ২. এসিড ছুড়ে মারা। কোনো মেয়ে প্রেমে সাড়া দেয় না তো এসিড ছুড়ে মারো। তার সৌন্দর্য নষ্ট করে দাও। ৩. আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশীর মাধ্যমে শিশু যৌন নির্যাতন। ৪. শায়েস্তা করতে বউ পেটানো। ৫. খুন। এর সবই নিয়মিত ঘটতে দেখা যায় আমাদের চারপাশে।
নারীর শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ, অবদমনের বৈধতাও আছে আমাদের সমাজে। ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেয়া বা আত্মীয়-পরিজনের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনা চেপে যাওয়ার উদাহরণ বাংলাদেশে অজস্র। তা ছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বা বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। এসব ঘটনায় মা-বাবা স্বেচ্ছায় মেয়েদের শরীরের দখল তুলে দেন স্বামীর হাতে।
সমাজের লিঙ্গ নির্ধারণবাদী ধারণা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। সময় বদলেছে, তবে নারীর ওপর লিঙ্গীয় ভূমিকা ও প্রত্যাশার রূপান্তর ঘটেছে মাত্র। ফলে নারীর ওপর আছে সতী হওয়ার চাপ, যৌন নির্যাতন এড়ানোর চাপ, তেমনি ঘর সামলানোর চাপ, ভালো মা হওয়ার চাপ, রোজগারের চাপ, শেষমেশ অসামান্যা, অনন্যা, beauty with brain হওয়ার চাপ।
নারীকে কাজে যেতে হবে বাসে চড়ে। ধাক্কাধাক্কি করে। নরম-শরম হলে বাসেই উঠতে পারবে না। ধাক্কা খেলে নীরবে সয়ে যেতে হবে, নয়তো সহযাত্রী বলে উঠবেন ‘ধাক্কা লাগলে চিল্লায়া ওঠেন তাইলে প্রাইভেট কারে যান না ক্যান?’
নারীর জন্য আরও আছে ধর্মকে সহীহ করে তোলার দায়। নারী যেহেতু অবদমনের জনপ্রিয় টার্গেট, তাই নারীর ওপর আরোপনের মাধ্যমে ধর্মকে সহীহ করে তোলার চেষ্টা চলছেই। খুব বেশিদিন আগে থেকে নয়; ১০, ১৫, বড়জোর ২০ বছর। আমরা দেখেছি ধর্মকে সহীহ করে তুলতে গিয়ে কীভাবে একটা একটা করে ‘বিদাত’ সামনে এসে পড়ল। যেমন: শবেবরাত বিদাত, রুটি হালুয়া বিলানো বিদাত, ঈদে মিলাদুন্নবী বিদাত, মাজারকেন্দ্রিক ইসলামিক আচার বিদাত, পহেলা বৈশাখ হিন্দুয়ানি, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া মূর্তিপূজার সমতুল্য প্রভৃতি। নারীর শরীরও এই প্রকল্পের বাইরে নয়। রাজনীতির মাঠে উগ্রবাদী ওহাবি মতাদর্শের দলগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সমঝোতাও এই পরিস্থিতিকে উসকে দিয়েছে।
বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য সুরক্ষাবলয় হয়ে উঠতে পারেনি তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কোনো কিছুই। ফলে বড় হতে হতে ঘরে-বাইরে পথ চলতে গিয়ে, খেলতে গিয়ে চেনা-অচেনা ব্যক্তির দ্বারা চলে যৌন নির্যাতন। যৌন নির্যাতনের ঘটনা একজন শিশু বা কিশোরীর মনে সারাজীবনের জন্য কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে খুব একটা ভাবাভাবি দেখা যায় না। খুন, হত্যা, ধর্ষণের বিচারহীনতা নিয়েও আলোচনার তাগিদ খুব একটা নেই। বরং দরকারি আলাপ চেপে রাখার প্রবণতা বেশি। ভুলে যাওয়ায় উৎসাহ বেশি।
আমাদের সামগ্রিক পরিবেশই একজন পুলিশকে নারীর বিরুদ্ধে মোরাল পোলিশিং করতে উৎসাহিত করে। অথচ ব্যক্তির পোশাক ও শরীরের ওপর ব্যক্তির ইচ্ছার প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি হওয়া উচিত। তা সে জিন্স পরুক বা কপালে টিপ। কেননা কপাল যার সিদ্ধান্ত কেবল তারই।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক