বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অগণতান্ত্রিক ঝড়ে টালমাটাল ইমরান খানের গদি

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ৩১ মার্চ, ২০২২ ১৪:১১

বাস্তবতা বলে যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা। আর দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হচ্ছে আসলে সেনাপ্রধান। যখনই পাকিস্তানে কোনো বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, সেটা যে রাজনৈতিক দলেরই হোক, তাদেরকে একটা আপস বা সমঝোতা করতে হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে।

কথায় আছে,‘হাতি যখন গর্তে পড়ে, চামচিকাও লাথি মারে।’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের এখন হয়েছে সেই দশা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে বইছে রাজনৈতিক ঝড়। যে ঝড়ে বড় বিপথগামী, বিপৎসংকুল হয়ে উঠেছে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর জীবন। একটু একটু করে সমর্থন কমছে। গদি টলটলায়মান। তার বিরুদ্ধে সংসদের নিম্নকক্ষে অনাস্থা প্রস্তাবে কোমর বেঁধেছে বিরোধীরা। নানা নিয়মনীতি পেরিয়ে ৩ এপ্রিল সংসদে এ নিয়ে ভোট হবে। এখন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে বিরোধীদের ডাকা এই অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান খানকে জয় পেতে হবে। বিরোধীরা যদি ১৭২ ভোট পেতে ব্যর্থ হয় তাহলেই ক্ষমতায় টিকে থাকবেন তিনি। তবে চূড়ান্ত ভোটাভুটির আগেই বিরোধীরা যদি এই প্রস্তাব তুলে নেয় তাহলেও বেঁচে যাবেন ইমরান খান।

ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর অনুষ্ঠেয় ভোটে ইমরানের জয়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে তিনি পাকিস্তানের নিয়ন্তা পাকিস্তানি সেনা এবং মহাপ্রভু আইএসআইয়ের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের হাত মাথায় থাকলে, সমর্থনের সুবাতাস ইমরানের পালে ফিরবে, এটা কে না জানে? কিন্তু রাজনীতির মাঠের আনকোরা খেলোয়াড় ইমরান কি পারবেন তাদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে? মসনদে টিকে থাকার কৌশল প্রয়োগ করতে?

এই ঘটনায় অতীতের মতো আবারও রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে পাকিস্তান। অনেকেই সেনাশাসনের ‘সম্ভাবনা’ দেখছেন। তবে বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতিতে ইমরানের টিকে থাকা কঠিন। সংসদের নিম্নকক্ষ, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ৩৪২ সদস্যের মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর ১৭৯ জন। সর্বশেষ জামুরি ওয়াতন পার্টি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, তাদের বড় কোনো সংখ্যা ছিল না মোটেই, সবেধন নীলমণিটি ছিলেন, মানে একজন, কিন্তু একের জোর কোনো কোনো সময় একশ’র চেয়েও বেশি। আপাতত, পাকিস্তানি শাসকের সংখ্যাটা ১৭৮। ইমরান অবশ্য তরীটা তীরে ভেড়ানোর প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছেন না।

ফলে তার আর তিন সঙ্গী দল, পিএমএল-কিউ, বালুচিস্তান আওয়ামী পার্টি এবং মুত্তাহিদা কোয়ামি মুভমেন্ট পাকিস্তান, অনাস্থা ভোটের বিরুদ্ধে যাবে বলে জানিয়েছে। এভাবে ইমরান মোটামুটি ১৭ জনের সমর্থন নিশ্চিত করেছেন। তারা ইমরানের কাছে এই বার্তাও পৌঁছে দিয়েছে যে, আমাদের মাথা নত রয়েছে তোমার চরণতলে, কিন্তু ইমরানের নিজের দল, পিটিআই, সেখানেই যে বিপদের ছড়াছড়ি। দলের মধ্যেও তিনি আস্থা হারিয়েছেন। দলের অন্তত ২৪ জন বিক্ষুব্ধ এমপি পক্ষ ত্যাগ করেছেন।

২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে, ইমরান খানের নেতৃত্বে, তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ জাতীয় পরিষদে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। পাকিস্তানের ৩৪২ আসনের জাতীয় পরিষদে, ইমরান খানের দল ১৪৯টি আসন পায়, তার প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ পায় ৮২টি আসন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ৫৪টি আসন পায়। ইমরান খান কিছু ছোট দলের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ১৭২ আসনের সংখ্যা সংগ্রহ করেন।

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ইমরান খান সাধারণ মানুষকে নয়া পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পাকিস্তানের মানুষ ভেবেছিলেন, এবার হয়তো দিন বদলাবে। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়ার পর ইমরান খান হয়তো আগের মতোই ইনিংস খেলবেন! এমনটাই মনে করেছিলেন পাকিস্তানের মানুষ। কিন্তু ভাবনা ও বাস্তবের মধ্যে অমিল ধরা পড়ে কয়েকদিন পর থেকেই। পাকিস্তানের হাল ফেরেনি। বরং কিছু জায়গায় আগের থেকেও বেহাল দশা হয়েছে। একে তো গোটা দেশে আর্থিক সংকট। তার পর মূল্যবৃদ্ধি। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার মতো অবস্থা।

করোনা মহামারির পর এখন পাকিস্তানের জনগণের বিপুল অংশের দুবেলা খাবারও জুটছে না। মুদ্রাস্ফীতি ভেঙে দিয়েছে ৭০ বছরের রেকর্ড। সমস্ত খাবারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। এর মধ্যে অন্যতম ঘি, পোলট্রি, তেল ও ময়দাজাত খাবার। ফলে ধীরে ধীরে ইমরান খানের ওপর আস্থা হারিয়েছেন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। সামরিক খাতে ইমরান খানের নজর রয়েছে। তবে দেশের সাধারণ সমস্যা নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। এমনই মনে করতে শুরু করেছে পাকিস্তানের মানুষ।

এমন জল্পনা রয়েছে যে, পাকিস্তানে ফের ক্ষমতা দখল করতে পারে সেনাবাহিনী। ইমরান খানকে টপকে ইতোমধ্যে বহু ক্ষেত্রে সেনাকর্তারা সরকারি সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছেন। সরকারের কাজকর্মে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা নাক গলাতে শুরু করেছেন গত কয়েক মাস ধরে। কখনও পাকিস্তানে লকডাউন নিয়ে সেনাপ্রধান নির্দেশিকা দিয়েছেন। কখনও আবার করোনা আক্রান্তদের তথ্য দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী।

তিনিই যেন সরকারের মুখপাত্র। অর্থাৎ, সরকার ও সেনার বিরোধ স্পষ্ট। সরকারি কর্তারা সেনা কর্তাদের সঙ্গে বসে করোনার তথ্য ব্রিফিং করেছেন। আর সেই ছবি দেখানো হয়েছে পাকিস্তানের ন্যাশনাল চ্যানেলে। যা মোটেও ভালো বিজ্ঞাপন নয়। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর নিয়েও পাকিস্তানের সেনা ও সরকারের মতবিরোধ হয়েছে।

ইমরান খান নিজেও সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। তার এই সিদ্ধান্তই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। এদিকে দেশের মানুষ ইমরান খানের ওপর আর ভরসা করছেন না। পররাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু করে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাত নিয়েও বেশ প্রতিকূলতার মুখে পড়েছেন ইমরান খান।

এসবের মধ্যে মন্ত্রিসভায় ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু ইমরান তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ উঠছে। যার জেরে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনীতির ময়দানে ইমরানের পায়ের তলার মাটি সরছে। আর এই সুযোগে পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলের সুযোগ ছাড়বে না সেনাবাহিনী।

সেনার ক্ষমতাদখল পাকিস্তানে নতুন কিছু নয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারা পাকিস্তানের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে কোনো প্রধানমন্ত্রী পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।

উল্লেখ্য, গত বছরের মার্চেও ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় ভোট পেয়ে টিকে যায় ইমরান খানের সরকার।

বাস্তবতা বলে যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা। আর দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হচ্ছে আসলে সেনাপ্রধান। যখনই পাকিস্তানে কোনো বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, সেটা যে রাজনৈতিক দলেরই হোক, তাদেরকে একটা আপস বা সমঝোতা করতে হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে। এই আপস-রফা রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত ক্ষমতায় গিয়ে করেন। কিন্তু ইমরান খান ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই এই আপস-রফা করেছিলেন। কিন্তু এই ‘প্রেম’ তিনি ধরে রাখতে পারেননি। তিনি সেনা সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘বাড়তি কিছু’ করে দেখাতে চেয়েছিলেন। আর এটাই কাল হয়েছে।

বেশ কিছুদিন ধরেই সেনাবাহিনীর ‘অপছন্দের’ প্রধানমন্ত্রী হয়ে গিয়েছেন ইমরান। ইউক্রেন সংকটের জন‌্য ইমরান অকারণে আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে চটানোয় প্রধানমন্ত্রী ইমরান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চক্ষুশূল হয়েছেন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কিন্তু দিন দিন দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। পরমাণু অস্ত্রধারী দেশটি প্রতিবেশী আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে এবং প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অধীনে পাকিস্তান ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে সরে চীনের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

সব মিলিয়ে তিনি সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারিয়েছেন। ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে আমেরিকারও ভূমিকা আছে। কারণ আমেরিকা চাইছে না চীন-রাশিয়াঘনিষ্ঠ কেউ পাকিস্তানের ক্ষমতায় থাকুক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইতোমধ্যেই ইমরানের ইস্তফার দিন স্থির করে দিয়েছে খোদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সম্প্রতি ইমরান দেখা করেন সেনাপ্রধানের সঙ্গে। সেই বৈঠকে ইমরানকে ইস্তফার পরামর্শ দেয়া হয়। তারপরও ইমরান শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

এখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে ইমরানকে প্রথমেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করতে হবে। অতীতের ‘অবাধ্যতা’র জন্য নাকে খতও দিতে হবে। একইসঙ্গে ডজনকে-ডজন সদস্যকে তার পক্ষে আনতে হবে। তাদের বিদ্রোহ অতি সুচতুরভাবে দমন করতে হবে। কিন্তু বিনাশকাল যখন চলে আসে, তখন মাথায় বুদ্ধি আসে না, আসলেও সেটা কাজ করে না। ইমরানের সেই ‘ক্যারিশমা’ আছে কি না, সেটা জানার জন্য আমাদের আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা।

এ বিভাগের আরো খবর