বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দীর্ঘ লাইনে দীর্ঘশ্বাস

  •    
  • ১১ মার্চ, ২০২২ ১৭:৩০

দারিদ্র্য কষ্ট দেয় কিন্তু অপমান জ্বালা ধরায়। কতখানি আর্থিক টানাপোড়েনে পড়লে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে গরমে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন তা বুঝতে হলে বাজারে জিনিসের দাম আর পকেটে টাকার পরিমাণ কত তা কি একটু খেয়াল করবেন না? নাকি নিজেদের অবস্থান থেকে দেখবেন?

কাজ বাদ দিয়ে টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। লাইন শেষ না হলেও ট্রাকের জিনিসপত্র শেষ। হতাশায় ভেঙে পড়া মানুষের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। টিসিবি ভর্তুকি মূল্যে সয়াবিন তেল-চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করে। টিসিবির ট্রাক থেকে দুই লিটার সয়াবিন তেল কেনা যায় ২২০ টাকায়, বাজারে যা ৩৩০ টাকা। টিসিবি চিনি বিক্রি করে ৫৫ টাকা কেজিতে।

বাজার থেকে চিনি কিনতে দাম পড়ে কেজিপ্রতি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। টিসিবি মসুর ডাল বিক্রি করে ৬৫ টাকায়, যা বাজারে ৯৫ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। বাজার থেকে যে পেঁয়াজ কিনতে ৫০ টাকা লাগে, একই পেঁয়াজ টিসিবির ট্রাক থেকে ৩০ টাকায় কেনা যায়। তেল-চিনি, পেঁয়াজ-ডাল এই চার পণ্য বিক্রি হয় টিসিবির ট্রাক থেকে। প্রতিদিন ১৫০টি ট্রাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে টিসিবি পণ্য বিক্রি করে। প্রতি ট্রাকে ২৫০ জন মানুষ পণ্য পেতে পারেন। সেই হিসেবে দিনে ৩৭ হাজার ৫০০ মানুষ পণ্য পাবেন। কিন্তু ঢাকা শহরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তো ১ কোটিরও বেশি, যাদের মধ্যে ৪০ লাখের বেশি বস্তিবাসী।

চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের এই পার্থক্যের কথা জেনে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে সেই সকাল থেকে, ট্রাক আসে ৯টায়। বাজার দর আর টিসিবির পণ্যের দরের যে পার্থক্য তাতে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা সাশ্রয় হয় একজন ক্রেতার। যাদের কাজ না করলে চলে না তারা লাইনে দাঁড়াতে পারেন না, কারণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কমপক্ষে ৫ ঘণ্টা। ফলে লাইনে বৃদ্ধ, নারী এবং কর্মহীনদের সংখ্যা বেশি। একজন মন্ত্রী একবার বলেছিলেন এখন প্যান্ট শার্ট পরা মানুষও ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন।

গত ৪ বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। যদিও মন্ত্রী বলেছেন মোটা চাল এখন গরুকে খাওয়ানো হয়, হয়ত তার বিবেচনায় যারা মোটা চাল খান তারা গরুর পর্যায়ে পড়ে। খাবারের তেল সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৯৪ শতাংশ, গ্যাসের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ এবং মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ১১৫ শতাংশ, সরকারঘোষিত মূল্যস্ফীতি গড়ে বছরে ৫.৫ শতাংশ অর্থাৎ ৪ বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি কত? মন্ত্রী বলেছেন, আয় বেড়েছে দুই তিন গুণ অর্থাৎ ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ। সে কারণেই নাকি জিনিসের দাম বাড়লেও মানুষের কষ্ট হচ্ছে না। না খেয়ে কোনো মানুষ তো মরছে না।

আর একজন তো বলেই ফেললেন, এখন একজন শ্রমিক যা আয় করে তা দিয়ে নাকি দিনে ২০ কেজি চাল কিনতে পারে। অর্থাৎ দিনে ১১০০ টাকা আয় মানে মাসে ৩৩ হাজার টাকা আয় করে এমন শ্রমিক কোথায় বা কজন তা কি জিজ্ঞেস করা যাবে? এটা অবশ্য সত্যি যে দেশে একদল এমন মানুষ আছেন যারা তাদের আয় দিয়ে দিনে ২০ টন চাল কিনতে পারবেন। তাদের আয়ের উৎস, পরিমাণ এবং তাদের মান সম্মানের কথা জানতে না চাওয়াটা শুধু ভালো নয়, নিরাপদও বটে।

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধি কি প্রভাব ফেলে না আমাদের জীবন আর দেশের ভবিষ্যতে? একজন অযোগ্য দরিদ্র মানুষ (মাথাপিছু ২৫৫১ ডলার আয়ের দেশে দরিদ্র থাকাটা অযোগ্যতা) যদি দিনে ১.৯ ডলার বা ১৬৫ টাকার বেশি আয় করেন তাহলে তিনি নাকি আর দরিদ্র থাকবেন না। তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনে মিলে মাসে ৯ হাজার ৯০০ টাকা আয় করলে তারা দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে যাবেন। যদিও মাথাপিছু আয়ের হিসাবে তাদের আয় হওয়ার কথা ৩৭ হাজার টাকা। এই টাকা উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ থাকলেও টাকার ভাগ তারা পাবেন না। ধরে নেই তাদের বাবা-মা নেই, সন্তান-সন্ততি নেই, ভাই-বোন নেই, কারো প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই। তারা দুজন হংসমিথুন, কাজ করে, আয় করে, খায় আর ঘুমায়; এবং তারা দরিদ্র নন।

তাহলে বাজার দর অনুযায়ী ঘর ভাড়া ৪ হাজার টাকা, মাসে ২০ কেজি চাল- ১১০০ টাকা, রান্নার গ্যাস- ১২০০ টাকা, মাছ মাংস ডিম দিনে ৫০ টাকা হিসাবে মাসে ১৫০০ টাকা, শাকসবজি দিনে ২০ টাকা অর্থাৎ মাসে ৬০০ টাকা, তেল ২ লিটার-৩৩০ টাকা, ডাল ২ কেজি-১৬০ টাকা, কাপড় ধোয়ার সাবান, তেল, গায়ে মাখা সাবান, টুথ পেস্ট- ২০০ টাকা, দিনে ১০ টাকা বাস ভাড়া হলে মাসে ৩০০ টাকা, বিকেলের নাস্তায় দিনে এক কাপ চা আর বিস্কুট খেলে ২০ টাকা হিসেবে মাসে ৬০০ টাকা তারপর ? তারা কাপড় কিনবেন না, অসুস্থ হবেন না এবং এই আয়ের বিচারে তারা আর দরিদ্র হিসেবে বিবেচিত হবেন না। এরা আমাদের শ্রমজীবী যুবশক্তি! আমাদের ভবিষ্যৎ শ্রমশক্তি আসবে তাহলে কোথা থেকে, যারা আসবে তারা কী ধরনের স্বাস্থ্য পুষ্টি আর শিক্ষা নিয়ে বড় হবে? এই জনগোষ্ঠী তো দেশে ১২ কোটির বেশি।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৮২ লাখ। যাদের ৯০ শতাংশ কাজ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এদের কথা না হয় না ভাবলেন কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু যাদের মাসিক আয় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার এই পরিবারগুলো কীভাবে চলছে? যাদের আয় ২০ থেকে ৪০ হাজার, তারা কি টিসিবির ট্রাকে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে পারেন? তাদের সংসার তারা কীভাবে চালান? টিসিবির হিসাবে, ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে মোটা চালের দাম ৩২ শতাংশ, সরু চাল ২৮ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিন তেল ৫৫ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেল ৮২ শতাংশ, মোটা দানার মসুর ডাল ৬৩ শতাংশ, চিনি ৩২ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ২১ শতাংশ, খোলা আটা ২২ শতাংশ ও এলপি গ্যাসের দাম ১৮ শতাংশ করে বেড়েছে।

মন্ত্রী যতই ভাত কম খেতে বলুন না কেন ভাত ছাড়া আর কী খাবে অল্প আয়ের মানুষে? সাধারণ হিসাবে শ্রমজীবী পাঁচজনের একটি পরিবারে মাসে ৪০ কেজি চাল লাগে। টিসিবির মূল্যতালিকা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ৪০ কেজি মোটা চাল কিনতে লাগত ১ হাজার ৪৫০ টাকা। আর গত মাসে লেগেছে ১ হাজার ৯০০ টাকা। তার মানে শুধু চাল কিনতেই খরচ বেড়েছে ৫০০ টাকার মতো।

মন্ত্রীদের দায়িত্ব মন্ত্রণালয় সামলানো যাতে জনগণকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা যায়। কিন্ত যে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন, মন্ত্রীদের বেতন ভাতা চলে সেই জনগণকে তাচ্ছিল্য বা উপহাস করা হলে তাকে কি অপরাধ বলা যাবে না? দারিদ্র্য কষ্ট দেয় কিন্তু অপমান জ্বালা ধরায়। কতখানি আর্থিক টানাপোড়েনে পড়লে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে গরমে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন তা বুঝতে হলে বাজারে জিনিসের দাম আর পকেটে টাকার পরিমাণ কত তা কি একটু খেয়াল করবেন না? নাকি নিজেদের অবস্থান থেকে দেখবেন?

একজন নিম্নবিত্ত মানুষ মলিন হেসে বললেন, আমাদের কষ্ট কি তারা বুঝবেন? যার মাসে ১০ লাখ টাকা রোজগার তার খরচ ১০ হাজার টাকা বাড়লে কি কিছু আসে যায়? কিন্তু যার ইনকাম ১৫ হাজার টাকা তার ৫০০ টাকা খরচ বাড়লে টান পড়ে তার পেটে। আয় রোজগারের বিবেচনায় যাদেরকে নিম্ন মধ্যবিত্ত বলা হয় দুই বছরের ব্যবধানে গড়পড়তা তাদের বাজার খরচ বেড়েছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। খরচ বেড়েছে কিন্তু আয় বাড়েনি এই মানুষের পাশে রাষ্ট্রের কি কোনো দায় থাকবে না।

ট্রাকের পেছনে একজন মাকে দৌড়াতে দেখে বুকের মধ্যে কষ্ট জাগে না কি নীতিনির্ধারকদের মনে? ইউরোপে দাম বেড়েছে এ কথা বলার আগে ভাববেন না কি ইউরোপের মানুষের আয় রোজগার কেমন? সংসার বাঁচাতে, নিজে বাঁচতে প্রাণপণ কষ্ট করছে যে মানুষেরা তারা সহযোগিতা না পেলেও অপমানিত যেন না হন মন্ত্রী মহোদয়দের কাছে, এতটুকু চাওয়া পূরণ না হলে চাপা বেদনা বিক্ষোভে পরিণত হবে

মধ্যবয়সী মা ছুটছেন এবং ঝুলছেন ট্রাকের পেছনে পেছনে। ট্রাক খালি, যা কিছু মালপত্র ছিল সব শেষ কিন্তু মানুষের লাইন শেষ হয়নি। অপেক্ষায় আছেন আরও অনেকে। কী আর করবেন টিসিবির কর্মচারীরা! তারা ট্রাক নিয়ে চলে যাচ্ছেন। লাইনে দাঁড়ানো মানুষেরা ট্রাকের পেছনে পেছনে ছুটতে শুরু করলেন।

এক মা ট্রাকের পেছনের ডালা ধরে ঝুলে পড়লেন। ট্রাক চলছে, মা ঝুলছেন। এই ছবি দেখেছেন অনেকেই। কিন্তু মায়ের বুকের কান্না কি দেখতে পেয়েছেন আমাদের দেশের মন্ত্রীসহ কর্তাব্যক্তিরা? পণ্য না নিয়ে বাড়ি গেলে কী হবে এই কথা ভেবে মায়ের চোখে তখন কান্না নাকি ক্রোধ, অসহায় আর্তনাদ নাকি ট্রাক টেনে থামানোর যে জেদ ছবিতে, তা হয়তো ফুটে ওঠেনি কিন্তু সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য তার এই মরিয়া চেষ্টার কথা নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারো। কী কী কারণে জিনিসের দাম বেড়েছে তা বলার চাইতে এই মায়েদের পাশে দাঁড়ানোটাই জরুরি।

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর