বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আন্তর্জাতিক নারী দিবস: বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে নারীর অব্যাহত সংগ্রাম 

  •    
  • ৮ মার্চ, ২০২২ ১৩:০৯

নির্বাচনি ইশতেহারের পাশাপাশি এই বিষয়টি সুস্পষ্ট থাকতে হবে রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রেও। কারণ ঘোষণাপত্রে একটি রাজনৈতিক দলের নীতি ও আদর্শগত অবস্থান এবং গঠনতন্ত্রে নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাঠামো আর পদ্ধতিগত দিকগুলো তুলে ধরা হয়। নারীকে রাজনীতির সম-অংশীদার করতে হলে একদিকে যেমন নারীর জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যদিকে তাদের দায়দায়িত্বও দিতে হবে। থাকতে হবে দল ও নেতৃত্বের ইতিবাচক মনোভাব।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চ। গত কয়েক বছর ধরে জাতিসংঘ একটি প্রতিবাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে দিয়ে থাকে নারী দিবস উদযাপনের জন্য। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নেতৃত্বে নারী : কোভিড বিশ্বের জন্য একটি সমতার ভবিষ্যৎ নির্মাণ’। গত এক বছর ধরে সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এক বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কোভিড-১৯ নারী-পুরুষ সবাইকে বিপদগ্রস্ত এবং ঘরবন্দি করলেও নারীর জন্য বাড়তি শারীরিক-মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে কাঠামো ও ব্যবস্থাপনাগত কারণে যে বৈষম্য ও অসমতা রয়েছে তা এই সময়ে আরও বেড়েছে বলেই মনে হয়।

কোভিডের কারণে কর্মহীনতার যে ধাক্কা তা নারীদের ওপর বেশি লেগেছে। এই সময়ে ঘরের কাজে পুরুষের কিছু সহযোগিতা যেমন নারীরা পেয়েছেন তেমনি আবার নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বাড়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সমতার ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ নারীর জন্য সুগম হয়নি বরং কঠিন হয়েছে।

নারী যে কী পরিমাণ বৈষম্যর শিকার তার কিছু তথ্য পাওয়া যায় খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহানের একটি লেখায়। তিনি লিখেছেন: বিশ্বে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ নারী। কৃষিতে নারীর বিরাট ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বে কৃষিযোগ্য ভূমির মাত্র ১০ শতাংশ মালিকানা নারীর বিশ্বের ১৮টি দেশে কাজ খুঁজতে হলে বিবাহিত নারীদের এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। ৩২টি দেশে পাসপোর্ট পেতে হলে নারীদের একটি ভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীতে আজো ১৫ বছরের কম বয়সী ১ কোটি ৫০ লাখ বালিকাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়।

পৃথিবীর প্রতি ৩ জন নারীর ১ জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হতে হয়। বিশ্বের বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষস্থানীয় পদের মাত্র ৩০ শতাংশ নারী। পৃথিবীতে মোট নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন নারী। এই অসমতা আমাদের দেশেও আছে এবং প্রকটভাবেই আছে। অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের লড়ে যেতে হচ্ছে অব্যাহতভাবে।

নারী অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ৮ মার্চ দিনটি এক উজ্জ্বল বাতিঘরের মতো। ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের বস্ত্রশিল্পের নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণ রাখার জন্য ১৯১০ সালে জার্মান নারী শ্রমিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রথম এই দিবসটি পালনের আহ্বান জানানোর পর থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ৮ মার্চ এক অনির্বাণ শিখার মতো আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করছে।

নারী নির্যাতনের মূল কারণ কেবল ব্যক্তি হিসেবে নারীর প্রতি হীন ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, বরং নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবও এর জন্যে অনেকাংশে দায়ী। ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে বিদ্যমান নারী-পুরুষ বৈষম্য হ্রাস ও নারী নির্যাতন দূরীকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন বেসরকারি, মানবাধিকার, নারী অধিকার সংগঠন ও সুশীল সমাজের ভূমিকা রাখার অবকাশ আছে। তবে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ও তার বাস্তবায়নের কাজটি মূলত রাজনৈতিক এবং চূড়ান্ত বিচারে রাজনৈতিক দলই কেবল এ কাজটি করতে পারে। নারী নির্যাতন রোধ এবং সমাজে বিরাজমান বৈষম্যমূলক অবস্থার পরিবর্তনে এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কোনো বিকল্প নেই।

আমরা জানি, যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতিই হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল হাতিয়ার। রাজনীতির মাধ্যমেই যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দল, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, সেখানে নীতিনির্ধারণী অবস্থানে নারীর অংশগ্রহণ কম থাকার ফলে নারী যেমন তার নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হচ্ছে তেমনি জেন্ডার-সংবেদনশীলতার অভাব বা পুরুষের আধিপত্য থেকেই যাচ্ছে সব ক্ষেত্রে। নির্বাচনি রাজনীতিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ফলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সব দিক সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা ও ধারণা সীমিত। অধিকাংশ দেশেই নারীরা মাত্র বিগত চার দশকের মধ্যে ভোটাধিকার অর্জন করতে পেরেছে। সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও নারীরা ১৯৭১ সালে ভোটাধিকার লাভ করেছে।

গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৩ অনুযায়ী সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে ৭ম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান এক্ষেত্রে ৮ ছিল। সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়েছে বলা যায়। তবে এখনও বহুদূর পথ পাড়ি দিতে হবে বাংলাদেশকে। দেশের শীর্ষ সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সংসদের ৩০০ সাধারণ আসনে নারীর সার্বিক অংশগ্রহণ কখনোই শতকরা ৬ ভাগের উপরে ওঠেনি।

তবে সামগ্রিক বিবেচনায় শুধু নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়টি আলোচিত হলে চলবে না। দরকার দেশ পরিচালনার রাজনীতিতে নারীর সম-অংশগ্রহণ ও সম-অংশীদারত্ব। আর নির্বাচনি ইশতেহারের পাশাপাশি এই বিষয়টি সুস্পষ্ট থাকতে হবে রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রেও। কারণ ঘোষণাপত্রে একটি রাজনৈতিক দলের নীতি ও আদর্শগত অবস্থান এবং গঠনতন্ত্রে নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাঠামো আর পদ্ধতিগত দিকগুলো তুলে ধরা হয়।

নারীকে রাজনীতির সম-অংশীদার করতে হলে একদিকে যেমন নারীর জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যদিকে তাদের দায়দায়িত্বও দিতে হবে। থাকতে হবে দল ও নেতৃত্বের ইতিবাচক মনোভাব। নারীদেরকে নেতৃত্বে নিয়ে আসার জন্য তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোতে গড়ে তুলতে হবে নারীবান্ধব পরিবেশ।

এটা মনে রাখতে হবে, নারীর রাজনৈতিক অধিকার অর্জন মানে অন্য কারো স্থান দখল নয়, বরং রাজনৈতিক জীবনে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করাটাই এখানে মূল উদ্দেশ্য। রাজনীতিতে এবং ক্ষমতা কাঠামো থেকে জনগোষ্ঠীর অর্ধেক অংশ নারীদের বাদ দিয়ে কখনও সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আর রাজনীতিতে নারীদের প্রতিনিধিত্বহীনতা বা ন্যূনতম প্রতিনিধিত্ব কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শক্তির দিক হতে পারে না। জনসংখ্যার উভয় অংশের স্বার্থকে সমভাবে বিবেচনা করে নারী-পুরুষ যৌথভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে গতিশীলতা এবং গুণগত মান অর্জন করতে সক্ষম হবে।

নারী মুক্তি সংগ্রামে, নারীর এগিয়ে চলার পথে অনেক বাধা-বিপত্তি, সীমাবদ্ধতা-চ্যালেঞ্জ আছে সন্দেহ নেই; নারীর অগ্রগতি ও অর্জনের পথে অন্য ধরনের বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না। আজও আমাদের দেশ ফতোয়াবাজির প্রভাবমুক্ত নয়, যৌতুকের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। নারীর স্বোপার্জনের উপর পুরুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে প্রবণতা, ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে অবরুদ্ধ ও অবদমিত রাখার যে ক্লান্তিহীন অপচেষ্টা এসবই নারীর অগ্রগতি, তার মুক্তি ও তার ক্ষমতায়নের পথে বড় অন্তরায়।

নারীর অগ্রগতির পথে নতুন এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। দেশকে সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে না পারলে নারীর পক্ষে সামনে এগিয়ে যাওয়া যেমন কঠিন হবে, তেমনি দেশের উন্নতি-অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হবে। অভিজ্ঞতা থেকে এটা আমরা বলতে পারি যে, নারীরা এগিয়ে গেলে দেশও এগিয়ে যায়। নারীদের পিছনে রেখে দেশের পক্ষেও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

তাই সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দেশের সব গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং রাজনৈতিক সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন, যারা অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

নারীর এগিয়ে য়াওয়ার পথের বাধা অপসারণ করার জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই। নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার পথে অন্যতম অন্তরায় সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অঙ্গীকার।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ বিভাগের আরো খবর