বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শক্তি নয়, শান্তির জয় হোক

  • খান মো. রবিউল আলম   
  • ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৭:২০

যুদ্ধে প্রথম নিহত হয় সত্য। একই সঙ্গে যুদ্ধের শুরুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্মল বাতাস। আজ গোলাগুলি, মিসাইল আর রকেটের শব্দে কিয়েভের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে অজানার উদ্দেশে। যুদ্ধের সময় আবহাওয়া গুমোট হওয়া শুধু প্রতীকী ব্যাপার নয়, বাস্তবিক অর্থে বাতাস দূষিত হয়ে পড়েছে। কিয়েভ হয়ে উঠছে দূষিত বাতাসের নগরী।

রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের বিশেষ কিছু দিক রয়েছে।

প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সৃষ্ট কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেট স্টেটস (সিআইএস)-এর ওপর রাশিয়া আধিপত্য ধরে রাখতে চায়;

দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সামরিক সমীকরণ;

তৃতীয়ত, স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার;

চতুর্থত, এ অগ্রাসনের বৈশ্বিক প্রভাব।

আগ্রাসন নতুন কিছু নয়। আগ্রাসনের ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের সমান। কিন্তু কোনো ধরনের আগ্রাসন কাম্য নয়। এ ধরনের আগ্রাসন সমকালীন বিশ্বইতিহাসে বেশ কয়েকটা দেখা যায়। দুখের বিষয়, পৃথিবীর এত অগ্রগতি, এত অর্জনের পরেও শাসকদের মধ্যে আগ্রাসনের প্রবণতা কমছে না। শাসকেরা পোশাকি অর্থে আধুনিকতার বেশ ধরেছে। কিন্তু তাদের ভেতরের বসতি বর্বরতা। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাম্রাজ্যবাদ তাদের তাড়া করে ফিরছে।

কিয়েভ আক্রমণের পর বিবিসি লাইভ করছিল। বিবিসির চিফ ইন্টারন্যাশনাল করসপনডেন্ট লেসি ডোসিট টেলিভিশনের পর্দায় যখন সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন তখন মুহুর্মুহু কামানের গোলা এবং সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। লেসি ডোসিট দর্শকদের উদ্দেশে বলছিলেন, এ গোলাগুলি আর সাইরেনের শব্দ কেবল কিয়েভবাসীর জন্য নয়, বিবিসির মাধ্যমে তা সারা বিশ্বের মানুষ কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আগ্রাসনের এ দামামা বিশ্ববাসীর জন্যে এক বিশেষ সংকেত।

বর্তমানে ব্যক্তি একে অপরের সঙ্গে দারুণভাবে আন্তঃসম্পর্কিত। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কেউ আক্রান্ত হলে সেই ব্যথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্যখানে, যা ঘটেছে মূলত কানেক্টিভিটির কল্যাণে। কানেক্টিভিটি সংযোগী ও সংবেদী পৃথিবী তৈরি করেছে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই।

সংযোগের কারণে তৈরি হয়েছে বিশ্বমন। প্রযুক্তির কল্যাণে ভৌগোলিক নাগরিকত্বের সীমানা পেরিয়ে ব্যক্তি ভার্চুয়াল সিটিজেনশিপ অর্জন করেছে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড আজ সংযুক্তির এক নতুন পরিক্ষেত্র। দেশভিত্তিক নাগরিকত্বের পরিচয় পেরিয়ে ব্যক্তি সোস্যাল মিডিয়ার সুবাদে গ্লোবাল সিটিজেনশিপ চর্চা করছে। আজ কোনো দেশের নাগরিকের প্রতি আক্রমণ মানে যৌক্তিক ও সংবেদনশীল বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি আগ্রাসন।

যখন কিয়েভের একজন মা তার সন্তানের অজানা আশঙ্কার কথা ভেবে হাতে রক্তের গ্রুপ-সংক্রান্ত তথ্য লিখে ব্যাল্ট পরিয়ে দেন তখন তার অসহায়ত্ব ও আশঙ্কাটি হয়ে ওঠে সবার। কিংবা বহিঃশক্রর আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষায় যখন ইউক্রেন সরকার ভোর রাতে সাইরেন বাজায় এবং একজন শিশুর সেই সাইরেনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বমি করতে থাকে। অভিভাবকদের অসহায়ত্ব সাবইকে বিষণ্ন করে। এমন ভীতিকর পরিস্থিতি কারো কাম্য নয়।

অনেক বলেন, যুদ্ধে প্রথম নিহত হয় সত্য। একই সঙ্গে যুদ্ধের শুরুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্মল বাতাস। আজ গোলাগুলি, মিসাইল আর রকেটের শব্দে কিয়েভের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে অজানার উদ্দেশে। যুদ্ধের সময় আবহাওয়া গুমোট হওয়া শুধু প্রতীকী ব্যাপার নয়, বাস্তবিক অর্থে বাতাস দূষিত হয়ে পড়েছে। কিয়েভ হয়ে উঠছে দূষিত বাতাসের নগরী। বিবিসি উল্লেখ করেছে, চেরনোবিল পারমাণবিক প্ল্যান্ট রাশিয়া জব্দ করেছে যেখান থেকে রেডিয়েশন স্পাইক হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একটু বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য হয়ত অনেক সতেজ প্রাণ ঝরে যাবে।

একটু পেছনে ফিরে দেখা যায়, সংস্কারমুখী বামপন্থি নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি অনুভব করেন, শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কারণে দেশটি আর্থিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ মোকাবিলায় নতুন সমরাস্ত্র নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, জনগণের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হয়। সংস্কারের জন্য তিনি ঘোষণা করেন গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা নীতি যার ধারাবাহিকতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে নব্বইয়ের দশশের গোড়ার দিকে।

গ্লাসনস্ত অর্থ হলো উন্মুক্ততা। দীর্ঘদিনের একদলীয় এবং বদ্ধশাসনে জনগণের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল তা দূর করার উদ্দেশ্যেই এ নীতি গৃহীত হয়। অন্যদিকে, পেরেস্ত্রইকার অর্থ হলো অর্থনৈতিক পুনর্গঠন যাকে গর্বাচেভ সামাজিক কাঠামোর মানবিকীকরণ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল সমাজতন্ত্রের আধারে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে একটি দক্ষ অর্থনীতি এবং সর্বোপরি একটি উন্নত বিজ্ঞান প্রযুক্তিনির্ভর গণতান্ত্রিক সমাজকাঠামো। গর্ভাচেভ অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করেন। সোভিয়েত বাজার বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার জন্য উন্মুক্ত হয়। সোভিয়েত অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে থাকে।

পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমশ নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনীতি থেকে বাজার অর্থনীতির দিকে এগোতে থাকে। অনেক জল ঘোলা হওয়ার পরে ৭৪ বছরের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। এর সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন ও পূর্বতন অঙ্গরাজ্যগুলোর সমন্বয়ে কমনওয়েথ অব ইনডিপেন্ডেন্ট স্টেটস (সিআইএস)।

নব্বইয়ের দশকের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও এর পরবর্তী সংস্করণ রাশিয়া স্বাধীন স্টেটসগুলোর ওপর দৃশ্যমান আধিপত্য বাজায় রাখতে চেয়েছে। স্টেটসগুলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও রাশিয়ার ছায়া থেকে তারা পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে অনেক সিআইএস সদস্য একধরনের অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে। এর অংশ হিসেবে দেখা যায়, ২০১৪ রাশিয়া ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া দখল করে নেয় এবং ইউক্রেনের কিছু অংশে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৈরি ও মদদ দিতে থাকে। সদস্য দেশগুলোর স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে উপভোগের পথ মসৃণ হয়নি।

কেউ ভয় না পেলে অন্য কেউ ভয় দেখায় না। শক্তি চর্চার পেছনে যেসব বিষয়টি কাজ করে তা হলো ভয় বা আধিপত্য। অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র এক জোট হচ্ছে, সামরিক জোট গঠন করছে; যেমন-নর্থ আটলান্টিক কাউন্সিল যাকে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) বলা হয়। ইউরোপিয়ান দেশসহ আমেরিকার নেতৃত্বে এ বৃহৎ সামরিক জোট কাজ করছে। এ জোটের মূল লক্ষ্য- শক্তি ও ক্ষমতাচর্চা ও আতঙ্ক তৈরি। ত্রিশটি শক্তিসম্পন্ন দেশ নিয়ে এ জোট গঠন কাজ করছে যা সদস্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাশাপাশি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার জন্য বদ্ধপরিকর।

জোটভুক্ত দেশগুলো কেবল ভৌগোলিক আকার নেই তাদের রয়েছে অভিন্ন সামরিক ভূগোল যা ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এক সংবাদ সম্মেলনে ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টেলটেলবার্গ স্পষ্ট করে বলেছেন- ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর রয়েছে অভিন্ন একটা টেরিটোরি যার প্রতিটি ইঞ্চি মাটি সুরক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেছেন- ন্যাটোর একজন সদস্য আক্রান্ত হওয়া মানে সব সদস্য আক্রান্ত হওয়া। এই দর্শন ধারণ করে ন্যাটো সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

এরকম একটি শক্তিশালী সামরিক জোটের উপস্থিতি বলে দেয় যে, পৃথিবীর ভারসাম্য সৃষ্টি কতটুকু সম্ভব। এরকম একটি সামরিক জোট থাকলে তার জন্য যুদ্ধ লাগে, অশান্ত পরিবেশ লাগে, অস্ত্র ব্যবসা ও ক্ষমতার চর্চা লাগে। ন্যাটোর মতো সামরিক জোটের উপস্থিতি পৃথিবীর জন্য বড় হুমকি।

ন্যাটো সামরিক জোট সম্প্রসারণ করতে করতে ঠিক রাশিয়ার নাক বরাবর চলে এসেছে। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো ন্যাটোর সদস্যপদ ও অংশীদার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা রাশিয়ার কাছে বড় অস্বস্তি ঠেকছে। রাশিয়া অনুভব করছে তার মানচিত্রে ন্যাটোর গরম হাওয়া। এ পরিস্থিতি রাশিয়াকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।

অপরদিকে রাশিয়া তার বিষদাঁত ফোটানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আধিপত্যবাদী মনোভাব থেকে রাশিয়ার এ অপতৎপরতা। রাশিয়া নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চায়। প্রমাণ করতে চায় সে মরে যায়নি। আজও সে পৃথিবীর ক্ষমতার প্রাধান্যশীল শক্তি। এ জন্য অস্ত্র, সহিংসতা ও আগ্রাসন পথ বেছে নিয়েছে।

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়ার পর থেকে ইউক্রেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, নিজেকে নিরাপদ করতে সে ক্রমশ পশ্চিমের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। ইতোমধ্যে সে ন্যাটোর অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিজস্ব শক্তির কোনো বিকল্প নেই। ইউক্রেন আজ হাড়ে হাড়ে সেটা টের পাচ্ছে। প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালীই হোক না কেন মর্যাদার সঙ্গে মাতৃভূমি সুরক্ষায় লড়াই চালিয়ে যাওয়া সর্বোত্তম পন্থা। বীরের বেশে যদি পরাজয়ও ঘটে, জীবননাশ হয় তারপরও পৃথিবীর ইতিহাস তাকে বীরের মর্যাদা দেবে। ঠিক বলা যাচ্ছে না, ইউক্রেনের হৃদয় সুরক্ষায় বন্ধুরা কতটুকু সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে। কারণ, এর পেছনের জ্বালানিসহ কিছু ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু রয়েছে।

হতাশার কথা হলো- পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি, সনদ ও আইনের প্রতি বৃহৎ শক্তিগুলো হরহামেশা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। জাতিসংঘের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। জাতিসংঘ অসহায়ের মতো আগ্রাসন বন্ধে মানবতার দোহাই দিতে বাধ্য হচ্ছে কারণ এর চেয়ে তার সামনে হয়ত উন্নত কোনো বিকল্প নেই।

শাসকদের হাতে অনেক মারণাস্ত্র থাকতে পারে কিন্তু তারা তো মানুষের স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতে পারে না। শত তৎপরতায়ও তা সম্ভব নয়। মানুষ একবার যা দেখে ফেলে তাকে অদেখা বানানো যায় না। কেবল ইউক্রেনে নয়, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, বসনিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যা ঘটেছে তা কি অদেখা বানানো সম্ভব?

আগ্রাসীদের ভৌগোলিক ইতিহাস পুনর্লিখনের চেষ্টা একটি ঘৃণ্য তৎপরতা। ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সব রাষ্ট্র স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা নিয়ে টিকে থাক এবং তা থাক বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর স্বার্থে। শক্তি নয়, শান্তির জয় হোক।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

এ বিভাগের আরো খবর